বীনা সিক্রি এবং ভারতের দাদাগিরি

গৌতম দাস | Nov 21, 2020 05:37 pm
বীনা সিক্রি

বীনা সিক্রি - ছবি সংগৃহীত

 

ব্যাপারটা একটু পুরনো। কিন্তু বারবার ফিরে আসে এমন পুরনো রোগ। বীনা সিক্রি বাংলাদেশে ভারতের সাবেক এক রাষ্ট্রদূত। গত ২০০৩-০৬ সময়কালে তিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ভারতের সব কিছুতে শো-আপ বা বাড়িয়ে বলা বা করা- এটা এমনকি বেসরকারি পর্যায়ে তো বটেই সরকারি পর্যায়েও অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে সম্ভবত শো-আপ করাদের শীর্ষ আছেন বীনা। আর বাংলাদেশে তিনি এটা করার আরো সুযোগ নিয়ে থাকেন কারণ তিনি সরকারি আমলা হিসেবে চাকরি শেষ করলেও এখন সাউথ এশিয়ান উইমেন্স নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক, এর সুযোগে। দেখা যায়, তিনি সবসময় যেচে ‘হেদায়েত’ করতে ভালোবাসেন আর ইদানীং সেটা যা নিয়ে, সেই সাবজেক্ট হচ্ছে সেকুলারিজম। অর্থাৎ যেন উল্টো মনে করিয়ে দিতে চান আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। তাই দু’পক্ষ সমান না।

কিন্তু এই সাবজেক্ট নিয়ে তার জানা বোঝা ঠিক আছে বা যথেষ্ট কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এ ছাড়া অন্য যেসব প্রসঙ্গ তিনি সাধারণত আনেন ও কথা বলেন সেগুলো যেমন- ভারত পড়শিদের ‘বড়ভাই’, সে কথাটি আবার উনি নিজেই বলছেন। গত ২০১৫ সালে ভারতের এক ওয়েব মিডিয়ায় তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন যেটা ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাকও অনুবাদ করে ছেপেছিল। বাংলায় শিরোনাম ছিল- “ভারত এখন দক্ষিণ এশিয়ায় ‘এলডার ব্রাদার’ : বীনা সিক্রি।” আবার ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ভারতের এশিয়ান এজ পত্রিকায় তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ মুসলমান ও বাঙালি পরিচয়ের মধ্যে আটকে গেছে।’ এ ছাড়া শাহবাগ আন্দোলনের আমলে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলছেন, ’৭১-এর প্রজন্মের জেগে উঠা ছিল’- ইত্যাদি ধরনের ভারতীয় ব্যাখ্যা যার সার কথা হতে দেখা যায় যেটাকে আমরা প্রচলিত ভাষায় বলি, ইসলাম ‘কোপানো’র সুযোগ নেয়া আর উচ্ছ্বাস দেখানো। তখন প্রশ্নকর্তা শাহবাগের মধ্যে না- বোঝা অবুঝ চোখে এটাকে ‘আরব স্প্রিং’ বলে দেখছিলেন। অথচ আরব স্প্রিং (নামেও বোঝা যাচ্ছে) সেকালে ঘটেছিল সাধারণত মুসলমান প্রধান রাষ্ট্রে। কিন্তু বাংলাদেশের শাহবাগ তো ইসলামবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত সেকুলারদের আন্দোলন!

