উইঘুর নারীদের বন্ধ্য করিয়ে দেয়া হচ্ছে!

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন | Feb 14, 2021 04:46 pm
একজন উইঘুর নারী

একজন উইঘুর নারী - প্রতীকী চিত্র

 

মহাপ্রাচীর পেরিয়ে সভ্য দুনিয়ায় ও চীনের গোপনীয় কোনো খবর আসা বড্ড কঠিন। তবুও বিভিন্ন সূত্রে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তা কেবল উদ্বেগজনক নয়, লোমহর্ষকও। জিনজিয়াং প্রদেশে বিদেশী কোনো মিডিয়াকর্মী প্রবেশের সুযোগ নেই। স্যাটেলাইটে ধারণকৃত কিছু চিত্র ও কোনোক্রমে পালিয়ে আসা ব্যক্তির সাক্ষাৎকার থেকে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে ১০ লাখ উইঘুর মুসলমানের ওপর ভয়ঙ্কর নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নের আলেখ্য ফুটে উঠেছে। বেইজিং কর্তৃপক্ষ এসব বন্দিশিবিরকে নাম দিয়েছে ‘পুনঃশিক্ষণ’ কেন্দ্র। উইঘুরসহ সংখ্যালঘুদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে তাদের ‘কারিগরি প্রশিক্ষণ’ দেয়া হয় ওইসব ক্যাম্পে- বেইজিং এমন দাবি করলেও আসলে ওইগুলো হিটলারের আমলে জার্মানির নাৎসি সিক্রেট বাহিনী গেস্টাপোর Concentration Camp-এর মতো ভিন্নমত নির্যাতনকেন্দ্র। উত্তর পশ্চিম চীনের শিনজিয়াং প্রদেশের তুর্কি বংশোদ্ভূত মুসলিম সংখ্যালঘু এই উইঘুরদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ১০ লাখ।

কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের সহায়তায় গোয়েন্দা বাহিনী উইঘুর মুসলিম নারী-পুরুষদের ঘর থেকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পে আটকে রাখে বছরের পর বছর। অতি উচ্চ প্রাচীরে ঘেরা এবং সার্ভাইল্যান্স ক্যামেরায় নিয়ন্ত্রিত এসব ক্যাম্পের অভ্যন্তরে কী চলে বাইরে থেকে জানা অনেকটা অসম্ভব। একদলীয় চরম কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসন চালু থাকায় সেখানে আইনের শাসন, মানবাধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই। ক্যাম্পের ভেতরে বন্দীদের কমিউনিজমের মতবাদ গ্রহণের জন্য চাপ দেয়া হয়। দাড়ি রাখা, টুপি পরিধান, হিজাব ব্যবহার প্রভৃতিকে নিরোৎসাহিত করা হয়। তাছাড়া, নতুন মসজিদ নির্মাণের অনুমতি নেই। পুরনো মসজিদ সংস্কার বা পুনঃনির্মাণ করতে চাইলে বৌদ্ধ মন্দিরের স্থাপত্যিক আদলে নির্মাণ করতে হয়। বিশেষ জোর প্রয়োগ করা হয় হান সংখ্যাগুরু বৌদ্ধদের সংস্কৃতি অবলম্বনের ওপর। এর সরল অর্থ হলো- ইসলামী তাহজিব-তামাদ্দুন বা সভ্যতা সংস্কৃতি বর্জন। এ কাজগুলো করার জন্য মুসলিম নামধারী অনেক বৃত্তিভোগী অ্যাজেন্ট রয়েছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, চীনা সরকার উইঘুরদের ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য স্বাধীনতা হরণ করে চলেছে এবং গণ-নজরদারি, চলাফেরায় বাধা, বন্দিত্ব, মগজ ধোলাই, উইঘুর তরুণীদেরকে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ ছেলেদের সাথে বিয়ে দেয়া এমনকি জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ পর্যন্ত করানোর এক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যাতে মুসলমানদের সংখ্যা হ্রাস পায়। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই নীতির উদগাতা বলে জানা যায়। ২০১৪ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চালানো এক সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি জিনজিয়াংয়ে দমননীতি গ্রহণ করেছেন। ব্যক্তির অপরাধের জন্য গোটা উইঘুর সম্প্রদায়কে তিনি আসামির কাঠগড়ায় তুলতে দ্বিধা করেননি। চীন সরকারের লক্ষ্য হলো, ধীরে ধীরে উইঘুর মুসলিম জাতিসত্তাকে নিঃশেষ করে দেয়া। মার্কিন সরকার জিনজিয়াংয়ে চীনের এসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ‘গণহত্যার শামিল’ বললেও চীন বরাবর একে ‘মিথ্যা ও উদ্ভট অভিযোগ’ বলে বর্ণনা করেছে।

