কার দায় অনুশকা-দিহানরা?

ফ্লোরা সরকার | Jan 21, 2021 03:41 pm
অনুশকা-দিহান

অনুশকা-দিহান - ছবি সংগৃহীত

 

মহাভারতে দুষ্টু প্রকৃতির প্রজা পীড়নকারী রাজা কংসের গল্পটা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। নিজের বাবা রাজা উগ্রসেনকে বন্দি করে কংস মথুরার রাজা হন। এ সময় কংসের বোন দেবকীর সঙ্গে বসুদেবের বিয়ে হয়। বিয়ের সময় কংস দৈববাণী শুনতে পান যে দেবকীর অষ্টম সন্তান তাকে বধ করবে। কংস তখন দেবকী ও বসুদেবকে কারারুদ্ধ করেন। কারাগারে ছয়টা সন্তান হলে, সবাইকে কংস মেরে ফেলে। সপ্তম সন্তান শ্রীবলরাম, দেবকীর গর্ভ থেকে প্রতিস্থাপিত হন গোকুলবাসী বসুদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী রোহিণী দেবীর গর্ভে।

সেখানেই ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা অষ্টম তিথির মধ‍্যরাতে জন্ম হয় কৃষ্ণ নামে অষ্টম পুত্রের। বংশ রক্ষার জন‍্যে কৃষ্ণকে গোকুলে গোপরাজ নন্দের ঘরে গোপনে রেখে আসেন বসুদেব। একই রাতে গোপরাজ নন্দের ঘরে জন্ম নেয় তার কন‍্যা দেবী মহাশক্তিরূপে যোগমায়া। নন্দের স্ত্রী যশোদার কাছে কৃষ্ণকে রেখে, ওই রাতে যোগমায়াকে মথুরায় নিয়ে আসেন বসুদেব। কংস তখন যোগমায়াকে পাথরে নিক্ষেপ করে হত‍্যা করতে আদেশ দেন, কিন্তু যোগমায়া নিক্ষিপ্ত অবস্থায় আকাশে উঠে যেয়ে বলেন, তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে। তারপর গোকুলে বেড়ে ওঠা সেই কৃষ্ণ বড় হলে, শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণের হাতেই কংসের মৃত্যু ঘটে।

