টাটার গোমর ফাঁস হলো এভাবে!

জি. মুনীর | Nov 22, 2020 07:58 pm
টাটা

টাটা - ছবি : সংগৃহীত

 

২২ নভেম্বর রোববার। এ দিন মুম্বাইয়ে সপ্তাহব্যাপী ‘টাটা লিটারেচার ফেস্টিভাল’ সমাপ্ত হয়েছে। শুরু হয়েছিল ১৬ নভেম্বর। এবারের এই উৎসব ছিল টাটার একাদশ সাহিত্য উৎসব। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে শেষ পর্যন্ত ওই উৎসব রূপ নেয় ভার্চুয়াল ফরম্যাটে। দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট লেখক-সাহিত্যিক, চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদদের এই উৎসবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ফাদার অব মডার্ন লিঙ্গুইস্টিকস হিসেবে বিবেচিত নোবেল বিজয়ী স্যার রজার পেনরোজ ও নোয়াম চমস্কিসহ আরো অনেকের এ উৎসবে যোগ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ লেখাটি আমাকে তৈরি করতে হয়েছে উৎসব চলাকালে। তাই শেষ পর্যন্ত কারা কারা এ উৎসবে যোগ দিতে পেরেছিলেন এবং এ উৎসবের সার্বিক ফলাফল কী ছিল, তা জানা সম্ভব হয়নি। এবারের উৎসবে প্রথম বই, বর্ষসেরা বই (সাহিত্য ও সাহিত্যবহির্ভূত) এবং বর্ষসেরা ব্যবসায়িক বই ইত্যাদি ক্ষেত্রে পুরস্কার দেয়া হয়। এ ছাড়া ‘সারা জীবনের কর্মসাধনার অর্জন পুরস্কার’ তথা ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’-ও দেয়া হয়।

এবারের এই উৎসব সম্পর্কে বিশেষ করে আমার জানার আগ্রহ ছিল- শেষ পর্যন্ত নোয়াম চমস্কি এতে সশরীরে কিংবা অনলাইনে যোগ দিয়েছেন কি না। কারণ এই উৎসব চলার সময় ১৯ নভেম্বরে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক খোলা চিঠির মাধ্যমে দেশটির প্রায় অর্ধশত বিশিষ্ট নাগরিক নোয়াম চমস্কির প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়েছিলেন, যেন তিনি তাদের ভাষায় ‘ভারতের অন্যতম নোটোরিয়াস করপোরেশন টাটা গ্রুপ’-এর এই বার্ষিক সাহিত্য উৎসবে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। ১৯ নভেম্বরে গণমাধ্যমে এই খোলা চিঠি প্রেস রিলিজ আকারে প্রকাশের আগে তা নোয়াম চমস্কির কাছে পাঠানো হয়েছিল কি না এবং শেষ পর্যন্ত ওই চিঠির প্রতি চমস্কি কী ধরনের সাড়া দিয়েছিলেন, তা জানা যায়নি। তবে এটি সত্য, ওই খোলা চিঠি এবারের টাটা আয়োজিত সাহিত্য উৎসবকে যেমন কিছুটা ম্লান করেছে, তেমনি টাটা করপোরেশনের ভাবমর্যাদাও ক্ষুণ্ন করেছে এবং আগামী দিনেও টাটার ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। উল্লেখ্য, এই চিঠিতে যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের মধ্যে সে দেশের অনেক স্বনামধন্য আইনজীবী, লেখক-সাহিত্যিক, অনুবাদক, ”লচ্চিত্র নির্মাতা, সক্রিয়বাদী, নাট্যকর্মী, রাজনীতিবিদ, সচেতন নাগরিক এবং বিভিন্ন পেশা ও ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা রয়েছেন।