স্মর্তব্য, সপ্তম শতাব্দীতে সমুদ্র ও স্থলপথে চীনে ইসলামের আগমন ঘটেছিল। ইসলাম চীনে স্বীকৃত চতুর্থ ধর্ম। চীনের সমগ্র জনসংখ্যার ০.৩১ শতাংশ হচ্ছে উইঘুর মুসলিম। ডিএনএ অ্যানালাইস নির্দেশ করে, উইঘুর হলো ককেশীয় ও পশ্চিম এশিয়ার নৃগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ। অষ্টম শতাব্দীতে উইঘুর জাতিগোষ্ঠী চীনে বিস্তৃতি লাভ করে। জিনজিয়াং ও হুনান প্রদেশে উইঘুরের সংখ্যা বেশি। উইঘুররা সুন্নি ইসলামে বিশ্বাসী। জিনজিয়াং ও হুনান প্রদেশের বাইরেও বিপুল সংখ্যক মুসলমানের বসবাস রয়েছে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে মোট তিন কোটি মুসলমানের বাস।

পরিকল্পিত ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন ও অত্যাচারের শিকার তুরসুনে জিয়াউদুন (৪২) নামক এক নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। জিনজিয়াং প্রদেশের ওই এলাকাটি কাজাখস্তান সীমান্তের পাশেই এবং সেখানে বহু জাতিগোষ্ঠীর লোক বাস করে। তুরসুনের স্বামীও একজন কাজাখ। তিনি নিজে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে প্রথমে কাজাখস্তান পৌঁছেন। পরে উইঘুর মানবাধিকার প্রকল্পের সহায়তায় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই থাকার পরিকল্পনা করছেন। তার স্বামী এখনো কাজাখস্তানে আছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার এক সপ্তাহ পরই তুরসুনের জরায়ু কেটে বাদ দেয়া হয়- তার ওপর নির্যাতনের চিকিৎসার অংশ হিসেবে। ‘আমি মা হওয়ার সুযোগ হারিয়েছি’, বলেন তিনি।

গোপন বন্দিশিবিরে ২০১৯ সালে তিনি ৯ মাস দুঃসহ জীবন কাটিয়েছেন। তার এই লোমহর্ষক বর্ণনা যেকোনো পাঠক-শ্রোতাকে হতবিহ্বল করতে পারে। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমাকে যেদিন বন্দিশিবিরে আনা হলো, মুখোশ পরা এক লোক বলে, ওকে অন্ধকার ঘরে নিয়ে যাও।’ এক মহিলা আমাকে সেই অন্ধকার ঘরে নিয়ে যায়। তাদের হাতে একটা ইলেকট্রিক লাঠির মতো ছিল- সেটা কী জিনিস আমি জানি না। সেটা আমার যৌনাঙ্গে ঢুকিয়ে দেয়া হলো; আমাকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হলো। তখন কোভিড-১৯ এর মতো কোনো অতিমারীর প্রাদুর্ভাব না হলেও নিরাপত্তায় নিয়োজিত লোকগুলো সবসময় স্যুট ও মুখোশ পরে থাকত। কখনো কখনো তারা আসতো মধ্যরাতের পর। সেলের মধ্যে এসে তারা ইচ্ছেমতো কোনো একজন নারীকে বেছে নিত। তাদের নিয়ে যাওয়া হতো করিডোরের আরেক মাথায় ‘কালো ঘর’ বলে একটি কক্ষে। ওই ঘরটিতে নজরদারির জন্য কোনো ক্যামেরা ছিল না। বেশ কয়েক রাতে তুরসুনকে এভাবেই নিয়ে গিয়েছিল ওরা। ওই সেলগুলো থেকে প্রতিরাতে নারীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর মুখোশ পরা এক বা একাধিক চীনা পুরুষ তাদের ধর্ষণ করত। তিনি নিজে তিনবার গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। প্রতিবারই দুই বা তিনজন লোক মিলে এ যৌন নির্যাতন চালায়। তুরসুনে জিয়াউদুন বলেন, ‘নির্যাতনকারীরা শুধু ধর্ষণই করত না, সারা শরীরে কামড়াত। আপনি বুঝবেন না, তারা মানুষ না পশু। শরীরের কোনো অংশই তারা বাকি রাখত না; সবখানে কামড় বসাত আর তাতে বীভৎস সব দাগ হয়ে যেত। তিনবার আমার এ অভিজ্ঞতা হয়েছে’।

