ফয়সালের বিয়ে

কামরুন নাহার মিশু | Feb 10, 2021 12:49 pm
প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি - ছবি সংগৃহীত

 

ফয়সালের মা কল দিয়েছে মাস দুয়েক আগে আমার শাশুড়ি মায়ের কাছে।
'খালাম্মা ফসলের সামনের দুই মাসের বেতন দিয়েন্না। আন্নের কাছে জমাই রাইখেন।'
ফয়সাল আমার শ্বশুর বাড়ির কেয়ারটেকার। বয়স দেখলে মনে হয় ১৮/২০। ওর দাদির হিসাবে ২৩। ওর দাদিও আমাদের বাড়িতে কাজ করেন।
'কেন ফয়সালের মা। টাকা কেন দেব না।'

'খালাম্মা দুই মাস পর ওই টাকা এক লগে আঁরে দিয়েন।'
'আচ্ছা অসুবিধা নেই। নিও আর কী! কেন? গরু কিনবে না-কি?'
'না খালাম্মা। গরু আছে চাইরগা। ফসলরে বিয়া করামু।'

ফয়সালের মায়ের এমন কথা শুনে আম্মা চমকে গেলেন।

'কী বলছ তুমি? ফয়সালরে কিসের বিয়ে করাবা?'
'হ খালাম্মা। মাইয়া আঁর বাইজি।'
'মেয়ে কে, সেটা বড় কথা না। ওর বেতন হইছে সাত হাজার টাকা। দুই মাসে চৌদ্দ হাজার হবে। চৌদ্দ হাজার টাকা দিয়ে ওকে কী বিয়ে করাবে?'

'অসুবিধা নাই খালাম্মা। চৌইদ্দ আজার মেলা টিয়া। বিয়াতে এত টিঁয়াও লাইগদ নয়।'

আম্মা ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললেন-

'এখন থেকে ফয়সালের টাকা তোমার কাছেই পাঠাব। দুলালকে দেব না ( দুলাল ফয়সালের বাবার নাম)। অহেতুক অল্প বয়সী ছেলের মাথায় বিয়ের ভূত উঠাবে না। কাজ করছে মাত্র মাস ছয়েক। ঠিকমতো কথা পর্যন্ত বলতে জানে না। আবার বিয়ে!'

লাইন কেটে দিয়ে আম্মা একা একা বিড়বিড় করছেন, 'অশিক্ষিত, মূর্খ, পাগল, ছাগল।'

আমার শাশুড়ি ভীষণ শান্ত স্বভাবের নির্বিকার মানুষ। কখনো কারো সাথে রাগ করে কথা বলেন না। কোনো কিছুতে মেজাজ খারাপ করেন না। যেকোনো কঠিন সমস্যাও তিনি হাসিমুখে সমাধান করেন।
আমার মেজো জা আম্মার অচেনা মূর্তি দেখে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলেন-

'কী হয়েছে আম্মা?'
'আরে বলিও না। মানুষ অশিক্ষিত হলে যা হয় আর কী? ফয়সালের বয়স আর কতই বা হবে! আমাদের সামির বয়সী হয়তো।'
'না আম্মা! সামির চেয়ে একটু বড় হবে।' (মেজো জা তার বাচ্চাদের বয়স ও সৌন্দর্যের সাথে কারো বাচ্চার তুলনা করা একদম পছন্দ করেন না।)

'যাই হোক। বয়স তো আর ত্রিশ হয়নি। কী সুন্দর একটা ছেলে কাজকর্ম শিখছে। ওর মায়ের সহ্য হচ্ছে না। বিয়ে করিয়ে দেবে।'

ফয়সালের বিয়ের কথা শুনে আমরা হাসতে হাসতে শেষ। বাচ্চা একটা ছেলে, এখনো ঠিকমতো দাঁড়ি গোঁফ গজায়নি। ওর এখন বিয়ে!
ওই দিন কিছুক্ষণ মজা করার পর বিষয়টা আমরা ভুলেই গেছি। আসলে ব্যাপারটা যে এত সিরিয়াস আমরা ভাবতে পারিনি।
আজ সকালে ফয়সালের মা এসে উপস্থিত। ফয়সালের দুই মাসের বেতনের টাকাসহ সে ফয়সালকে নিতে এসেছে। আগামী শুক্রবার বাদ জুমা ফয়সালের বিয়ে। কনে তার মামাতো বোন।
ওদের ছেলে ওরা বিয়ে করাবে, তাতে আমাদের কী বলার আছে! তারপরও মাথা ঠাণ্ডা রেখে আম্মা জানতে চাইলেন।

