মুহাম্মাদ আলেকজেন্ডার রাসেল ওয়েব : মহান নওমুসলিম

মাহদি হাসান | Feb 16, 2021 12:58 pm
Alexender Russell Webb

Alexender Russell Webb - ছবি সংগৃহীত

 

বিশিষ্ট মার্কিন সাহিত্যিক ও দার্শনিক আলেকজেন্ডার রাসেল ওয়েব ১৮৪৬ সালের ৯ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসুচেটস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ জন্মভূমিতেই শিক্ষার প্রথম পাঠ শুরু হয় তার। অতঃপর নিউইয়র্ক শহরে এসে তিনি উচ্চস্তরের পড়াশোনা সমাপ্ত করেন। সাহিত্যের প্রতি তিনি ছিলেন খুবই অনুরক্ত। তার জ্ঞানের বিশালতা, চিন্তা-চেতনার উর্বরতা ও স্বাধীনচেতা মনোভাব সাহিত্যের প্রতি তার ঝোঁক বাড়িয়ে দিয়েছিল। কর্মজীবনের শুরুলগ্ন থেকেই তিনি সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত হন। তার লেখা প্রবন্ধ ও নিবন্ধগুলো ছিল তথ্যবহুল এবং জনমনে প্রভাব সৃষ্টিকারী। এভাবে তিনি অল্প কদিনের মধ্যেই বেশ খ্যাতি লাভ করেন। এমনিভাবে ছোট গল্প লেখার মাধ্যমেও তিনি বেশ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তার লেখা ছোটগল্পগুলো বেশ পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছিল। পাঠকেরা অধীর আগ্রহে তার ছোট গল্প প্রকাশের অপেক্ষা করত এবং মুগ্ধ হয়ে পাঠ করত। সাহিত্য এবং সাংবাদিকতার জগতে তিনি এতটাই সফল হন যে, অল্প কয়েক বছর পরেই তিনি ‘সেন্ট জোসেফ গেজেট’ এবং ‘মিসৌরি রিপাবলিকান’ নামক দুটি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

সাংবাদিকতা নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময়ে তিনি বিভিন্ন ধর্মের মূলতত্ত্ব এবং নীতিমালা নিয়ে গুরুত্বের সাথে পড়াশোনা করেছিলেন। পাঠ করেছেন ইহুদিবাদ এবং এর শাখা দলগুলোর আকিদা-বিশ্বাস। পড়াশোনা করেছেন খ্রিষ্ট ধর্ম এবং তার নানা মতবাদ নিয়ে। পাঠ করেছেন ইসলাম ধর্ম, ইসলাম ধর্ম নিয়ে লিখিত রচনাবলী এবং পবিত্র কুরআন। এমনিভাবে অধ্যয়ন করেছেন জরাথ্রুষ্ট, কনফুসিয়াস ও বৌদ্ধ ধর্ম ইত্যাদি প্রাচ্যের অন্যান্য ধর্ম। পাশ্চাত্যের স্কলারগণ ধর্ম নিয়ে যে সকল রচনা লিখেছিলেন এর বেশির ভাগই ছিল তার নখদর্পণে।

ইসলাম ধর্ম গ্রহণ
বিভিন্ন ধর্মের উৎপত্তি স্থল প্রাচ্যের প্রতি তার মন উৎসুক হয়েছিল। তার বিশেষ গুণাবলী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের বলে ১৮৮৭ সালে তিনি ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় আমেরিকান কনস্যুলেট তথা দূত হিসেবে নির্বাচিত হন। এ শহরেই প্রথমবারের মতো মুসলিম জীবনাচারের সাথে পরিচিত হওয়ার এবং মুসলিমদেরকে প্রত্যক্ষভাবে দেখার সুযোগ হয়েছিল তার। এ সকল মুসলিমের কাছ থেকে তিনি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে অবগত হন। ইসলামের মহত্ত্ব এবং মুসলিমদের মননে- মগজে এ ধর্মের প্রভাবশীলতা তাকে অভিভূত করে। তিনি নিশ্চিত হয়ে যান এটিই আল্লাহ তায়ালার প্রকৃত এবং সত্য ধর্ম। মানবসভ্যতার সৌভাগ্যের একমাত্র সোপান হচ্ছে এই ধর্ম। পরবর্তী বছরেই ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ণ একনিষ্ঠতা এবং পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও ইমানের সাথে প্রকাশ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ঘোষণা করে দেন তার এই পরম সৌভাগ্যের কথা। জানিয়ে দেন মুসলিমদের জীবনাদর্শের মাধ্যমে তিনিও সৌভাগ্যের অংশ লাভ করতে চান। তিনি তাঁর নামের সাথে মুহাম্মাদ যোগ করেন। অতঃপর ‘মুহাম্মাদ আলেকজেন্ডার রাসেল ওয়েব’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেন।