এ বর্ণনার খুঁটিনাটির সাথে জিনজিয়াং বন্দিশিবির সম্পর্কে বিবিসির অন্যান্য তথ্য ও বর্ণনা মিলে যায়। জিনজিয়াংয়ের বন্দিশিবিরে ১৮ মাস ছিলেন আরেক কাজাখ নারী গুলজিরা আউয়েলখান। তার সাথেও বিবিসির কথা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার কাজ ছিল ওই মেয়েদের কোমর পর্যন্ত কাপড়চোপড় খোলা এবং এমনভাবে হাতকড়া লাগানো যাতে তারা নড়তে না পারে। তাদের ঘরে রেখে বেরিয়ে যেতাম। তারপর সেই ঘরে একজন পুরুষ ঢুকত। সাধারণত বাইরে থেকে আসা কোনো চীনা লোক, বা পুলিশ। আমি দরজার পাশে নীরবে বসে থাকতাম। লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমি ওই নারীটিকে স্নান করাতে নিয়ে যেতাম’।
গুলজিরা বলেন, ‘বন্দীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী ও কমবয়স্কা মেয়েদের পাওয়ার জন চীনা পুরুষরা টাকাপয়সা দিত।’ এতে বাধা দেয়া বা হস্তক্ষেপ করার কোনো সাধ্য তার ছিল না। কিছু সাবেক বন্দীকেও বাধ্য করা হতো প্রহরীদের ‘সাহায্য’ করতে।

‘পুনঃশিক্ষণ’ স্কুল
সেলের পাশাপাশি বন্দিশিবিরগুলোর আরেকটা অংশ ছিল স্কুলের শ্রেণীকক্ষ। এখানে শিক্ষক এনে বন্দীদের ‘নতুন করে শিক্ষাদান’ করা হতো, মানবাধিকারকর্মীদের মতে- যার লক্ষ্য ছিল উইঘুর ও অন্য সংখ্যালঘুদের নিজেদের ধর্ম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ভাষা ভুলিয়ে দিয়ে কমিউনিস্ট আদর্শ ও সংস্কৃতির মূলধারায় তাদের দীক্ষিত করা। বন্দীদের চীনা ভাষা শিক্ষা দিতে যাদের বাধ্য করা হতো তাদের একজন ছিলেন কালবিনুর সাদিক। তিনি জিনজিয়াংয়ের একজন উজবেক নারী। সাদিক পরে চীন থেকে পালিয়ে যান এবং তার অভিজ্ঞতা প্রকাশ্যে বর্ণনা করেন।

উইঘুর হিউম্যান রাইটস প্রজেক্টের কাছে দেয়া এক জবানবন্দিতে সাদিক বলেন, ‘মেয়েদের নির্যাতনের জন্য ইলেকট্রিক স্টিক নামে একটা জিনিসের কথা জানি, যা মেয়েদের শরীরে ঢুুকিয়ে দেয়া হতো।’ ঠিক তেমনটা জিয়াউদুন বর্ণনা করেছেন। সাদিক জানান, ‘চার রকমে ইলেকট্রিক শক দেয়া হতো। চেয়ার, দস্তানা, হেলমেট, আর পায়ুপথে স্টিক দিয়ে ধর্ষণ। পুরো ভবনজুড়ে মেয়েদের আর্তনাদের প্রতিধ্বনি শোনা যেত। দুপুরের খাবারের সময় বা কখনো কখনো ক্লাস থেকেও তা শুনতে পেতাম।’

