ধর্ম কেন সমকামিতাকে গ্রহণ করে না

মো. রাফি | Apr 10, 2021 02:36 pm
ধর্ম কেন সমকামিতাকে গ্রহণ করে না

ধর্ম কেন সমকামিতাকে গ্রহণ করে না - ছবি সংগৃহীত

 

উল্লেখযোগ্য প্রায় কোনো বৃহৎ ধর্মই সমকামিতাকে গ্রহণ করতে চায় না কেন? কোনো নির্দিষ্ট সমাজব্যাবস্থার কি এই অধিকার আছে আরেকজনের ব্যক্তিস্বাধীনতায় বাধা দেয়ার?

পৃথিবীতে যতগুলো সমাজব্যবস্থা আজ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে, সব সমাজব্যাবস্থার একটা সাধারণ লক্ষ্য ছিল- তারা প্রবাহমান থাকবে। সমাজ গতিশীল থাকতে চায়। সমাজ চায় এর ধারা যুগের পর যুগ প্রবাহিত হবে। আর এই চাওয়াটা সমাজের কোনো 'অপশনাল এলিমেন্ট' না বরং একটা 'ফান্ডামেন্টাল ক্যারেক্টার'। সমাজের কোনো সদস্যের মধ্যে যদি এই গতিশীলতা ভাঙার প্রবণতা থাকে, সমাজ তাকে বাধা দেয়। কারণ সমাজ নিজে নিজে যুগ যুগ ধরে গতিশীল হতে পারে না। একে গতিশীল হতে হয় এর সদস্যদের মাধ্যমে। সমাজ চায় এর সদস্যরা বংশবিস্তার করে একে যুগের পর যুগ প্রবাহমান রাখবে। বিভিন্ন সমাজে সমকামিতাকে গ্রহণ না করার পেছনে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও এর সাথে বেশিরভাগ সমাজব্যবস্থাগুলোর সাধারণ মৌলিক দ্বন্দ্বটা শুরু হয় মূলত এই জায়গা থেকে। যদি কোনো সদস্য হোমোসেক্সুয়ালিটির পথে হাঁটে তাহলে ওই সমাজের গতিশীলতার টার্ম পূরণ করল না। ব্যক্তিগতভাবে ওই সমাজব্যবস্থার প্রবাহ বা গতিকে আটকে দেয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছে।

ঠিক এই জায়গায় এসে সমাজ আপনার ব্যক্তিস্বাধীনতায় একটা সীমারেখা টেনে দেবে।

এখন সমাজের কনসেপ্টটাই যেহেতু এমন যে এটা কোনো ব্যক্তিকেন্দ্রিক এন্টিটি না বরং অনেক মানুষের কানেক্টিভ প্লাটফর্ম তাই সমাজে আপনি ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলে যা ইচ্ছা তা করতে পারেন না। আপনি সমাজে থাকছেন মানে আপনি সেই সমাজের কাছে দায়বদ্ধ, তার টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনগুলো মেনেই সমাজের সুবিধা নিচ্ছেন।

এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, সবাই তো আর হোমোসেক্সুয়াল হয়ে যাবে না। কয়েকজন মানুষ হোমোসেক্সুয়াল হলেই কি মানুষের বংশবৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যাবে? সমাজের গতিশীলতা বন্ধ হয়ে যাবে?

এর প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, সমাজ যে জিনিসটাকে এর টার্মস এন্ড কন্ডিশনবিরোধী মনে করে তাকে সে বাধা দেয় সেটা যতজনের মাঝেই হোক না কেন। সমাজ মূলত এর টার্মস ভাঙার প্রবণতা তৈরি হতে দিতে চায় না। ওই টার্মস একজন ভাঙুক আর ১০,০০০ জন ভাঙুক, সমাজ ওই প্রবণতাকে একদম ক্ষুদ্রতম স্তর থেকে বাধা দেয়।

বর্তমান সমাজব্যাবস্থাগুলোর ইউনিট মূলত পরিবার। আপনি হোমোসেক্সুয়ালিটির দিকে যাচ্ছেন, এর অর্থ হলো আপনি একটা টেকসই পরিবারব্যবস্থায় সরাসরি কুঠারাঘাত করছেন। আপনার স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধির প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই কারণেই টেকসই সমাজব্যাবস্থা আপনার এই প্রবণতাকে নরমাল হিসেবে নেয় না।

এখন আসি ধর্মের প্রসঙ্গে। ধর্মগুলো মূলত তৈরিই হয়েছে একটা সমাজব্যবস্থাকে সুষ্ঠুতা দিতে। যেহেতু এই জিনিসটাকে সমাজ মানছে না, দুনিয়ার বৃহৎ সব ধর্মগুলোও এই জিনিসটাকে গ্রহণ করছে না।