জানা যায় যে ফিলিপাইনে আমেরিকার দূত হিসেবে কাজ করার সময়ে উসমানি সালতানাতের সর্বশেষ সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ একবার তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সুলতান তাঁর পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ আল-জাদাওয়িকে ম্যানিলায় পাঠিয়েছিলেন মুহাম্মাদ আলেকজেন্ডারের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। এ সাক্ষাতের পরই আলেকজেন্ডার ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন এবং তার চাকরি থেকে ইস্তফা গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি আমেরিকায় ইসলাম প্রচারের কাজে নিয়োজিত হয়ে যান।

নিজের লেখা এক প্রবন্ধে তিনি তার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ‘লোকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করে, খ্রিষ্টান মুলুকে আমার জন্ম, খ্রিষ্টানদের রক্ষণশীল পরিবেশে আমার বেড়ে ওঠা, আমার রক্তে মাংসে মিশে ছিল খ্রিষ্টবাদ, কিন্তু তারপরও কীভাবে ইসলাম আমার ভেতর জায়গা করে নিলো?’

আমি তাদের কৌতুহলী জিজ্ঞাসার জবাবে সাথে সাথেই বলি, ‘আমি অনেক ধর্মগ্রন্থ পড়েছি, অনেক মতবাদের শেকড় নিয়ে ভেবেছি, গবেষণা করেছি ধর্মপ্রচারকদের মূল মর্মবাণী নিয়ে। কিন্তু মানুষের আত্মিক চাহিদা পূরণে ইসলাম যেভাবে সাড়া দিয়েছে, তেমনটি আর কোনো ধর্ম কিংবা মতবাদে কোথাও পাইনি। তাই আমি আমার জীবনের আদর্শ হিসেবে ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করেছি।

আমি এখানে আরো যোগ করতে চাই যে, আমার বয়স যখন ২০ তখনই চার্চের অসাড়তা এবং কুফল নিয়ে আমার মনে বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিল। আমি সেই যে চার্চ ত্যাগ করেছি, আর কখনো ফিরে যাইনি। সুন্দর সুন্দর আর্টিকেল লেখার জন্য আমার ছিল খুবই তীক্ষ্ণ এবং অনুসন্ধানী মেধা। আমি যে বিষয় নিতাম তা নিয়ে পরিপূর্ণভাবে গবেষণা করতাম এবং প্রতিটি ঘটনার পিছনের কারণ এবং সম্পৃক্ততা খুঁজে বের করতাম। আমি তখন দেখেছি যে, ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মীয় উভয় শ্রেণীর লোকেরাই তাদের মতবাদের পক্ষে সন্তোষজনক যৌক্তিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল উপস্থাপন করতে ব্যর্থ। উভয় পক্ষের মুখে একই বুলি, এগুলো খুবই সুক্ষ এবং গোপন বিষয়। এগুলোর অনেক গোপন ভেদ রয়েছে। যেভাবে আছে সেভাবেই গ্রহণ করতে হবে। কারণ, এগুলো হচ্ছে এমন বিষয় যা মানুষের পক্ষে অনুধাবন করা কখনোই সম্ভব নয়। এগুলো বুঝার সাধ্য মানবজাতির নেই।’

‘তবে ইসলামই হচ্ছে একমাত্র সত্য ধর্ম। একমাত্র এই ধর্মই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শ্বাশ্বত, চিরস্থায়ী, কোমল এবং সহজ ভিত্তির উপর। আল্লাহ মনোনীত রাসুলদের মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্মজুড়ে তা প্রচার লাভ করেছে। নুহ আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, সেই থেকে নিয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি পর্যন্ত সকল নবী- রাসূলকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিজীবের কাছে ঐশী বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য মনোনীত করেছেন। এটিই একমাত্র ন্যায়ের ধর্ম। একমাত্র এই ধর্মই মানবীয় বিবেক, অনুভূতি এবং জ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দেহ এবং আত্মার চাহিদার মাঝে সমন্বয় কেবল এই ধর্মই নিশ্চিত করে।’

