ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্যয়ের আশঙ্কা

এম এ খালেক | Mar 15, 2021 02:22 pm
ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্যয়ের আশঙ্কা

ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্যয়ের আশঙ্কা - ছবি সংগৃহীত

 

রাষ্ট্র মালিকানাধীন একটি বিশেষায়িত ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক পদে পদোন্নতির ইন্টারভিউ চলছিল। বোর্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক পদে দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা উপস্থিত। তিনি পদোন্নতি প্রার্থী সাক্ষাৎকারদাতার কাছে জানতে চান, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে দুরবস্থার কারণ কি? সাক্ষাৎকারদাতা কিছুটা ইতস্তত করতে থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক তাকে নির্ভয়ে উত্তর দেয়ার জন্য পরামর্শ দেন। সাক্ষাৎকার প্রার্থী এবার অনেকটা হঠাৎ করেই বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অদূরদর্শী নীতিমালার কারণেই ব্যাংকিং সেক্টরে দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সাম্প্রতিক সময়ে যে সব নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে তার বেশিরভাগই ঋণখেলাপি এবং দুষ্ট গ্রাহকদের অনুকূলে গেছে। এসব আইনের অপব্যবহার করে ঋণখেলাপিরা ব্যাংকিং সেক্টরে বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভদ্রলোক উদাহরণ জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, সুদ মওকুফ, দণ্ড সুদ মওকুফ, ঋণ হিসাব অবলোপন, ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলিকরণ ইত্যাদি সব সুবিধাই পাচ্ছেন ঋণখেলাপিরা। একজন নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারী উদ্যোক্তা যখন দেখবেন, ৫ বছরে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধের পর তিনি কোনো ধরনের সুদ মওকুফ সুবিধা বা অন্য কেনো আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন না, অন্যদিকে একজন ঋণখেলাপি ৫ বছর ঋণের কিস্তি বাবদ ১০ কোটি টাকা আটকে রেখে ২ বা ৩ কোটি টাকা সুদ মওকুফ সুবিধা পাচ্ছেন তাহলে নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারির মনে হতাশা জন্মানো অবধারিত। ঋণখেলাপিরা খুবই ক্ষমতাশালী। তারা সব সময় রাজনৈতিক সরকারের ছত্রছায়ায় থাকতে ভালোবাসেন। ফলে কেউ তাদের কিছু বলতে পারেন না। কিন্তু যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন তারা কোনো কারণে এক সময় কিস্তি পরিশোধে অসমর্থ হলে ব্যাংক তাদের উপর খড়গহস্ত হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভদ্রলোক আবারো জানতে চান, সম্প্রতি ৫০০ কোটি টাকা তদূর্ধ্ব খেলাপি ঋণ হিসাব পুনর্গঠন করা হয়েছে। এই উদ্যোগকে আপনি কিভাবে দেখছেন? সাক্ষাৎকারদাতা বলেন, এটা খুবই খারাপ একটি নজির সৃষ্টি করেছে ব্যাংকিং সেক্টরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ ব্যাপারে আর কোনো প্রশ্ন না করে তিনি প্রসঙ্গান্তরে চলে যান। সাক্ষাৎকারদাতা সেদিন যে উত্তর দিয়েছিলেন আপাতদৃষ্টিতে তা কিছুটা বাড়াবাড়ি মনে হলেও এটাই ব্যাংকিং সেক্টরের বর্তমান বাস্তবতা। নিকট অতীতে ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য যে সব আইনি সংস্কার বা নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে তা যত না নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারিদের স্বার্থের অনুকূল তার চেয়ে বেশি স্বার্থ সংরক্ষণ করছে ঋণখেলাপিদের।