ইসলাম ধর্মে হোমোসেক্সুয়ালিটিকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাতো আমরা জানিই। কোরআনে অন্তত ১৪ জায়গায় একে একটি অপরাধ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

এখন দেখি অন্য ধর্মগুলো সমকামিতা নিয়ে কী বলে।

হিন্দু ধর্মমতে সমকামিতা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
হিন্দুধর্মের ফিকাহশাস্ত্র মনুসংহিতার অষ্টম অধ্যায়ের ৩৬৯ ও ৩৭০ নম্বর শ্লোকে দুজন নারীর মধ্যে সমকামিতা সংঘটিত হলে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। (মনুসংহিতা অধ্যায় ৮, শ্লোক ৩৬৯)
'যদি কোনো বয়স্কা নারী অপেক্ষাকৃত কম বয়সী নারীর (কুমারীর) সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে, তাহলে বয়স্কা নারীর মস্তক মুণ্ডন করে দুটি আঙ্গুল কেটে গাধার পিঠে চড়িয়ে ঘোরানো হবে।' - (মনুসংহিতা অধ্যায় ৮, শ্লোক ৩৭০)।
'দু’জন পুরুষ অপ্রকৃতিক কার্যে প্রবৃত্ত হলে তাদেরকে জাতিচ্যুত করা হবে এবং জামা পরে তাকে জলে ডুব দিতে হবে' (মনুসংহিতা অধ্যায় ১১, শ্লোক ১৭৫)।

অন্য ইব্রাহিমি ধর্মগুলোতেও সমকামিতার কনসেপ্ট ইসলামের মতোই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে রোমীয় ১:২৬-২৭ সুনির্দিষ্টভাবে শিক্ষা দেয় যে ঈশ্বরের অবাধ্য হওয়া এবং তাকে অস্বীকার করার ফলস্বরূপ সমকামিতার শাস্তি দেয়া হয়েছে। লোকেরা যখন অবিশ্বাসের কারণে পাপ করতেই থাকে, তখন ঈশ্বর 'লজ্জাপূর্ণ কামনার হাতে' তাদের ছেড়ে দেন যেন তারা আরো জঘন্য পাপে ডুবে যায় এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে দূরে থাকার ফলে নিস্ফল ও নৈরাশ্যের জীবন অনুভব করতে পারে। ১ করিন্থীয় ৬:৯ পদে বলা হয়েছে যে যারা সমকামিতায় 'দোষী', তারা ঈশ্বরের রাজ্যের অধিকার পাবে না।

আমাদের প্রগতিশীল সমাজে জিউইশদের নিয়ে বিরাট ফ্যান্টাসি আছে। তাদের মতে, জিউইশরা ভীষণ মেধাবী আর প্রোগ্রেসিভ হয় তাদের ধর্মে পশ্চাদপদতা নেই এ কারণে। চলুন দেখি জুদাইসম সমকামীদের নিয়ে কী বলে-

'Donot have sexual realationship with mankind, as with womankind; it is detestable.'
- Lev.18:22

ভাবার্থ দাঁড়ায়-
: একজন পুরুষের সাথে (আরেকজন পুরুাষ) সহবাস করবে না, যেমনটা একজন নারীর সাথে করা হয়, এটা ঘৃণার্হ।"
'And if a man lie with mankind, as with womankind, both of them have committed a detestable act: They shall surely be put to death; their blood shall be upon them.'
- Lev. 20:13

অর্থাৎ : 'এবং যদি একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষের সঙ্গে সমকাম করে, তাদের উভয় একটি ঘৃণ্য জিনিস করছেন, তাদের নিহত করা হবে, তাদের ওপর তাদের রক্ত প্রবাহিত হবে।'
বৌদ্ধ ধর্মমতে সমকামিতার শাস্তির ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা না থাকলেও পঞ্চশীলের তৃতীয় শীলে মিথ্যা কামাচারকে নিষিদ্ধ করা হয়।

যেহেতু এই নিয়ে স্পষ্ট কোন রূপরেখা নেই তাই স্পষ্টভাবে এর শাস্তির বিধান উল্লেখ করতে পারছিনা। তবে কেউ যদি চান, এই নিয়ে আমার পড়া বাংলা বৌদ্ধ পণ্ডিতের ব্যাখ্যার লিঙ্ক দিতে পারি।
তিব্বতের দালাইলামা এই নিয়ে স্পষ্ট কোনো মত প্রকাশ করতেন না। তবে ১৯৯৭ সালে তিনি বক্তব্য পেশ করেছেন এইরকম- 'It is a sexual misconduct'.