গল্পটা আমাদের বর্তমান প্রজন্মের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বলা হলো। নারীবাদ, প্রগতিশীলবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ইত‍্যাদি কিছু শব্দের বর্গ দিয়ে যে হারে কয়েক দশক ধরে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে, ওই জনগণই গোকূলে বেড়ে বড় হয়ে খোদ সেক্যুলার, প্রগতিশীল ইত্যাদিকে এখন বধ করতে নেমেছে।
আমরা নিশ্চয়ই শাহবাগ আন্দোলনের সেই উচ্ছৃঙ্খল দিনগুলোর কথা ভুলে গেছি। ফাঁসির দাবির নামে গোটা দেশকে কীভাবে উশৃঙ্খলতার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছিল! ওই সময়ের শিশু-কিশোররা এখন তরুণ-তরুণী হয়েছে। তারা জ্ঞানবুদ্ধি হবার পরেই দেখেছে এবং বুঝেছে কিছু লোককে ফাঁসি দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। চোখের সামনে তাদের উচ্ছৃঙ্খল বাবা-মা'র তাণ্ডব দেখেছে দিনের পর দিন। শিখেছে কীভাবে বেয়াদব হতে হয়। সেই শিশুরা শিখেছে তসলিমা নাসরিন কথিত যৌন স্বাধীনতাই আসল স্বাধীনতা, এর বাইরে আর কোনো স্বাধীনতা নেই। পুরষদের পোশাক পরলেই নারী তার স্বাধীনতা পেয়ে যায় ( আবার এই পুরুষকেই কিন্তু তসলিমা ঘৃণা করতে শিখিয়েছেন, কী আইরনি )। কারণ তারা তাদের বাবা-মা'র কাছে এসব শিখেই বড় হয়েছে। জেনেছে নাস্তিকতার কারণে হুমায়ুন আজাদসহ কতগুলো ব্লগারদের কীভাবে আঘাত এবং খুন করা হয়েছে। সেক্যুলারিজমের মোড়কে নাস্তিকতাই (প্রকৃতপক্ষে ইসলামবিদ্বেষ ) মানব ধর্ম জেনেছে। সাথে আরো শিখেছে তাদের মধ‍্যবয়সী অথবা তরুণ বাবা-মার কাছে, ইসলাম ধর্মের মতো নিকৃষ্ট ধর্ম এই দুনিয়ায় আর নেই। প্রগতিশীল হবার মূলসূত্র হিসাবে জেনেছে, যা খুশি তাই করে বেড়ানো। যার সাথে খুশি তার সাথে ঘুরে বেড়ানো। এই কারণেই উন্মুক্ত স্থানে কোনো তরুণী সিগারেট খেতে এখন দ্বিধাবোধ করে না। মানুষের তাড়া খেয়ে সেই তরুণী ফেসবুকে যারা তাড়া করেছিল তাদের একজনকে আবার খুব করে শাসিয়ে দেয়। রবি তাদের সরবরাহ করা সাকিব, আইমানদের দিয়ে ১০ মিনিটের স্কুলের বিজ্ঞাপনে শেখায় 'তোমার রাতে স্লিপ ওভার করতে পারা উচিত' অথবা 'বাবা-মায়ের তোমাদের জীবনে ইন্টারফেয়ার করা উচিৎ না' ইত্যাদি। জাফর ইকবাল তার উপন‍্যাস-গল্পে মা-বাবাদের ভুল দেখিয়ে মা-বাবাদের প্রতি বেয়াদব হতে শিক্ষা দেন। ফেসবুকের মতো যথেচ্ছ একটা মিনি মিডিয়া পেয়ে ইচ্ছেমতো উন্মুক্ত ছবি দেয়া কোনো বিষয়ই না বর্তমান প্রজন্মের কাছে। কেউ কেউ আবার বিদেশে বসে, লেসবিয়ান নারীকে চুমু খাওয়ার দৃশ্য যেমন পোস্ট করে, ওই একই নারী আবার বহুগামিরত দৃশ‍্যের ছবিও অবলীলায় ছেপে দেন। সত‍্যি সেলুকাস, ফেসবুক আমাদের বড্ড বেশি ছ্যাঁচড়া করে দিয়েছে! এসব করার পেছনে তাদের আছে নারীবাদ, প্রগতিশীল ও সেকুলার নামের মহান আদর্শ আর শক্তি। এসব আদর্শ বর্তমান প্রজন্মকে এতটাই মোহাবিষ্ট করেছে যে ফেসবুকের উন্মুক্ত ময়দানে ষোড়শী বা অষ্টাদশী কোনো মেয়ে নিজের বাবাকে 'শুয়োরের বাচ্চা' বলে গালিগালাজ করতেও দ্বিধাবোধ করে না। বাবার দোষটা কি? বাবার দোষ হলো, কন‍্যার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করা। সুকন‍্যা তার ফেসবুক দেয়ালে কীসব আবলতাবল লেখা লিখে, সেক্স নিয়ে লেখালেখি করে, এসব খুঁজে খুঁজে বের করে সেই নিষ্ঠুর বাবা। এটাই সেক্যুলার আদর্শে গড়ে ওঠা বাবার দোষ।

এবার কিন্তু কংস রাজারা ঠিক ঠিক ধরা খেয়েছে কৃষ্ণদের কাছে। কারণ কৃষ্ণদের এই বাবারাই তাদের সন্তানদের নারীবাদ, প্রগতিশীল, সেক্যুলার, শাহবাগ ইত্যাদি নামের গোকূলে বড় করেছিল। সময় কিন্তু তার প্রতিশোধ ঠিক ঠিক নিয়ে নেয়। প্রগতিশীলদের সন্তানেরা ঠিক তাদের মতোই প্রগতি মাথায় নিয়ে বড় হয়েছিল এবং হচ্ছে। শুধু সর্ষের মধ‍্যেই যে ভূতটা ছিল, সেটা এই প্রগতিশীল বাবামায়েরা দেখতে পাননি। প্রগতিশীল, সেকুলারিজম আর নারীবাদের রঙিন চশমাটা বয়োবৃদ্ধির সাথে এসব বাবা-মায়ের চোখ থেকে যতই খসে পড়তে শুরু করেছে, ততই তাদের চোখ খুলছে। কিন্তু সময় গেলে যে সাধন হয় না- এই খবরটা তাদের জানাই ছিল না। তাই আনুশকার মতো মেয়েরা আজ অসহায়ের মতো মারা যায়। বাবাদের 'শূয়োরের বাচ্চা'র মতো গালি শুনতে হয়। মাকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলে। কিন্তু এই মা-বাবারাই কি এই অষ্টাদশীদের বড় করেনি? যেভাবে তারা বীজ রোপণ করেছিল সেই বীজ থেকে বেড়ে ওঠা বিষাক্ত ফল এখন তাদের ভোগ করতেই হবে। সময় কাউকে ক্ষমা করে না।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মী


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us