বিনিয়োগের জন্য রিজার্ভে হাত

এম এ খালেক | Apr 13, 2021 01:19 pm
বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন

বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন - ছবি : সংগৃহীত

 

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ক্রমশ স্ফীত হচ্ছে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪ (চার হাজার ৪০০ কোটি) বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশের ইতিহাসে কখনোই রিজার্ভ এতটা স্ফীত হয়নি। আগামী কয়েক মাসে রিজার্ভের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারের ম্যাজিক ফিগার স্পর্শ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ সার্ক দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। শুধু ভারত রিজার্ভ সংরক্ষণে আমাদের উপরে রয়েছে। আমাদের বর্তমান রিজার্ভ পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় সাড়ে তিন গুণ বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ এভাবে স্ফীত হবার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত, করোনারকালীন সময়ে দেশের সব ধরনের আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। বিশেষ করে শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানি কমে গেছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্য পণ্য এবং বিলাসজাত পণ্য আমদানিও কমে গেছে। রপ্তানি আয় অনেকটাই স্বাভাবিক রয়েছে। সব ধরনের ভোগ্য পণ্য আমদানি কমে গেছে। এ ছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহে ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত। এমন কি এই খাতে করোনার কোনো প্রভাব এখনো দৃশ্যমান নয়। চলতি অর্থ বছরের জুলাই মাসে মোট রেমিটেন্স আহরিত হয়েছে ২৬০ কোটি মার্কিন ডলার। এটা এ যাবৎকালের মধ্যে কোনো একক মাসে সর্বোচ্চ। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেকেই করোনারকালীন সময়ে চাকরিচ্যুৎ হয়েছেন। তারা দেশে ফেরার সময় কর্মস্থলে সাময়িকভাবে সংরক্ষিত সমুদয় অর্থ একযোগে দেশে নিয়ে এসেছেন। উপরন্তু স্থানীয় বেনিফিশিয়ারিদের আর্থিক চাহিদা বৃদ্ধির কারণেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা আগের তুলনায় বেশি অর্থ দেশে পাঠিযেছেন। চলতি অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবাসী আয়ের উপর ২ শতাংশ হারে নগদ আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছে। আর্থিক প্রণোদনা পাবার আশায় অনেকেই হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স না পাঠিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠাচ্ছেন। এসব কারণে রেমিটেন্স প্রবাহ আগের চেয়ে বেড়েছে। যদিও এটা কতটা স্থিতিশীল হবে তা নিয়ে সবার মনেই সংশয়।

বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ স্ফীত হতে থাকার কারণে তার বিকল্প ব্যবহার নিয়ে প্রায়শই বিভিন্ন মহল থেকে প্রস্তাব দেয়া হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কিছু দিন আগে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কিভাবে উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা যায় তা ভেবে দেখার জন্য সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারাই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন ফান্ড (বিআইডিএফ) গঠন করা হয়েছে। এই ফান্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের একটি অংশ উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বিআইডিএফ-এর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পায়রা সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন কাজের জন্য ৫ হাজার ৪১৭ কোটি টাকার সম পরিমাণ অর্থ ঋণ হিসেবে দেয়া হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের একক মুদ্রা ইউরোতে এই ঋণ দেয়া হবে। রিজার্ভ থেকে এই প্রকল্পের জন্য তিন বছরে ৫২ কোটি ৪০ লাখ ইউরোর সম পরিমাণ ৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের মেয়াদ হবে ১০ বছর এবং সুদের হার বার্ষিক ২ শতাংশ। ঋণ দেয়া হবে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে। এ জন্য সোনালী ব্যাংক ১ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এক শতাংশ সুদ পাবে। প্রাথমিকভাবে এই ফান্ডের অর্থ অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ খাতের জন্য ব্যবহার করা হবে। বার্ষিক ২০০ কোটি মার্কিন ডলার সম পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা হবে।

