বাইডেনের কাছে আহমেদ রব্বানির করুণ চিঠি

আহমেদ রব্বানী | Feb 09, 2021 03:37 pm
আহমেদ রব্বানি

আহমেদ রব্বানি - ছবি সংগৃহীত

 

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন হলেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি তার নিজের জীবনে অনেক বেদনাদায়ক ঘটনা সহ্য করেছেন। ১৯৭২ সালের দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী এবং মেয়ে নিহত হয়। এরপর তার ছেলে বিউ মারা যায় ব্রেন টিউমারে। বাইডেন অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন। আমার আশা তিনি আমার কষ্ট বুঝতে পারবেন। গত ২০ বছর ধরে আমার জীবন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে এবং তা এখনো চলছে। আর সবচেয়ে খারাপ যেটি তা হলো আমার পরিবারও এ ফাঁদে আটকা পড়ে আছে।

আমি আমার এ কথা লিখছি গুয়ানতানামো বে কারগারে বসে। আমি কেবল আশা করতে পারি প্রেসিডেন্ট বাইডেন আমার পরিস্থিতির জন্য কিছু সমবেদনা খুঁজে পাবেন। একইভাবে অন্য বন্দীদের বিষয়ে তিনি সমবেদনা খুঁজে পাবেন যারা আমার মতো এই ভয়ঙ্কর কারাগারে বন্দী হয়ে আছেন অনির্দিষ্টকালের জন্য।
২০০২ সালে আমাকে করাচি থেকে অপহরণ করা হয়। এরপর সিআইএ’র কাছে বিক্রি করা হয় পুরস্কারের আশায়। এ জন্য মিথ্যা গল্প সাজিয়ে আমাকে বানানো হয় সন্ত্রাসী হাসান গুল। আমার স্ত্রী তখন গর্ভবতী। আমাকে সে এ খুশির খবর জানানোর পরপরই আমার জীবনে নেমে আসে এ করুণ পরিণতির অধ্যায়। কয়েক মাস পর আমার সন্তানের জন্ম হলো- যার নাম জাওয়াদ। আজ অবধি আমি আমার সন্তানের মুখ দেখার সুযোগ পাইনি। আমার ছেলের বয়স এখন ১৮ বছর। আমি আজ অবধি তার কোনো উপকারে আসতে পারিনি। তার পুরো শৈশব-কৈশোরকাল ধরে আমি এখানে বন্দী কোনো অভিযোগ আর বিচার ছাড়া।
প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রায়ই পারিবারিক গুরুত্বের কথা বলে থাকেন। নিজের সন্তানকে কখনো স্পর্শ করতে না পারার বিষয়টি তিনি কি ভাবতে পারেন?

গুয়ানতানামো বে ভয়ঙ্কর কারাগারে আমার যে বন্দী জীবন সেই সময়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন পূর্ণ মেয়াদ পার করেছেন একজন সিনেটর হিসেবে, আট বছর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। এরপর তিনি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবং তিনি জয়ী হয়ে এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। পূর্ণ হয়েছে তার জীবনের আকাক্সক্ষা।
আমি হয়তো এ সময়ে এরকম কিছু হতে পারতাম না। তবে আমি প্রশ্ন না করে পারছি না যে, আমার জীবন থেকে যদি এতগুলো বছর চুরি না করা হতো তাহলে আমি কী করতে পারতাম।

২০০৯ সালে বাইডেন ওবামার পাশে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন। ওবামা প্রশাসন অঙ্গীকার করেছিল গুয়ানতানামো বে বন্ধ করে দেয়ার। ওই সপ্তাহে একটি নির্বাহী আদেশ জারি হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, সঠিক প্রক্রিয়া ফিরিয়ে আনা হবে। প্রতিষ্ঠা করা হবে সংবিধানের মৌলিক মূল্যবোধ যা আমেরিকাকে মহান করেছে এমনকি যুদ্ধের মধ্যেও। হোয়াইট হাউজে দায়িত্ব গ্রহণের দুই দিনের মধ্যে ওবামা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন গুয়ানতানামো বে চীরতরে বন্ধ করে দেয়ার।

কংগ্রেসের বাধার মুখে ওবামার সে ব্যর্থতার বিচার করা আমার কাজ নয়। আর আমি এ পরামর্শও দিতে চাই না যে, গুয়ানতানামো বে বন্ধ করে দেয়া এখন সহজ হবে। কিন্তু একটি বিষয় আমার মনে আশার সঞ্চার করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব আবার এমন একজন প্রেসিডেন্টের হাতে এসেছে যিনি ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসনে বিশ্বাসী।