আমি সমকামিতা নিয়ে ধর্মগুলোর মতবাদ উল্লেখ করেছি এজন্য নয় যে আমি সবগুলো ধর্ম মানার পরামর্শ দিচ্ছি আপনাকে। ধর্মগুলো যেহেতু একটা সমাজব্যবস্থাকে সাজানোর জন্যই গড়ে ওঠে, তাই ধর্মগুলো সমকামিতাকে মেনে না নেয়ার অর্থ হলো ধর্ম প্রভাবিত সমাজ ব্যবস্থাগুলোতেও সমকামিতা এক্সেপ্ট না করাটা একটা কন্ডিশন।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, আমি কি সমকামীদের রাস্তাঘাটে খুন করে ফেলা সমর্থন করছি?

না, অবশ্যই না। আমার জানামতে কোনো ধর্ম বা সমাজই আপনাকে সামাজিক অপরাধের জন্য আরেকজনকে ব্যক্তিগতভাবে শাস্তি দিতে বলে না। ইসলামের দৃষ্টিতে যদি কোনো অপরাধের দায় মৃত্যুদণ্ডও হয়, ওই মৃত্যুদণ্ড দেবে রাষ্ট্র। অর্থাৎ যদি ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেকোনো অপরাধের শাস্তি দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে সমাজগুলো কি তাদের কেবল শাস্তিই দেবে?

অবশ্যই না। একটা পূর্ণাঙ্গ সমাজব্যাবস্থা শুধু তাদের দৃষ্টিতে হওয়া অপরাধের শাস্তিই দেয় না, এও নিশ্চিত করার চেষ্টা করে যেন এই অপরাধগুলো সমাজে সংগঠিত না হয়, ওই পরিবেশটা গড়ে না ওঠে। আর কেউ এই চিন্তায় পতিত হলে কিভাবে তাকে সংশোধন করা যায়।

এখন পর্যন্ত জানা যায়, হোমোসেক্সুয়ালিটি গড়ে ওঠে মূলত পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আর মানসিক অসামঞ্জস্যতার মিশেলে।

এখন পর্যন্ত ম্যাসিভ সায়েন্স স্টাডি বলছে গে জিন বলতে ন্যাচারাল কোনো জিন নেই। কমেন্ট সেকশনে প্রগতিশীল ভাইদের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য সায়েন্স জার্নাল Nature-এর রিপোর্টটি দিচ্ছি।

কিন্তু এসব রিপোর্ট যেহেতু কনস্ট্যান্ট কিছু না, আমি একে অকাট্য প্রমাণ ধরে আলোচনা না করে একটা সমাজব্যবস্থা কী কারণে একে স্বাভাবিক হিসেবে নেয় না তা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম।

আমি যেহেতু সমকামিতাকে নরমালাইজ করার ইথিক্স ধারণ করি না, তাই আমি এই জিনিসটা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পক্ষে থাকছি না।

তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি সমকামিদের বিচার করতে পারি না। যেটা করতে পারি, সেটা হলো তাদের একটা বেটার মোরালিটির দিকে আহ্বান করতে পারি। ইসলামী মতে, সমকামিতার বিচার তখনই হবে যখন কোনো ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হবে। ওই রাষ্ট্রব্যবস্থা এটাকে তার টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনবিরোধী হিসেবে প্রেফার করলে রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গকে তা মানতে হবে।

খেয়াল করুন, দুনিয়ার সব সমাজব্যবস্থারই কিছু মূলনীতি আছে, হোক সেটা লেফট, রাইট বা ন্যাশনালিস্ট সমাজ বা রাষ্ট্র। ওই মূলনীতি যখন এর সদস্যরা ভাঙে তখন সমাজ তার বিচার করে।
আজকে যদি কোথাও একটা lgbt কমিউনিটি সৃষ্টি হয় তারা অবশ্যই নিজেদের ভেতর কিছু নীতিমালা তৈরি করবে। এবং বেশির ভাগ সম্মতিতে তৈরি নীতিমালা অন্য সদস্যদেরও মানতে হবে, না মানলে কমিউনিটি তার বিরুদ্ধে অ্যাকশান নেবে। ঠিক একই জিনিস ঘটে সমাজ ব্যবস্থাগুলোতে।

লেখা অনেক বড় হয়ে গেছে। আরো অনেক কিছু লেখার ছিলো। কারণ এই আর্গুমেন্টগুলো ছোট পরিসরে করার ব্যাপার না।
মানুষকে কোনো একটা আইডোলজি অফার করতে হলে ওই আইডোলজির ভ্যালিডিটি কেন অন্যগুলোর চেয়ে বেশি তা বোঝানোর চেষ্টা করা উচিত। কেবল ব্যক্তিকে ডিকোড করে বা কেবল গালাগালি করে আইডোলজি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। খুব দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে উল্টাটাই হচ্ছে সবপক্ষের ক্ষেত্রে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us