ওই খোলা চিঠির শুরুটা ছিল এমন, “প্রিয় অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি। আশা করি, এই সমস্যাসঙ্কুল সময়েও পরিবারের অন্যদের নিয়ে শারীরিকভাবে ভালো ও নিরাপদে আছেন। আমরা এইমাত্র জানলাম, ‘ভারতের অন্যতম নোটোরিয়াস করপোরেশন টাটা গ্রুপের এবারের লিটারেচার ফেস্টিভালে আপনার যোগদানের কথা রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটেই আপনাকে লিখছি। বিষয়টি আমাদের মধ্যে এক নিরতিশয় হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এই টাটা গোষ্ঠীর আছে ও ছিল জোরজবরদস্তি করে বাস্তুচ্যুত করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন করা ও পরিবেশ বিনাশের সুদীর্ঘ ইতিহাস। এই সাহিত্য উৎসব ও এ ধরনের অন্যান্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে টাটা গোষ্ঠী দৃশ্যত জনমন থেকে এর অপরাধ দূরীভূত করার প্রয়াস চালায়। এটি তাদের একধরনের ‘আইডিওলজিক্যাল হোয়াইট ওয়াশিং’।”

চিঠিতে তারা টাটার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরে উল্লেখ করেন, “২০০৫ সালে ‘টাটা স্টিল’ উড়িষ্যার কলিঙ্গ নগরে আদিবাসীদের কোনোরকম সম্মতি ও বৈধ অনুমোদন ছাড়া তাদের জমি জোর করে দখলে নিয়ে ইস্পাত কারখানা নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়। আদিবাসী সমাজের প্রবল প্রতিরোধের মুখে ২০০৬ সালের ২ জানুয়ারি ‘টাটা স্টিল’ পুলিশের সহায়তায় করাখানার নির্মাণকাজ শুরুর পদক্ষেপ নেয়। আদিবাসীরা বাধা দিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ১৪ জনকে হত্যা করে। এ ছাড়া মারাত্মক আহত হয় কমপক্ষে আরো শতাধিক লোক। সুশীলসমাজের তদন্তে জানা যায়, টাটা ও পুলিশ বাহিনী এ হামলায় ল্যান্ডমাইনও ব্যবহার করে। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়ে পুলিশ, আধা-সামরিক বাহিনী ও টাটাভিত্তিক মিলিশিয়ারা ওই অঞ্চলে ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়। এর ফলে আরো অনেক লোকের মৃত্যু ঘটে। চলে নির্যাতন, কারারোধ, যৌন সন্ত্রাস, আর্থসামাজিক ও চিকিৎসাসেবা বন্ধ রাখার মতো ঘটনা। এ কোম্পানি তার ইস্পাত কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা দখলে নেয়ার আগে পর্যন্ত এ ধরনের কর্মকাণ্ড চলে। এমনকি এই নিপীড়নের হাত থেকে শিশুরাও অব্যাহতি পায়নি। কলিঙ্গ নগরের ১২ বছর বয়সী এক আদিবাসী বালিকাকে প্যারামিলিটারি বাহিনীর লোকেরা হত্যা করে ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। ওই হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিতে বলা হয়, ওই বালিকা ছিল ‘বিদ্রোহী মাওবাদীদের কর্মী’।”

ওই চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, “কলিঙ্গ নগরের কাছাকাছি সুকিন্দা উপত্যকায় রয়েছে টাটার ক্রোমাইট খনি। সেখানে ক্রোমিয়াম হেক্সাভ্যালেন্টের দূষণ খুবই ব্যাপক। ২০০৭ সালে ‘ব্ল্যাকস্মিথ ইনস্টিটিউট’ এক রিপোর্টে জানায়, সুকিন্দা হচ্ছে বিশ্বের চতুর্থ ভয়াবহ দূষণ এলাকা। আদিবাসীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এর পরও টাটা সেখানে ওপেন কাস্ট মাইনিং অব্যাহত রাখে। এ ছাড়া চলতি বছরের প্রথম দিকে খনির কাজ চালানোর জন্য এর লিজের মেয়াদ আরো ৫০ বছর বাড়ানো হয়েছে। উড়িষ্যা ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যে টাটার উপস্থিতি দেড়শ’ বছরের পুরনো। সেই দেড়শ’ বছর আগে থেকেই টাটা তাদের কারখানা স্থাপন ও খনি খননের জন্য আদিবাসীদেরকে তাদের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করতে থাকে। উড়িষ্যার চিলিকায় মাছ ধরা ব্যবসায়কে একচেটিয়া ব্যবসায়ে পরিণত করার পদক্ষেপ নেয় টাটা। এর ফলে টাটা সেখানকার দলিত মৎস্যজীবী সমাজের ওপর ব্যাপক অত্যাচার চালায়। উড়িষ্যার ছত্রপুরে দলিত কৃষকদের হত্যা করা হয় প্রস্তাবিত ইস্পাত কারখানার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর কারণে।”