এমনিতেই যারা বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত হয়ে আসেন এদের মধ্যে একটা ‘কলোনি দখলদার মাস্টার’ ভাব কমবেশি দেখা যায় যেন তারা ভারত সরকারের ভাইসরয় বা ‘কলোনি রাজপ্রতিনিধি, আমাদের দেখভাল বা দেখেশুনে রাখতে ও হেদায়েত করতে এসেছেন। ঠিক যে জিনিসটা ১৯৪৭ সালে আগস্টে কলোনিমুক্ত ও স্বাধীন ভারত হয়ে গেলে নেহরুর মধ্যে দেখা গিয়েছিল বা যেত। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে তিনি নিজেকে ‘ব্রিটিশ ভাইসরয়’ ভাবতেন যার সবচেয়ে ভালো ও বিস্তারিত প্রমাণ আমরা দেখতে পাই নেপাল-ভারত ১৯৫০ সালের চুক্তির ভাষায়। কলোনিদখলি চোখে দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে সার্বভৌম সমমর্যাদার সম্পর্ক হতে পারে না, হলে হতেই হয় দখলদার ও অধস্তনের, এই বিশ্বাস তার প্রখর ছিল। ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে চলে গেলেও নেহরু যেন ব্রিটিশের উত্তরসূরি; তাই তিনি কলোনি মাস্টারের সেই ভূমিকায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। এমন চিন্তার সমস্যার গোড়া হলো- নেশন স্টেট বা জাতিরাষ্ট্র চিন্তার মধ্যে যেখানে দুই রাষ্ট্রের সমমর্যাদার নাগরিক সম্পর্ক বলে কোনো ধারণা বা ইমাজিনেশন থাকে না, কাজ করে না। সব কিছুকেই এরা মাস্টার-স্লেভ বা প্রভু আর অধস্তন বানিয়ে ফেলেন এবং সেভাবে দেখে থাকেন। এর বাইরে ভাবতে পারেন না। অথচ এরাই আসেন আমাদেরকে সেকুলারিজম শেখাতে।

বীনা সিক্রির সেকুলারিজম আসলে একজন হিন্দু জাতিরাষ্ট্রবাদীর ইসলামবিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানো বৈ আর কিছু নয়। এটি সবচেয়ে সহজে ধরা পড়ে যখন আমরা দেখি আরএসএস-বিজেপির মতো পাঁড় হিন্দুত্ববাদী দলের মোদি সরকার প্রায় ছয় বছর ধরে ভারতে ক্ষমতায়; অথচ বীনা সিক্রির মোদির বিরুদ্ধে কোনো আপত্তি বা সমালোচনাই নেই; বরং একেবারে সব ঠিকঠাক সুন্দরভাবে চলছে। অথচ জয় শ্রীরামের অত্যাচার নিপীড়নে টেকা দায়, বুকের খাঁচার ওপর লাফিয়ে উঠছে তারা। তার মানে, সিক্রির সেকুলারিজম ভাবনার ফিল্টারেও আরএসএস বা মোদি পার হতে পারছেন। এর চেয়ে তামাশা আর কী হতে পারে! এ ছাড়া আরো তামাশার দিকটা হলো- বীনা সিক্রি মোদি-অমিতের ভারতের পড়শি দেশের কেবল ‘না-মুসলমানদেরই নাগরিকত্ব দেয়া’ হবে এই চরম বৈষম্যমূলক আইন গ্রহণ করেন বলে প্রকাশ্যে জানাচ্ছেন। এমনকি সাথে এই আইনের পক্ষে তিনি নিজে সাফাই গেয়ে বলেছেন, এটা ‘ন্যায্য’। এখানে তাকে ‘বাহ রে সেকুলারিস্ট’ ছাড়া অন্য কিছু বলার সুযোগ দেখি না।

ভারত ‘এলডার ব্রাদার’ তত্ত্ব!
বীনা সিক্রির বোঝাবুঝির দৌড় দেখে জানা যায়, তার চিন্তা কত মাথা মোটা ধরনের ভোঁতা। আর তিনি মনে করেন, বাকচাতুরি দিয়ে তিনি কথা বলবেন আর এটাকে কূটনৈতিক কথা বলে সবাই তা গ্রহণ করবে বা মেনে নেবে।

বাংলাদেশে ২০০৭ সালের জবরদস্তির তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম করে আমেরিকা বাংলাদেশকে ক্রমেই ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল; যাতে ভারত যেমন ইচ্ছা আসামসহ নর্থ-ইস্টের জন্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিটের নামে পুরো একটা করিডোর এবং তা বিনাপয়সায় এবং প্রায়রিটিতে আমাদের দুই বন্দরও প্রায় বিনাপয়সায় ব্যবহার করতে পারে। অবশ্য এ নিয়ে ভারতের জন্মের সময় থেকেই নেহরুসহ ভারতের শাসকদের দ্বিধা ছিল যে, আসামসহ পুরো নর্থ-ইস্টের জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডোর মাগনা পেলেও সেটা দরকার কি না, নেয়া ঠিক হবে কি না। এ কথাটা শুনতেই আজব ও অবিশ্বাস্য লাগতে পারে। কিন্তু কথা সত্য।