'কাজ করছে, আরো কয়েক বছর করুক না। টাকা পয়সা আয় করুক। জীবনের মর্ম বুঝুক। বয়সও হোক। দায়িত্ব নিতে শিখুক। ছেলে যখন হয়েছে, বিয়ে তো করবেই। হঠাৎ এত তাড়াহুড়ো করছ কেন?'
'না খালাম্মা, বিয়ার বয়স অইছ। বইন্নার সময় ফসিল্লা আঁর হেড আছিল।( সম্ভবত মহিলা '৯৮ সালের বন্যার কথা বলছিল।)'
'হোক না বয়স! আরেকটু বয়স হলে অসুবিধা কী?'
'অসুবিধা আছে খালাম্মা। অনেক ভাবিচিন্তা ফয়লাইল্লার বাপ আর আঁই বিয়া ঠিক কইচ্ছি।'

আম্মা ভাবছেন, মেয়ের বাবাদের হয়তো অনেক জায়গা-জমি আছে। নগদ টাকা যৌতুক নিয়ে হয়তো বিয়ে করাচ্ছে।

'অসুবিধা আবার কী?'
'খালাম্মা মায় ঝির কতা। বেদ্দফি মাপ করি দিয়েন। উঠতি বয়স্সা হোলা। যারে দেইখব তারে বালা লাইগব। আন্নেরা মোবাইল এক্কান কিনি দিছেন। এবার বাইত গেছে আর দেই। হারাক্ষন ফোনে কার লগে কথা কয়, আঁসে।'
'ফোনে কথা বললে অসুবিধা কি? আজকালকার ছেলে কথা বলতেই পারে।'
'না খালাম্মা। এত কষ্ট করি টিঁয়া রোজগার করি, হে টিঁয়া দি অন্য মাইয়্যার লগে কতা কইব কিল্লাই? কইলে বোওর লগে কোক। টিঁয়া খরচ কইরলে বোওর লাই করুক। চাইরগা গরু আঁই একলা সামলাইতাম হারি না। ফয়সাইল্লার বোসহ কাম কইরব। আঁর উকার অইব। হোলাও আঁর নষ্ট অইত না। বরং মনমানসিকতা ঠিক থাইকব। আয় রোজকারে মন দিব।'

ফয়সালের মায়ের হিসাব -নিকাশ শুনে তো আমরা পুরোপুরি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। একেবারে নিম্ন শ্রেণির একটা পরিবার, হাতিয়ার চর অঞ্চলে থাকে, যাদের কাছে সভ্যতার আলোটুকু পর্যন্ত পৌঁছায়নি। সে অবস্থানের একটা মহিলা তার সন্তানের জন্য, পরিবারের জন্য কেমন লাভজনক একটা কাজ করছেন। যথাসময়ে ছেলেকে বিয়ে করানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে। লক্ষ্য করলাম বিয়ের কথা শুনে ফয়সালও রাজি।
আমি বাল্যবিবাহের পক্ষে নই। তবে অনেক শিক্ষিত, সুশীল পরিবার আছে। বিয়ের বয়স হয়ে, চলে গেলেও ছেলে মেয়েদের বিয়ে করাতে চায় না।

ছেলে প্রেম করে, করুক। মেয়ে প্রেম করে, করুক। উঠতি বয়সী ছেলে প্রেম করতেই পারে। কিন্তু বিয়ের কথা শুনলেই পরিবারের সদস্যরা না না শুরু করে দেন। ছেলের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। অথচ ইসলাম বিয়েকে হালাল করেছেন, প্রেমকে নয়।

বাবা- মায়ের অদূরদর্শী চিন্তার কারণে ডাস্টবিনে, পথে ঘাটে বিবাহবহির্ভূত অনৈতিক সম্পর্কের ফসল পৃথিবীর আলো দেখার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে।
শেখার জন্য আসলে বয়স লাগে না, আবার পন্ডিতের কাছেও শিখতে হয় না। ফয়সালের মায়ের কাছ থেকে আজ একটা কিছু শিখলাম।

বিয়ের বয়স হলেই আপনার সন্তানকে বিয়ে দিন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us