‘কারো অন্ধ অনুসরণ কিংবা অনুকরণে আমি ইসলাম গ্রহণ করিনি। এটি কোনো ভ্রান্তি কিংবা চিন্তা-গবেষণার ত্রুটি নয়, বরং সত্য ও সুন্দরের সন্ধানে সুদীর্ঘ সময়ের গভীর অধ্যয়ন ও গবেষণার সঠিক ফলাফল হচ্ছে আমার ইসলাম গ্রহণ।’

তার অবদান
তিনিই হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি আমেরিকায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিলেন। ইসলামি জ্ঞানভাণ্ডার এবং শাস্ত্রের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করার প্রতি তিনি ছিলেন খুবই আগ্রহী। এজন্য তিনি পরিপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে সরকারী চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে হিন্দুস্তান সফর করেন। হিন্দুস্তানের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগমন, এখানকার উলামায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাৎ করা ছিল তার মূল লক্ষ্য। হিন্দুস্তানের উলামায়ে কেরামের কাছ থেকে তিনি অনেক উপকারী জ্ঞান লাভ করেছিলেন। এ সময় তিনি মাদ্রাজ, হায়দারাবাদ, ডেকান ইত্যাদি বেশ কয়েকটি শহরে জ্ঞানগর্ভপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন। তার বক্তব্যের সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল ‘শ্বাশ্বত পথ’, ‘ইসলাম’ ও ‘দার্শনিক ব্যক্তিত্ব’। ওই বক্তব্যগুলো একত্রিত করে একটি বই সংকলিত করা হয়েছিল। যা ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রাজ শহরে প্রকাশিত হয়।

এই সফর সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি স্বদেশে ফিরে গিয়ে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার প্রতি মনোযোগী হন। স্বদেশবাসীকে তিনি ইসলামের সুমহান নীতিমালা এবং সুন্দর বিধান সম্পর্কে জানানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি সমগ্র আমেরিকায় ইসলাম প্রচারে নিবেদিত হন। আমেরিকায় পৌঁছে তিনি নিউইয়র্কে স্থায়ী হন, একটি প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৩ সালের পহেলা মে তিনি ‘ইসলাম ওয়ার্ল্ড’ ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করেন। আমেরিকায় ইসলামি পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তিনি একটি মসজিদ এবং লাইব্রেরীও প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর নিউইয়র্কের জনগণের মুখে মুখে তার নাম চর্চিত হতে থাকে। এর পরের বছর গুলোতে তিনি ইসলাম সম্পর্কে বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে,

Why I Became a Muslim
An Outline of Islamic Faith
The Five Pillars of Practice
Islam in Its Philosophic Aspect
Polygamy and the Purdah
Popular Errors Refuted
The Muslim Defensive Wars
The American Islamic Propaganda

অতঃপর ওই সময়ে উসমানি খেলাফতের সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের পক্ষ থেকে তাকে নিউইয়র্কে দূত হিসেবে নিয়োগ করা হয়।
বিশিষ্ট চিন্তাবিদ এবং সুসাহিত্যিক মুহাম্মাদ আলেকজেন্ডার রাসেল ওয়েব যুক্তরাষ্ট্রে ইসলাম ধর্মের প্রচারে বিরাট অবদান রেখেছেন। নিজের পরিচিতি এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি আমেরিকার ক্রমবর্ধমান সমাজে ইসলামের প্রচার ও বাণী তুলে ধরেন। সেখানকার ইসলামবিদ্বেষী পাদ্রিদের তুমুল বিরোধিতা মোকাবেলা করে সমাজের গুণী লোকদের এবং বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসেন। তারাই পরে নিউইয়র্কে ইসলামী সমাজ তৈরীতে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন।

অনেক আমেরিকান নাগরিক তার মাধ্যমে প্রভাবান্বিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ফারুদ মুহাম্মাদ ছিলেন একজন। যিনি নিউইয়র্কে মুহাম্মাদ আলেকজেন্ডারের আন্দোলনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং বহুসংখ্যক আমেরিকান নাগরিকের ইসলাম গ্রহণে তার কার্যকরী ভূমিকা ছিল।

তার মৃত্যু
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দের পহেলা অক্টোরব ৭০ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার সম্পর্কে উমর আবদুল্লাহ একটি গ্রন্থ লিখেছেন। যার শিরোনাম হচ্ছে ‘A Muslim in Victorian America: The Life of Alexander Rusell Webb’।

সূত্র : উযামাউন আসলামো

ড. রাগিব সারজানি


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us