আসামসহ পুরো নর্থ-ইস্ট ভারতের বাকি ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন বা ল্যান্ডলকড নয় একেবারেই। অন্তত ১৮ কিলোমিটার সংযোগ-ভূমির দ্বারা এটি সরাসরি সংযুক্ত। আবার দেশভাগের সময়ের আগে বা পরে কখনোই নর্থ-ইস্টের জন্য করিডোর বা ট্রানজিট দরকার বলে কখনো ভারত পাওয়ার ইচ্ছা বা আগ্রহই প্রকাশ করেনি। এটাই প্রমাণ করে, ভারত আসামের জন্য করিডোর বা ট্রানজিট চায় না, অন্তত এই প্রশ্নে তাদের বিরাট দ্বিধা আছে। কেন?

কথাটা বোঝা খুবই সহজ। আসাম যে যুক্তিতে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর বা ট্রানজিট চাইবে, বাংলাদেশের পোর্ট বা ডিপ সি পোর্ট ব্যবহার করে পণ্য আনা-নেয়ার সুবিধা চাইবে, এরই সাথে সাথে ঠিক একই যুক্তিতে আসামসহ নর্থ-ইস্টের ওপারে আরো উত্তরে আছে চীন। চীনের যে ভূখণ্ড তারা পুরোপুরিই ল্যান্ডলকড বলে, তারাও আসামের ওপর দিয়ে করিডোর বা ট্রানজিট চাইবে আর একইভাবে অসমীয়দের মতো বাংলাদেশের সব ফ্যাসিলিটি পেতে চাইবে। এর সোজা মানে হবে, ভারতকেও আসামের ওপর দিয়ে চীনকে করিডোর সুবিধা দিতে বাধ্য হতে হবে। কিন্তু এটাই ভারত কখনো চায় না। এতে নাকি ভারতের আসামের ‘পবিত্রতা ও শান্তি নষ্ট হয়ে যাবে’- এই হলো ভারতের প্রকাশ্য যুক্তি।

এ জন্যই আমরা দেখি আসামের বাসিন্দারা কথিত ‘বাঙালিদের বহিষ্কার’ চাইত সেই ১৯৫১ সাল থেকে। কিন্তু কখনো বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর বা ট্রানজিট চায়নি। অথচ ভারতের শাসকরা পিছিয়ে পড়া আসামে (১৯৭২ সালের আগে পুরো নর্থ-ইস্টকে আসামের অংশ গণ্য করা হতো) কখনো অবকাঠামো বিনিয়োগই ঠিকমতো দিতে রাজি হয়নি; সম্পদ নেই বলে এড়িয়ে গেছে। আর তাতে আসামেই ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার প্রবল সব আন্দোলন জেগে উঠেছে, তবু ভারত কিছুই করতে রাজি হয়নি।

আমরা নাকি ‘মাগনা পেলে আলকাতরাও খেতে চাই’- এখন এ অবস্থা হয়েছে ভারতের। মাগনায় করিডোর পাচ্ছে বলে এখন ভারতের আগ্রহ হয়েছে। কিন্তু ইন্টারেস্টিং হলো- বাংলাদেশ বিনাপয়সার পোর্টসহ করিডোর দিচ্ছে; এটা বিজেপির পক্ষ থেকে আসামের বাসিন্দাদের জন্য কোনো উপহার এনে দিচ্ছে। তা হলেও এটা কোনো নির্বাচনী ইস্যু নয়। মানে তা করা হয়নি। মূল কথা, আসামের এ পাওয়াটা লোপ্রোফাইলে রেখে দিতে চায় ভারত। কারণ সম্ভবত বাংলাদেশ যে এত বিশাল সুবিধা দিয়েছে এটি প্রচার করা হলে বাংলাদেশের দাবি বের হতে পারে। এ ছাড়া এর প্রচার বেশি হলে কখন না আবার চীন না একই সুবিধা দাবি করে ভারতের কাছে চেয়ে বসে আর বাংলাদেশ তাতে সমর্থন দেয়। এটা অবশ্যই বিরাট এক তামাশা যে, পোর্টসহ করিডোর পাওয়া আসামের রাজনীতিতে ভারতের কোনো দলের নির্বাচনে কোনো ইস্যুই নয়।