প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে, ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব খেলাপি ঋণ হিসাব পুনর্গঠনের প্রসঙ্গে। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে। নির্বাচনের এক বছর পূর্তির পর ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে পরবর্তী তিন মাস দেশে ব্যাপক মাত্রায় আন্দোলন হয়। এক পর্যায়ে আন্দোলন সহিংস আকার ধারণ করে। সেই সময় প্রায় তিন মাস দেশের কল-কারখানা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। এই আন্দোলনের অজুহাতে একটি শক্তিশালি ঋণখেলাপি চক্র ব্যবসায়-বাণিজ্যে ক্ষতির কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপর চাপ সৃষ্টি করে ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব খেলাপি ঋণ হিসাব ১২ বছরের জন্য পুনর্গঠন করে নেয়। যেসব প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ গ্রহণ করেছিল তাদের বেশিরভাগই পরে আবারও ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে। তখন অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন, রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে ৫০০ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব অঙ্কের ঋণ খেলাপিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু যার কাছে ব্যাংকের পাওনা খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৫০ কোটি টাকা তিনি কি ক্ষতিগ্রস্ত হননি? তাহলে এই সুবিধা কেন সবার জন্য অবারিত করা হলো না? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় ঋণখেলাপি নাকি এক অনুষ্ঠানে প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, আপনারা ঋণখেলাপি ঋণখেলাপি করেন, এমন আইন করব যাতে দেশে ঋণখেলাপি বলে কিছু না থাকে। তার এই বক্তব্যের নির্মম প্রতিফলন আমরা প্রত্যক্ষ করছি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল দায়িত্ব গ্রহণের পর এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশকালে বলেছিলেন, আজ থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আর বাড়বে না। তার এই বক্তব্যে ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা, বিশেষ করে যারা খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা আশ^স্ত হয়েছিলেন। সবার মানেই দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছিল যে, অর্থমন্ত্রী সম্ভবত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন। কিন্তু না, কিছু দিনের মধ্যেই ভুল ভাঙ্গে। দেখা গেলো, অর্থমন্ত্রী এমন কিছু আইনি সংস্কারের উদ্যোগ নিলেন যার ফলে খেলাপি ঋণের দৃশ্যমান পরিমাণ কমতে শুরু করেছে যদিও খেলাপি ঋণের কিস্তি আদায় হয়নি। বিশ^ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এই অবস্থাকে কার্পেটের নিচে ময়লা লুকিয়ে রাখার সাথে তুলনা করেন। অর্থাৎ ময়লা দৃশ্যমান হবে না কিন্তু দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকবে।

নতুন আইনি সংস্কারের মাধ্যমে ২ শতাংশ এককালীন ডাউন পেমেন্ট দেয়ার মাধ্যমে বার্ষিক সরল সুদে এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য ঋণ হিসাব পুনঃতফসিলীকরণের সুযোগ দেয়া হয়। একবার কেউ এই সুযোগ গ্রহণ করলে পরবর্তীতে কিস্তি প্রদানে ব্যর্থ না হলে তাকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা চেষ্টা করলে এই সময়ের মধ্যে অন্য কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক, গত সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৪ হাজার ৪৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তিন মাস আগে অর্থাৎ জুন মাসে সমাপ্ত ত্রৈমাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে একমত নয়। তাদের মতে, মামলাধীন প্রকল্প এবং অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবে পাওনা খেলাপি ঋণ যোগ করলে দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ হবে ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণ কমিয়ে দেখানোর প্রবণতা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিস্তি আদায়ের মাধ্যমে যদি খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসে তাহলে সেটাকেই কেবল সাফল্য বলা যেতে পারে।