নোয়াম চমস্কিকে চিঠিতে আরো জানানো হয়, ‘কলিঙ্গ নগরে টাটা ইস্পাত কারখানা স্থাপনের জন্য ২০০৬ সালে পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের বছরেই এই কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরে একটি গাড়ি কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। ওই কারখানার প্রস্তাবিত স্থানটি ছিল একটি বহুফসলি কৃষিজমি এলাকায়। এর জমিগুলো একটি বড় দলিত গোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার উৎসস্থল হিসেবে কাজ করে। সিপিএম নেতৃত্বাধীন তৎকালীন রাজ্য সরকারের পুলিশ তখন কৃষকদের ওপর ব্যাপক পুলিশি নির্যাতন চালিয়ে জোর করে ওই স্থান দখলে নেয়। পুলিশ বাহিনী ও শাসকদলের ক্যাডার বাহিনী সন্ত্রাস চালিয়ে শত শত লোককে আহত করে। প্রতিরোধ আন্দোলনের এক প্রতিবাদী তরুণী ধর্ষিত ও একজন যুবনেতা পুড়ে মরার শিকার হন টাটা-সমর্থক সিপিএম ক্যাডারদের হাতে।’

নোয়াম চমস্কিকে আরো জানানো হয়, ‘ছত্তিশগড়ের বস্তারে টাটার আরেকটি প্রস্তাবিত ইস্পাত কারখানা স্থাপনের কথা রয়েছে। সেখানেও রয়েছে আদিবাসীদের প্রবল প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। ওই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দমনে কাজে লাগানো হয়েছে সালওয়া জুডুম (Salwa Judum) নামে প্রাইভেট মিলিশিয়াদের। ওই বাহিনী টাটার পৃষ্ঠপোষকতায় লালিত বলেই পরিচিত। ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টির ক্যাডারদের সমন্বয়ে গঠিত সালওয়া জুডুম কাজ করে টাটার স্বার্থরক্ষায়। ভিন্ন মতাবলম্বী আদিবাসীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত তাদের অভিযানে হাজার হাজার গ্রামের অসংখ্য আদিবাসী লোক হত্যা ও ধর্ষণের শিকার হয় এবং এর ফলে শেষ পর্যন্ত পথ খুলে যায় ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’-এর। এটি ছিল ভারত সরকারের আধা-সরকারি বাহিনী পরিচালিত প্রতিবাদী আদিবাসীদের উচ্ছেদের এক অপারেশন। উড়িষ্যা, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যের খনিজসম্পদসমৃদ্ধ জেলাগুলোতে এক লাখেরও বেশি প্যারামিলিটারি সেনা মোতায়েন করে ভারত সরকার তার নিজ আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক গোপন যুদ্ধের সূচনা করে। ওই পরিকল্পিত সুসংগঠিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস আজ পর্যন্ত সেখানে অব্যাহত রয়েছে এবং ওই যুদ্ধের চূড়ান্ত আর্থসামাজিক বিচ্ছিন্নতা আগামী কয়েক দশকও চলবে।”

ওই চিঠিতে দেয়া তথ্যমতে, “টাটা গ্রুপের রয়েছে দুই শতাধিক ব্র্যান্ড। এর মধ্যে রয়েছে, ইস্পাত, তাপবিদ্যুৎ, পানিবিদ্যুৎ, সামরিক যান, প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা ইত্যাদি। স্পষ্টতই এটি কাশ্মির দ্বন্দ্বসূত্রে ভারতের সবচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জনকারী করপোরেশন। রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনগুলোর বড় বড় পৃষ্ঠপোষক দাতাদের মধ্যে টাটা অন্যতম। এর মাধ্যমে টাটা এর ব্যবসায় সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার বিষয়টি নিশ্চিত করে। ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির নির্বাচনী তহবিলের ৭৫ শতাংশের জোগান দিয়েছে টাটা। একই সাথে কংগ্রেস পার্টির বৃহত্তম দাতা হওয়ার বাজিতেও বিজয়ী হয়েছে এই টাটা। এর মাধ্যমে টাটা নিশ্চিত করে যে, ক্ষমতায় যে দলই আসুক, তা টাটার স্বার্থরক্ষা করবে।”