কিন্তু সমস্যা আরেক জায়গায়। আমেরিকা আমাদেরকে ভারতের হাতে তুলে দিলেও ভারতের জন্য এটা বেশ অস্বস্তিকর যে, কোনো কিছু পাল্টা সুবিধা বাংলাদেশকে না দিয়ে করিডোর নেয়াটা কেমন দেখাবে! তাই এই অস্বস্তিটা কাটাতেই ঠিক করা হয়, বাংলাদেশকে ‘দুধ-ভাত খেলোয়াড়’ বানিয়ে খেলায় নেবে। সেটা কী?

মরহুম শেখ মুজিব সেই ১৯৭৪ সালে ভারতকে বেরুবাড়ি দিয়ে দিয়েছিলেন, বিনিময়ে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিটমহলে যাওয়ার করিডোর ভারত দিয়ে দেবে- এই ভূমিবিনিময় চুক্তি হয়েছিল ওই সময়। আর আমাদের কনস্টিটিউশন সংশোধন করে মুজিব বললেন- ‘আমাদের কর্তব্য আমরা করেছি,’ কিন্তু ভারত তা কখনো গত ৪১ বছরে করেনি। অর্থাৎ এটা আমাদের পাওনা অধিকার হলেও ভারত আটকে রেখেছিল। এ ছাড়া তিস্তার পানি পাওয়াই আমাদের ভাটির দেশের পাওনা ও অধিকার। আর যা কোনো রাষ্ট্রের পাওনা অধিকার সেটি পেতে নতুন কোনো কিছু দিয়ে ভারতের সাথে বিনিময় করার প্রশ্নই ওঠে না। সেটি হবে অনেকটা এমন যে, আমার থেকে ধার নেয়া টাকা ফেরত দেয় সে, এবার আমার থেকেই নতুন করে ধার নিয়ে সেই টাকা দিয়েই আমার আগের ধার শোধ করল বলে দাবি করছে; ঠগের বাটপাড়ি যেমন হয়। সেই ছিটমহল ভূমিবিনিময় এই ৪১ বছর পরে এবার ২০১৫ সালের মে মাসে পার্লামেন্টে পাস করা হয়েছে। আর তিস্তার পানি? সেটাও আমাদের পাওনা হলেও তা আর কখনোই পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।

কিন্তু এই ২০১৫ সালের মে মাসে ভারতীয় পার্লামেন্টে আইন পাস হওয়াটাকে নিয়ে বীনা সিক্রির মন্তব্য সাক্ষাৎকারে দেখুন। ‘এই চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারত তার বড় ভাই (বিগ ব্রাদার) পরিচিতি মুছে দক্ষিণ এশিয়ায় জ্যেষ্ঠ ভাই (এলডার ব্রাদার) হিসেবে সম্মান অর্জন করেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীনা সিক্রি।’ শুধু তা-ই নয়, সিক্রির চাপাবাজি হলো, তিনি বলছেন- এটি দিয়ে নাকি মোদি তার ‘প্রতিবেশী প্রথম’ মতবাদ কাজে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন।’ এ ছাড়া আরো আছে; সিক্রি বলেছেন, এই আইন পাস হওয়াতে, ‘ভারতের জন্য ভূখণ্ডগত জাতীয় ক্ষতি হয়েছে’। এটা কলোনিবাজ ইংরেজদের মতো শঠতাপূর্ণ কথা। কারণ এটা ছিল ভূমির বিনিময়ে ভূমি নেয়া। তাই এটা কারো জন্যই একপক্ষীয় ভূমি হারানোই নয়। আমরাও সমতুল্য ভূমি হারিয়েছি। অথচ সিক্রি এটা এখানে তুলে ধরছেন ‘ভারতের দয়া’ বলে, ‘একপক্ষীয় ভূমি হারানো’ বলে। ফলে সত্যিই আমরা ঠগের পাল্লায় পড়েছি দেখা যাচ্ছে।

এভাবে সর্বশেষ যে মিথ্যা বলা আর চাপাবাজিটা বীনা সিক্রি করেছেন আবার এ দেশে লেখা ছাপিয়েছেন, সেটি ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ স্টার মিডিয়া গ্রুপ বাংলা-ইংরেজি দুভাবেই ছাপিয়েছিল।