আগামীতে এই ফান্ড থেকে ব্যক্তি খাতেও ঋণ দেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। একটি দেশের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংরক্ষিত থাকলেই তাকে সন্তোষজনক বলে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে অন্তত ১০ হতে ১১ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। তাই অনেকেই বলছেন, এই অতিরিক্ত রিজার্ভ অর্থ অলস বসিয়ে না রেখে তা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করা হলে দেশ বিভিন্নভাবে লাভবান হতে পারবে। প্রথমত, রিজার্ভ অর্থ থেকে আয় হবে যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে অর্থের যোগান পাওয়া গেলে বিদেশ থেকে ঋণ নিতে হবে না। এতে দেশের মর্যাদা বাড়বে। উল্লেখ্য, উন্নত দেশগুলো বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ অলসভাবে বসিয়ে না রেখে তা লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে। কাজেই সেই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমরাও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বিনিয়োগের কাজে ব্যবহার করতে পারি। তারা আরো বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে আগামীতে রিজার্ভ অর্থ আরো বৃদ্ধি পাবে। সেই অবস্থায় রিজার্ভ অলসভাবে বসিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না। কাজেই যে কোনো বিচারেই আমাদের রিজার্ভ থেকে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত সুবিবেচনা প্রসূত এতে সন্দেহ নেই। ভারত, চীন, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশ রিজার্ভের বড় অংশ বিনিয়োগ করে থাকে। অবশ্য তারা রিজার্ভের অর্থ সরাসরি ঋণের আকারে বিনিয়োগ করে না। তারা এটা বিভিন্ন বন্ডের মাধ্যমে নিরাপদ বিনিয়োগ করে।

বাংলাদেশে রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগের ব্যাপারে অনেকেই আবার দ্বিমত প্রকাশ করছেন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, বর্তমানে যে স্ফীত রিজার্ভ রয়েছে তা মোটেও স্থিতিশীল নয়। যেসব কারণে রিজার্ভ স্ফীত হচ্ছে সেইসব পরিস্থিতি কিন্তু মোটেও স্থিতিশীল নয়। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে বিনিয়োগ চাহিদা বাড়বে। ফলে আমদানি ব্যয় হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেতে পারে। একই সঙ্গে ভোগ্য পণ্য ও বিলাসজাত পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পেলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ সমর্থন করে বলেছেন, পরিস্থিতি এবং প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় সরকার একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর আগেও এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড গঠন ও বোয়িং কেনার জন্য রিজার্ভ থেকে অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেখানে বিনিয়োগ করা হচ্ছে তার মাধ্যমে যেন বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়। একই সঙ্গে ফরেন এক্সচেঞ্জ আয়ও হয়। অর্থাৎ যত ব্যয় হবে তার চেয়ে বেশি যেন আয় হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রিজার্ভ থেকে অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থ ব্যয় সাহসী সিদ্ধান্তই বটে। কারণ এর সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকাংশে জড়িত। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, স্ফীত রিজার্ভ এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগ একটি দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে ভালো অবস্থার নির্দেশক। এমন কি তুলনামূলক স্বল্প রিজার্ভ এবং পর্যাপ্ত বিনিয়োগও কাম্য হতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই বিনিয়োগবিহীন স্ফীত রিজার্ভ কাম্য নয়। কারণ এটা অর্থনীতির স্থবিরতাই প্রকাশ করে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, রিজার্ভ হচ্ছে একটি দেশের এক্সটার্নাল অ্যাসেট। এটা কোনোভাবেই স্থিতিশীল নয়। যে কোনো সময় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং হ্রাস পেতে পারে।

কাজেই বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগে নিয়ে আসার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ব্যবহার করা যেতে পারে তবে সেটা হতে হবে স্বল্প মেয়াদি সময়ের জন্য। দীর্ঘ মেয়াদে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থেকে অর্থ ব্যয় করা মোটেও উচিৎ হবে না। যে কোনো সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে আর্থিক সঙ্কট দেখা দিলে সেই সময় রিজার্ভ অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। পায়রা সমুদ্র বন্দরে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য যে ঋণ দেয়া হয়েছে তা ১০ বছরের জন্য। চাইলেও বা প্রয়োজন হলেও ১০ বছরের আগে এই ঋণের টাকা পুরোটা আদায় করা যাবে না। বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন ফান্ড থেকে আগামীতে বেসরকারি খাতে ঋণ দানের উদ্যোগ নেয়া হতে পারে। এটা কতটা যৌক্তিক হবে তা নিয়ে ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর বর্তমানে খেলাপি ঋণভারে জর্জরিত। যারা শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা তাদের একটি বড় অংশই ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি। তারা নানাভাবে নীতি নির্ধারকদের প্রভাবিত করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে থাকেন। অনেকেই ব্যাংক ঋণের অর্থ বিদেশে পাচার করেন। কাজেই এমন একটি কালচার যে দেশে দিনে দিনে বেড়ে উঠেছে সেখানে রিজার্ভ থেকে বেসরকারি খাতে ঋণদান কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখার দরকার আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, যেখানে ঝুঁকি বেশি সেখানে মুনাফা বেশি। আর যেখানে ঝুঁকি কম সেখানে মুনাফাও কম। ঝুঁকিপূর্ণ কোনো খাতে রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ করা যাবে না। বিদেশে বিভিন্ন বন্ডে এই অর্থ বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ব্যবহার বা বিনিয়োগ করতে চাইলে প্রথমেই আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এমন কোনো খাতে এই অর্থ বিনিয়োগ করা যাবে না যেখান থেকে কিস্তি আদায়ের ব্যাপারে সংশয় থাকে।