ক্যাম্পে শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হওয়া আরেক নারী সায়রাগুল সাউৎবে বিবিসিকে বলেন, ‘ধর্ষণ ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। রক্ষীরা যাকে চাইত, তাকেই তুলে নিয়ে যেত।’ তিনি জানান, তিনি একটি ভয়াবহ ও প্রকাশ্য গণধর্ষণের ঘটনা দেখেছেন। একটি ২০-২১ বছরের মেয়েকে ১০০ জন বন্দীর সামনে নিয়ে আসা হয়, তাদের বাধ্য করা হয় স্বীকারোক্তি দিতে। তারপর পুলিশ পালাক্রমে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে সবার সামনে। সে সময় তারা অন্য বন্দীদের ওপর নজর রাখছিল। তাদের কেউ বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে, চোখ বন্ধ করলে, অন্যদিকে তাকালে, বা হাতের মুঠি শক্ত করলেই তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শাস্তি দেয়ার জন্য। সায়রাগুল বলেন, ‘মেয়েটির চিৎকার শুনে আমার মনে হচ্ছিল যেন, আমি মরে যাচ্ছি’।

জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ
বন্দীদের সেখানে চুল কেটে দেয়া হতো। তারা ক্লাসে যেত, তাদের এমন সব ডাক্তারি পরীক্ষা করা হতো যার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যেত না, তাদের বড়ি খেতে হতো, প্রতি ১৫ দিনে একবার করে ‘টিকা’ দেয়া হতো- যার ফলে তাদের বমি বমি লাগত, শরীর অসাড় হয়ে যেত। কোনো কোনো নারীর দেহে জোর করে জন্মনিরোধক আইইউডি লাগিয়ে দেয়া হতো, কাউকে বা বন্ধ্যাকরণ করানো হতো। কিছু স্বাধীন গবেষণায় দেখা গেছে, জিনজিয়াং প্রদেশে গত কয়েক বছরে জন্মহার অনেকটা কমে গেছে। মুসলমানদের জনসংখ্যা হ্রাস করে দেয়াই তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। বিশ্লেষকদের অনেকে একে ‘জনসংখ্যাগত গণহত্যা প্রচারণা’ বলে অভিহিত করেন। অফবৎরহ তবহু নামে চীনের এক গবেষক মুসলিম নারীদের বন্ধ্যাকরণের বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করেছেন যা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে।

বিশ্ববাসীর প্রতিক্রিয়া
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, ‘জিনজিয়াংয়ে উইঘুর ও অন্য সংখ্যালঘু নারীদের বিরুদ্ধে বন্দিশালায় চালানো নিয়মিত ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনের যে বর্ণনা ভুক্তভোগীর কাছ থেকে বিবিসির প্রতিবেদনের মাধ্যমে জেনেছি তাতে আমরা খুবই মর্মাহত। ‘এসব নৃশংসতা বিবেককে নাড়া দেয়। অবশ্যই অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করা উচিত।’ অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যারিস পাইন-এর নিন্দা জানিয়ে ওই অঞ্চলে অতিসত্বর জাতিসঙ্ঘের প্রবেশাধিকার দেয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, সেখানে কী হচ্ছে তা স্বচ্ছতার সাথে জানা আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেসহ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অতিসত্বর নিরবচ্ছিন্নভাবে জিনজিয়াংয়ে প্রবেশের সুযোগ দেয়ার জন্য চীনের প্রতি আহ্বান জানাই। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছে, কমিউনিজমের দীক্ষা, আটক, নারীদের জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ এবং গণ-নজরদারির মতো কঠোর পদ্ধতির মাধ্যমে চীন অব্যাহতভাবে উইঘুরদের ধর্মীয় ও অন্যান্য স্বাধীনতা হরণ করছে। জিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অব্যাহতভাবে অস্বীকার করছে চীন। তাদের দাবি সেখানে কোনো বন্দিশালা নেই। যেগুলোকে বন্দিশালা বলা হচ্ছে, সেগুলো কারিগরি শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।’ মানবাধিকার সংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থা চীনের এসব ক্যাম্পের বিরুদ্ধে উইঘুর মুসলিমদের ওপর যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নজরদারি, তাদের ওপর নির্যাতন, উইঘুরদের জন্মনিয়ন্ত্রণ করা ও জোরপূর্বক নানা কাজে বাধ্য করার অভিযোগ এনেছে। কিন্তু এর আগে বিভিন্ন সময় এসব ক্যাম্পে বন্দী থাকা ব্যক্তিরা ও ক্যাম্পের প্রহরীরা এসব সত্য বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন।