সিআইএ টর্চার বিষয়ে ২০১৪ সালের সিনেট ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট তার তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়েছিল। ওই রিপোর্টে আমার ওপর নির্যাতনের কথা উল্লেখ ছিল। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে- আফগানিস্তানের একটি অন্ধকার কারাগারে আমার ওপর ৫৪০ দিন নির্যাতন করা হয়েছে । নির্যাতনের সেই দিনগুলোর সংখ্যা আমি গুনে রাখতে পারতাম না। দিন-রাত আমাকে ঝুলিয়ে রাখা হতো একটি অন্ধকার গর্তের মধ্যে। আর এতে আমার কাধ স্থানচ্যুত হয়ে গেছে। কাধের যন্ত্রণা আর ঝুলিয়ে রাখা গর্তের অন্ধকারের কারণে আমার দিন ও রাত এক হয়ে গিয়েছিল। আমার ওপর যখন এ নির্যাতন চলে তখন পাশের রুম থেকে ভেসে আসে এক নারীর আর্তনাদ। আর আমাকে বলা হয়- ওটা হলো তোমার স্ত্রীর আর্তনাদ। যেভাবে বলা হয় সেভাবে যদি কাজ না কর তাহলে তাকে ধর্ষণ করা হবে অথবা মেরে ফেলা হবে। আমার সন্দেহ, প্রেসিডেন্ট বাইডেন বুঝতে পারবেন এ অত্যাচার কেমন।

প্রতিশোধ গ্রহণের কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমি শুধু লোকজনকে জানাতে চাই, আমার ওপর কী ঘটেছে এবং কিভাবে তা কার্পেটের নিচে ঝাড়ু দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। যাতে আমাদের অবস্থান বাইডেনের আগের প্রেসিডেন্টদের সময়কালের মতো না হয়। যাতে আমেরিকার ইতিহাস থেকে নির্যাতনের দাগ বের করা যায়। যাতে বাইডেন এবং তার প্রশাসন বালিতে মাখা ঢুকিয়ে না দেখার ভান করতে পারে বা বলতে না পারে এটা ঘটেনি।

আমাকে এখানে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ১৩ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার খরচ করছে। আমাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে তাদের এ খরচ বেঁচে যেত।

আমি করাচির একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। ভুল পরিচয় সন্দেহে আমাকে ধরে আনা হয়েছে। এমনকি সিআইএ আসল হাসন গুলকে গ্রেফতারও করেছে। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদের পর তাকে ছেড়ে দিয়েছে। আর আমাকে বন্দী করে রেখেছে। সম্ভবত তারা তাদের ভুল স্বীকার করতে চাচ্ছে না। সে কারণে আমার এ পরিণতি।

বাইডেন এখন হোয়াইট হাউজে উঠেছেন এবং সেখানে তিনি সুন্দর জীবন যাপন করবেন। অংশ নেবেন অভিনব ভোজসভায়। কিন্তু আমি সাত বছর ধরে অনশন ধর্মঘট করছি আমার ওপর ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদে। করাচিতে আমাকে যখন আটক করা হয় তার তুলনায় আমার ওজন এখন অর্ধেক। আর এখন আমার যে পরিস্থিতি এবং যেভাবে আমাকে জোর করে খাওয়ানো হয় তাতে একদিন আমি আমার সেলে মারা যাবো।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কিছু করার ক্ষমতা রয়েছে। আমার ওপর যে নির্যাতন হয়েছে তার আমি বিচার চাই। আমি কফিনে অথবা বডি ব্যাগে বাড়ি যেতে চাই না। আমি বাড়ি যেতে চাই। আমি আমার ছেলেকে স্পর্শ করতে চাই।

আহমেদ রব্বানি, গুয়ানতানামো আইএসএন ১৪৬১।

[গুয়ানতানামো বে কারাগারে বন্দী আহমেদ রব্বানির এ চিঠি প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্যের ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকায় ২২ জানুয়ারি। ইন্ডিপেন্ডেন্টকে এ চিঠি সরবরাহ করেছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা রিপ্রিভ । রিপ্রিভ আন্তর্জাতিক আইনজীবী ও তদন্তকারীদের নিয়ে গঠিত একটি সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং নেদারল্যান্ডেও এর শাখা রয়েছে। ]

ভাষান্তর : মেহেদী হাসান


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us