খেলাপি ঋণের দৃশ্যমান পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর জন্য আরো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন, ঋণ হিসাব অবলোপনের সময়সীমা কমানোসহ শর্ত শিথিল করা হয়েছে, যাতে একজন ঋণ গ্রহীতা খুব সহজেই ঋণের বকেয়া কিস্তি পরিশোধ না করেও ঋণখেলাপি তকমা পরিহার করার সুযোগ পান। যেমন, ঋণ হিসাব অবলোপন সংক্রান্ত নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়েছে। আগে কোনো একটি ঋণ হিসাব মন্দ মানে শ্রেণিকৃত হবার পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে নির্দিষ্ট শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে সেই ঋণ হিসাব অবলোপন করা যেতো। কোনো ঋণ হিসাব অবলোপন করার আগে সেই উদ্যোক্তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে হতো। এ ছাড়া ঋণ হিসাবের বিপরীতে পাওনা অর্থের সম পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে সংরক্ষণ করতে হতো। সংশোধিত আইনে মামলা দায়ের এবং শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণের বিধান প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া মন্দ মানে শ্রেণিকৃত হবার পর ৩ বছর অতিক্রান্ত হলেই সেই ঋণ হিসাব অবলোপন করা যাবে। ঋণ হিসাব অবলোপন নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, কোনো ঋণ হিসাব অবলোপন করার অর্থ সেই ঋণের দাবি ত্যাগ করা। কিন্তু বিষয়টি মোটেও তা নয়। ব্যাংক অবলোপনকৃত ঋণ হিসাবের পাওনা অর্থ লেজারে প্রদর্শন করে না। কিন্তু ঋণ আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। বিষয়টি এই রকম, কোনো একজন অভিভাবকের তিন ছেলে। দু’জন সুস্থ স্বাভাবিক। একজন শারীরিকভাবে পঙ্গু। বাইরে থেকে কোনো অতিথি বেড়াতে এলে তিনি সুস্থ দুই সন্তানকে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আর পঙ্গু ছেলেটিকে আড়ালে লুকিয়ে রাখেন। আড়ালে লুকিয়ে রাখলেও পঙ্গু ছেলেটি কিন্তু অস্তিত্বহীন হয়ে যায় না। সে অস্তিত্ববান কিন্তু প্রদর্শিত নয়। অবলোপনকৃত ঋণও ঠিক তেমনি। ব্যাংক এই ঋণের দাবি ত্যাগ করে না কিন্তু লেজারে প্রদর্শন করে না।

গত ক’ বছরে ব্যাংকিং সেক্টরে এমন কিছু আইনি সংস্কার করা হয়েছে যা এই সেক্টরের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টর এখন কিছু মানুষের লুটপাটের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি খাতের ব্যাংক মালিকরা নানা অজুহাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে। কিন্তু তার বিপরীতে দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন কোনো অবদান রাখছে না। আগে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবার থেকে সর্বোচ্চ দু’জন পরিচালক নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারতেন। তারা একাদিক্রমে দুই টার্ম (প্রতি টার্ম তিন বছর) দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। কিছু দিন আগে এই নিয়মের পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন একই পরিবার থেকে ৪ জন পরিচালনা বোর্ডে পরিচালকের দায়িত্ব পালন করতে পারছেন। তারা একাদিক্রমে তিন টার্ম অর্থাৎ ৯ বছর অব্যাহতভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন। এই আইনি সংস্কারের ফলে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে। একজন পরিচালক তিন টার্ম দায়িত্ব পালনের পর এক টার্ম বিরতি দিয়ে আবারো তিন টার্ম দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। কিছু দিন আগে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল এই মর্মে যে, ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালকগণ পরস্পর যোগসাজশে একে অন্যের ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করছেন।

বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে। গত বছর এপ্রিল মাস থেকে ব্যাংকিং সেক্টরে ৯/৬ শতাংশ সুদ হার কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে দেশের ব্যাংকগুলো প্রদত্ত ঋণের উপর সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদ হার প্রয়োগ করতে পারছে। গত এপিল মাসে ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়। সুদের হার ৯ শতাংশ নির্ধারণের শর্তে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের উদ্যোক্তারা সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। তারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আমানত ৬ শতাংশ সুদে পাওয়ার রাস্তা করে নিয়েছেন।

বর্তমানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের আমানত ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণ করলে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদ প্রদান করা হচ্ছে। এর একই আমানত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ করলে সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ শতাংশ সুদ প্রদান করা হচ্ছে। এখানেও ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সুবিধা দেয়া হয়েছে। আমানতকারীরা দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ বেশি পাওয়ার আশায় তাদের আমানত ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণে উৎসাহী হবেন। আগে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মোট আমানতের ২৫ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকে সংরক্ষণ করা যেত। ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে এটা ৫০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়ার ফলে দেশের বিনিয়োগ কার্যক্রমে গতিশীলতা সৃষ্টি হবে, ব্যাংকগুলো বেশি পরিমাণে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনোটিই পূরণ হয়নি। কিছু কিছু ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রদর্শিত সুদের বাইরে হিডেন চার্জ আরোপের অভিযোগ উঠছে। এ ছাড়া কিছু ব্যাংক আছে যারা ঋণ সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে। যখন ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয় তখন অর্থনীতিবিদদের অনেকেই এই উদ্যোগের সফলতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এভাবে সুদের হার নির্ধারণ করে দেবার কোনো সুযোগ নেই।

কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের সেই আপত্তি কানে তোলেননি। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে ব্যাংক ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সাড়ে ১৪ শতাংশ। অথচ এখনো ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ অতিক্রম করতে পারেনি। একবার ব্রিটেনে সরকারিভাবে ঋণের সুদের হার ৬ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিলে বিশিষ্ট দার্শনিক জন লক এর তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, এই উদ্যোগের ফলে ভালোর চেয়ে মন্দই হবে। মহজনরা সুদের হারের অবাস্তব ঊর্ধ্বসীমা পরিহারের জন্য নানা ফন্দি ফিকির খুঁজতে থাকবে। আর সরকার যদি সত্যি সত্যি সুদের হার কমিয়ে দিতে পারে তাহলে ব্যাংকগুলো ঋণ সংকোচননীতি গ্রহণ করতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা জন লক এর সেই বক্তব্যের বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করছি। ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণের প্রেক্ষিতে ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকের উদ্যোক্তাগণ সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায় করে নিলেও তারা প্রত্যাশা মতো ঋণের যোগান বাড়াননি। গত নভেম্বর মাসের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করে গেছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। এই অবস্থা কি ভাবা যায়? যে দেশের উদ্যোক্তারা সব সময় পুঁজি স্বল্পতায় ভোগে সেই দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ২ লাখ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে অথচ কেউ ঋণ নিতে আসছে না!

আসলে ব্যাংকগুলোর ‘কস্ট অব ফান্ড’ অনেক বেশি। তাই তারা চাইলেও ব্যাপক মাত্রায় ঋণ দিতে পারছে না। যখন ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হয় সেই সময় আমি একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছিলাম তাদের ‘কস্ট অব ফান্ড’ হচ্ছে সোয়া ৮ শতাংশ। সোয়া ৮ শতাংশ ‘কস্ট অব ফান্ড’ হলে সেই ব্যাংকের পক্ষে কোনো দিনই ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া সম্ভব নয়। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে ব্যাংক ঋণদান কমিয়ে দেবে অথবা হিডেন চার্জ আরোপ করবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকারিভাবে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বা কোনো পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেবার সুযোগ নেই। বাজার চাহিদা এবং যোগানের উপর ভিত্তি করেই মূল্য নির্ধারিত হবে। করোনাকালীন সময়ে এসএমই সেক্টরের জন্য সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা ঘোষণা করে। কিন্তু ব্যাংকগুলো এই ঋণ বিতরণে তেমন কোনো আগ্রহ দেখায়নি। নির্ধারিত সময়ে টার্গেটের অর্ধেক ঋণও তারা বিতরণ করতে পারেনি। এ বছর করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে নতুন করে ঋণ খেলাপি চিহ্নিতকরণ বন্ধ রাখা হয়েছিল। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়েনি। কিন্তু আবার যখন নতুন করে ঋণ খেলাপি চিহ্নিতকরণ শুরু হয়েছে এখন ব্যাংকিং সেক্টরের খেলাপি ঋণের অবস্থা কেমন হবে তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? প্রায় ৯ মাস খেলাপি ঋণ আদায় কার্যত বন্ধ ছিল। এই সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে যেসব নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা এই সেক্টরের ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে তুলতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিরা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আসতে পারবেন না। তারা ব্যবসায়িক বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃত্বে থাকতে পারবেন না। তারা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অযোগ্য বিবেচিত হবেন। বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ এবং গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করাতে পারবেন না। এমন একটি আইন প্রণয়নের দাবি অনেক দিন ধরেই ছিল। আইনি সংশোধনীটি খুবই ভালো কিন্তু সমস্যা দেখা দেবে এর বাস্তবায়নে। কারণ কে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি আর কে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি নন তা কিভাবে নির্ধারিত হবে? রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হলেও তারা নিজেদের ঋণ খেলাপের জন্য পরিস্থিতিকে দায়ী করলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কি করবেন? বাংলাদেশে টাকা ব্যয় করলে যে কোনো অসাধ্য সাধন করা যায়। এরা যে সেই অসাধ্য সাধন করবেন না তার কি নিশ্চয়তা আছে?


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us