এ ছাড়াও ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে গত ২৯ আগস্ট এক ভার্চুয়াল ওয়েবনিয়ার আলোচনায় তিনি আবার মিথ্যা ও চাপাবাজি করতে গেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ‘বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের কনস্টিটিউশন বঙ্গবন্ধুর লিগ্যাসি এবং ওর মধ্যে সেকুলারিজম, ডেমোক্র্যাসি, সোস্যালিজম ও জাতীয়তাবাদ বলে কিছু বৈশিষ্ট্য আছে- যেগুলো ইন্ডিয়ান কনস্টিটিউশনের সাথে কমন।’... ‘ঢাকার ১৯৭২ সালের কনস্টিটিউশন আমাদের দুই দেশের মধ্যে নতুন ধরনের সম্পর্ক শুরু করতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।’

বীনা সিক্রি ইদানীং সুযোগ পেলেই ‘জ্ঞানী’ লোক হওয়ার আর বাংলাদেশকে সেকুলার জ্ঞান দেয়ার উৎস হিসেবে নিজেকে হাজির করতে চাইছেন। কিন্তু আমরা সত্যিই খুব দুঃখিত। আমরা মনে করি, তার কনস্টিটিউশন বা সেকুলারিজম বিষয়গুলো নিয়ে কোনো জ্ঞান বা ধারণাই নেই। একেবারেই কান খুলে শুনুন, নিচের বাক্যটা- কোনো কনস্টিটিউশনে যদি ‘আমাদের নীতি সেকুলারিজম’ বলে উল্লেখ থাকে তবুও ওই রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার বলে গণ্য হবে না। আসলে রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার বলে গণ্য হওয়ার পথই এটা নয়। একেবারেই নয়। এমনকি কনস্টিটিউশনের কোথাও সেকুলারিজম শব্দটা উল্লেখ করা না থাকলেও সেই রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার বলে গণ্য হতে পারে।

মানুষ মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত শিখে এবং চাইলে শিখতে পারে। সিক্রি, আপনার উচিত হবে এ বিষয়ে পড়তে বসা, স্টাডি করা। দুঃখজনক হলো- নেহরু, গান্ধীসহ যারা আগের ভারতের নেতা ছিলেন এমনকি ইন্দিরা গান্ধী এরা কেউই উপরে যে প্যারাটা লিখেছি, সে কথাগুলো জানতেন না। সে কারণে ভারতের কনস্টিটিউশনেও সেকুলারিজম শব্দটা আগে ছিল না। এরা সবাই সেকুলারিজম বিষয়ে না জেনেই মারা গেছেন। কী করলে রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার হয় বা সেকুলার বলে গণ্য হবে তা ইন্দিরা গান্ধীসহ সবাই না জেনেই মারা গেছেন।

তাই একটা সত্য আগে জেনে রাখুন। সেকুলারিজম লিখে রাখা নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের দুই কনস্টিটিউশনে এটি কমন কথা এবং কমন ভিত্তি এবং এই কমন ভিত্তির বলে যে নতুন ধরনের সম্পর্ক ইত্যাদি অনেক কথা বীনা বলেছেন তাও ভিত্তিহীন, অসত্য ও ভুল।

ফ্যাক্টসটা হলো- বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার সময় রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এই তিন নীতি লেখা হয়েছিল, ১৯৭১ সালের এপ্রিলে ১১ বা আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের অক্টোবরেও- ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি তত দিনে তিনবার চাওয়া হলেও ভারত তা দেয়নি। যতক্ষণ না অস্থায়ী সরকার ভারতের ইন্দিরা গান্ধীর ড্রাফট বা পরামর্শের- সেকুলারিজম, ডেমোক্র্যাসি, সোস্যালিজম ও জাতীয়তাবাদ বলে নতুন করে এই চার নীতির কথা উল্লেখ না করে- এটি বলায় আবার অনুরোধ পাঠানো হয়েছে।