টাটার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের কথা নোয়াম চমস্কিকে জানানোর পর ওই চিঠিতে তার উদ্দেশে উল্লেখ করা হয়, ‘আমরা স্পষ্ট করে জানাতে চাই, আমরা আপনাকে কোনো অ্যাকাডেমিক বয়কটের আহ্বান জানাচ্ছি না। টাটা করপোরেশনের প্ল্যাটফর্ম বয়কটের বিষয়টি মৌলিকভাবে পাবলিক/ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউশনকে- যেমন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়কে বয়কট করা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, যেমনটি আপনি উল্লেখ করেছেন আপনার বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে। ইসরাইলবিরোধী ‘বয়কট-ডিভেসটমেন্ট ক্যাম্পেইন’ সম্পর্কে কথা বলার সময় আপনি স্পষ্টতই বর্ণনা করেছেন, ইসরাইলের দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে বহুজাতিক করপোরেশনগুলো কাজ করছে ‘ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন’ হিসেবে এবং সেই সাথে আপনি বলেছেন আমেরিকান, ফরাসি, ব্রিটিশ করপোরেশনগুলোর বিরুদ্ধে পাবলিক বয়কটের পক্ষে। আমরা আহ্বান জানাই, আপনি টাটাকে সে আলোকেই এ ধরনের একটি করপোরেশন হিসেবে বিবেচনা করবেন। আজকের দিনে টাটাকে আমেরিকান অথবা ফরাসি করপোরেশনের বিপরীতে একটি ‘ভারতীয় করপোরেশন’ হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে একটি যৌক্তিক সমস্যা রয়েছে। কারণ টাটা গ্রুপ অন্যান্য বড় বড় বিশ্ব করপোরেশনের মতো একটি মাল্টি ন্যাশনাল করপোরেশন। এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য একটি মাত্র কৌশলী প্রশ্ন তোলা হতে পারে, ‘টাটার মতো একটি করপোরেশনকে বয়কট করা হলে, তা কি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা সমাজের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে?’

কিন্তু পরিসংখ্যান উপাত্তের দিকে একটু নজর দিলে, আপনিও বুঝতে পারবেন- ভারতে এখনো ৮১ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। সে ক্ষেত্রে ভারতের গরিব জনগোষ্ঠী টাটার মতো করপোরেশনের কাছ থেকে কিছু অর্জন অতীতেও করেনি এবং আজকেও অর্জনের মতো তেমন কিছু নেই। আসলে পরিস্থিতিটা এর পুরোপুরি উল্টো।

চিঠির শেষ দিকে উল্লেখ করা হয়, “টাটা এমন একটি করপোরেশন, যার বয়স ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের চেয়েও বেশি। এর সূচনা উপনিবেশ যুগের আফিম বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে। তখনই এটি আয়ত্ত করেছে, কী করে কিছু হিতকর্ম ও সমাজকল্যাণমূলক কাজের মধ্য দিয়ে জনমনে নিজেদের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করে তোলা যায়। বড় বড় করপোরেশন জনমত নিজের পক্ষে নেয়ার প্রয়াসে এই একই ধরনের উদাহরণ অবলম্বন করে। টাটা চালু করেছে বেশ কয়েকটি দাতব্য ট্রাস্ট। এটি ডোনেশন দেয় বেশ কিছু এনজিও ও অ্যাকাডেমিয়াকে। এর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়, যাতে এর সংঘটিত অপরাধকর্ম নিয়ে জনবিতর্ক ছড়িয়ে না পড়ে। ‘টাটা লিটারেচার ফেস্টিভাল’-এর অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় বিশ্বস্ত বুদ্ধিজীবী, সক্রিয়বাদী ও লেখকদের অনুসমর্থন আদায় ও সেই সাথে নেতিবাচক প্রচার ঠেকানোর লক্ষ্যে। আপনি এবং আরো কয়েকজন আমেরিকান বুদ্ধিজীবী বরাবর সোচ্চার বড় বড় করপোরেশনের ভূমিকার বিরুদ্ধে, যারা ক্ষতিসাধন করছে পরিবেশ ও গণতন্ত্রের। উদাহরণত- যা এখন চলছে ‘ডাকোটা অ্যাক্সেস পাইপলাইন’-এর ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে জোর করে পাইপলাইন নেয়া হচ্ছে আমেরিকান-ইন্ডিয়ান ভূখণ্ডের ভেতর দিয়ে।