সবচেয়ে বেদনার বিষয় হলো, বেইজিং কর্তৃক উইঘুর নারীদের প্রতি নজিরবিহীন সহিংসতা ও যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ বা চীনকে বাধ্য করার মতো শক্তিধর আন্তর্জাতিক কোনো কর্তৃপক্ষ নেই বললেই চলে। ওআইসি বা আরব লিগ নখদন্তহীন এ ক্লান্ত ব্যাঘ্র। ৫৭টি মুসলিম দেশ চীনা পৈশাচিকতার তাণ্ডবনৃত্যের নীরব দর্শক মাত্র। ২০১৯ সালে ওআইসিভুক্ত ৫৭টি দেশের মধ্যে ৩৭টি দেশ চীনে উইঘুর নির্যাতনের বন্ধের দাবিতে তৈরি এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর করলেও ২০টি দেশ স্বাক্ষর দানে বিরত থাকে। বিবৃতি দেয়ার সাহস পর্যন্ত নেই। মুসলিম ভ্রাতৃত্বের চাইতে অর্থের মূল্য বেশি। অনেক দেশ চীনের Belt and Road Infrastructure Programme-এর কাছে যেন বিক্রি হয়ে গেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো- মুসলিম দেশগুলো চীনের সাথে কোটি কোটি ডলারের বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।

‘রাবাত থেকে জাকার্তা’র মুসলিম জনপদের অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তান, মিসর, সৌদি আরব, ও আমিরাত উইঘুরদের ব্যাপারে একেবারে নীরব। পাকিস্তানে ৬০ বিলিয়ন ডলারের চীনা বিনিয়োগ থাকায় প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জাতিসঙ্ঘে প্রদত্ত ভাষণে চীনে মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দও উচ্চারণ করেননি। অথচ কাশ্মির সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন। সৌদি আরব থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধের জন্য পাকিস্তান নতুন করে চীন থেকে দুই বিলিয়ন ডলার কর্জ নেয়।

২০১৭ সালে মিসরের বর্তমান শাসকরা ২০০ উইঘুর মুসলিমকে হোটেল রেস্তোরাঁ থেকে ধরে চীন সরকারের হাতে তুলে দিয়েছেন। উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে সৌদি আরবের কোনো বক্তব্য বা উদ্বেগ নেই। ২০১৭ সালে সৌদি আরব ও চীন ৭০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের নতুন চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ইরানের ভূমিকাও দায়সারা গোছের। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান বন্দিশিবিরে উইঘুরদের দুর্দশাকে ‘মানবতার জন্য চরম লজ্জা’ হিসেবে উল্লেখ করলেও মনে হয় ইউটার্ন নিয়েছেন। জিনজিয়াং এ নির্যাতন বন্ধে ২২ জাতির প্রতিবাদপত্রে স্বাক্ষর করতে তুরস্ক অস্বীকৃতি জানায়। এর নেপথ্যে রয়েছে ভূরাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক স্বার্থ। এদিকে, জ্বালানি ও পরিবহন খাতে তুরস্ক ৩.৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা পেয়েছে চীন থেকে।

চীনের সাথে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও কুটনৈতিক সম্পর্ক বহাল রেখেও উইঘুর জাতিগোষ্ঠীর সাথে মানবিক আচরণ করার প্রসঙ্গ দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অ্যাজেন্ডাভুক্ত করা যেতে পারে। বিবিসি বহুদিন যাবত উইঘুরদের নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করছেও তেমনি; বিশেষত আল-জাজিরাসহ মুসলিম দেশের মিডিয়াগুলো ডক্যুমেন্টারি স্টোরি প্রচার করলে মোটামুটি ইতিবাচক ফল পাওয়া যেত বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর মানবতাবাদী মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে বিপন্ন উইঘুর জাতিগোষ্ঠীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোর মানসে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক

drkhalid09@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us