এর মানে- ১. সেকুলারিজম, ডেমোক্র্যাসি, সোস্যালিজম ও জাতীয়তাবাদ বলে নতুন করে এই চার নীতি করার শর্তেই নিরুপায় বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি পেতে হয়েছে। ২. তখনো ভারতের কনস্টিটিউশনে এই চার নীতির কোনো শব্দ ছিল না। তা অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়েছে আমাদেরও ১৯৭২ সালের সংবিধানের অনেক পরে ১৯৭৬ সালে, নতুন করে ভারতের কনস্টিটিউশন সংশোধন করা হলে।
এ কাজটা ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতের যারাই এই কথিত নষ্ট সেকুলারিজমের ভক্ত অথবা যারা রাষ্ট্র বা কনস্টিটিউশন সেকুলার হয় এভাবে বোঝেন তাদের সবার চরম অজ্ঞতাই প্রকাশ করে এবং এ অজ্ঞতা চিহ্ন হয়ে থেকে গেছে।

এক দিকে নতুন রাষ্ট্র গড়ার সময়ে কী কী বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতে হয়, সেসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় যথেষ্ট ধারণা না রাখা, অন্য দিকে মূলত ইসলামবিদ্বেষ ও ঘৃণার পরিণতিই হলো আমাদের তিন দেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা ও সব অসাম্যের সবচেয়ে বড় কারণ। সেকুলারিজম ধারণাটা কারো মনের দগদগে বিদ্বেষ ও ঘৃণা যেন সন্তুষ্টি লাভ করার হাতিয়ার হতে না পারে। কারণ এটি হাতিয়ার নয়। অথচ এটাই হয়ে এসেছে, সেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এত দিন।

বাংলাদেশের মানুষরা সচেতন, তাই এই বিদ্বেষ ও ঘৃণা টের পেয়েছে। তাই তারাও কনস্টিটিউশনে এই ‘সেকুলারিজম’ বলে এক শব্দ লিখে রেখে সব নষ্টামি চিন্তাকে প্রতিরোধ ও শায়েস্তা করতে, কিছুটা রাগে ক্ষোভে পাল্টা- আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাস বা রাষ্ট্রধর্ম ধরনের শব্দ বা ধারণা ঢুকিয়ে রেখেছে; যদিও তারা ভালোই জানে, এগুলো লিখে রাখা বা না রাখার সাথে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস নড়াচড়া হবে না, হওয়ার কোনোই সম্পর্ক নেই।

যারা নষ্টা-সেকুলারিজমের শয়তানি থেকে বেরিয়ে শুদ্ধ হতে চান, তারা একটু খোঁজখবর করুন। রাজা রামমোহন রায় যাকে ভারতের কমিউনিস্ট-প্রগতিশীলরা ভারতে বিশেষ করে বাংলায় ‘রেনেসাঁর আদিগুরু’ বলে সবাই জানেন ও মানেন, তিনিই তো ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মধর্ম চালু করেছিলেন, ১৮১৫ সালে। তা হলে এখানে রেনেসাঁর আদিগুরু ধর্ম চালু করেন কেমনে? আর সেই ধর্ম এখানে ইতিবাচক হয় কেমনে?
প্রগতিশীলদের এক প্রিয় ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী ছিলেন। কারণ তার দাদা দ্বারকানাথ রামমোহনের শুধু অনুসারী ছিলেন না, ১৮৩৩ সালে রামমোহন মারা গেলে তিনিই ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ ১৯১১-১৫ সময়কালে ব্রাহ্মসমাজের মুখপাত্র ‘তত্ত্ববোধিণী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

রামমোহন আসলে ভারতের সবাইকে ব্রাহ্মধর্মে নিয়ে গিয়ে এরপর সবাইকে নিয়ে এক ব্রাহ্মধর্মীয়-জাতিরাষ্ট্র গড়তে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বলেই এই ধর্ম চালু করেছিলেন। তবে তা সফল হয়নি। তবু প্রথম ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রগড়ার পরিকল্পনাকারী এই রামমোহন রায়। তা হলে ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগ গঠন এবং জিন্নাহকে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ার দায়ে অভিযোগ আনা কিভাবে সঠিক হয়? সর্বোপরি ১৮৮৫ সালে জন্ম নেয়া কংগ্রেস দল সেটা তো এই রামমোহন রায়ের উদ্যোগেরই শেষ পরিণতি।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

goutamdas1958@hotmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us