সেখানে যা চলছে তা টাটার ক্ষেত্রের সাথে নৈতিকভার দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই, যখন আদিবাসী অঞ্চলে ধ্বংসাত্মক শিল্প প্রকল্পগুলো বিবেচনায় আনা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান যত সংখ্যক মানুষ হত্যা এবং আহত ও পঙ্গু করে যে পরিমাণ ধ্বংসাত্মক ক্ষতিসাধন করেছে, তা বিবেচনায় নিলে তার পরিমাণ আমেরিকার অভ্যন্তরীণ আইনি কাঠামোয় অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হবে। সে কারণেই আমরা আপনার কাছে আর্জি জানাচ্ছি, ভারতের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে টাটার অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হবেন না এবং আমরা আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, এর পরিবর্তে গণতন্ত্র ও পরিবেশ বিনাশে ভারতীয় করপোরেশনের ভূমিকা নিয়ে একটি আলাদা স্বাধীন বা পাবলিক প্ল্যাটফর্মে কথা বলার জন্য। আপনি যদি মনে করেন, টাটার সাহিত্য উৎসবে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানানো, আপনার লড়াকু জীবনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, তবে আপনার কাছে আমাদের আরো আর্জি হচ্ছে, এ বিষয়টি নির্দেশ করে একটি ‘জনবিবৃতি’ প্রকাশ করুন।

আমরা মনে করি, এ ব্যাপারে আপনার মতো একজন ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে একটি বিবৃতি টাটার মতো ক্রিমিনাল করপোরেশনের বিরুদ্ধে দলিত ও আদিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদারে অনেক পথ এগিয়ে যাবে। আমাদের বিশ্বাস, এ ধরনের একটি বিবৃতির প্রভাব অধ্যাপক বিজয় প্রসাদের সাথে আপনার পরিকল্পিত কথোপকথনের প্রভাবের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব আমরা অর্জন করতে পারব (যেখানে আমরা নিশ্চিত, আপনার পরিকল্পনা হচ্ছে অন্য সব কিছুর মাঝে বড় বড় করপোরেশনের সমালোচনা করা)। আমাদের কথা শোনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ এবং আমরা আগ্রহের সাথে জানার জন্য অপেক্ষা করছি, আমাদের উত্থাপিত উদ্বেগ নিয়ে আপনি কী ভাবছেন। আপনার জন্য রইল সর্বোত্তম শুভ কামনা।”

এভাবেই শেষ করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ওই চিঠিটি। ওই চিঠি পড়ে প্রতি নোয়াম চমস্কি কী ধরনের সাড়া দিয়েছেন তা জানার জন্য পাঠকদের মনে একধরনের আগ্রহ সৃষ্টি হবে, সেটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য হাতে না পাওয়ায় পাঠকপ্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতার দায় নিয়েই এই লেখায় ইতি টানতে বাধ্য হচ্ছি। তবে টাটার নানা কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ন্যূনতম খবরাখবর যারা রাখেন, তারা নিশ্চয় স্বীকার করবেন, আলোচ্য চিঠিতে টাটার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগগুলো অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তাই চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা এটি প্রকাশের মাধ্যমে অভিযোগগুলো উত্থাপনের যে সাহস দেখিয়েছেন সে জন্য তাদের প্রতি জানাই অমিত শ্রদ্ধা। কারণ, ওই চিঠির প্রতি নোয়াম চমস্কির সাড়া যে মাত্রারই হোক, ওই চিঠি শুধু টাটা নয় বিশ্বের বড় বড় করপোরেশনের স্বরূপ উন্মোচনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us