রিজার্ভ থেকে বিনিয়োগের আগে আমাদের স্থানীয়ভাবে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা এবং সরবরাহের সামর্থ্যরে বিষয়টি ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। দেশের আপদকালীন সময়ে কি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন হতে পারে তা নিরূপণের পর উদ্বৃত্ত অর্থই শুধু বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এই বিনিয়োগ হতে পারে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে যেখান থেকে ঋণের কিস্তি আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সঙ্কট থাকলে একটি দেশের অবস্থা কেমন হতে পারে তা আমরা স্বাধীনতাত্তোর কালে প্রত্যক্ষ করেছি। ’৮০দশকে এক সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ ১২৫ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে এসেছিল। সেই সময় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার জন্য বিদেশি দাতাদের কাছে ধর্না দিতে হতো। আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়ে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করতাম। কোনো কারণে দেশের আর্থিক অবস্থা যদি খারাপ হলে দাতারা নানা ধরনের শর্ত চাপিয়ে দেয়।

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হবার চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যেই উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উত্তীর্ণ হবে। এটি হলে বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তি অনেক কঠিন হবে। তখন যদি আমাদের স্ফীত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ থাকে তাহলে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সুবিধা হবে।

বিশ^ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপকালে তিনি বলেন, রিজার্ভ রাখা হয় অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য। বলা হচ্ছে, ৬ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ রেখে অবশিষ্ট অর্থ বিনিয়োগ করা হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে আমাদের অবস্থা কি দাঁড়াবে তা কি আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারছি? আগামীতে প্রতি মাসের আমদানি ব্যয় কত হবে তা কিভাবে নির্ধারণ করা হবে? আমার হিসাব মতে, প্রতি মাসে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় হতে পারে ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার। সেই হিসেবে ৬মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর উদ্বৃত্ত রিজার্ভ থাকবে খুবই সামান্য। ভোক্তা চাহিদা বৃদ্ধি পেলে আগামীতে এই আমদানি ব্যয় আরো বাড়বে। তিনি আরো বলেন, বিদেশি ঋণ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে তাতে স্বচ্ছতা আরো বাড়তো। আর বিপদের সময় আমদানি দায় মেটাতে ঋণ নিলে এখনকার চেয়ে খরচ বেশি পড়বে, শর্তও বেশি থাকবে।

ইন্সটিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস-এর সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী বলেন, প্রত্যেকটি দেশের সেন্ট্রাল ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ সংরক্ষণ করে থাকে। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে কোনো আপদকালীন সময়ে দেশের অর্থনীতিকে সহায়তা করা। যাতে কোনোভাবেই দেশের অর্থনীতি সঙ্কটের মধ্যে না পড়ে। এই অর্থনৈতিক সঙ্কট দেশের অভ্যন্তরীণ হতে পারে। আবার বৈশি^ক সঙ্কটও হতে পারে। অর্থাৎ যে কোনো আর্থিক সঙ্কট থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যই বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ সংরক্ষণ জরুরী। অপ্রত্যাশিত সঙ্কট উত্তরণে দেশকে সহায়তা করার জন্যই রিজার্ভ সংরক্ষণ করা হয়। রিজার্ভ যত বেশি হবে দেশের আর্থিক সঙ্কট মোকাবেলার সামর্থ্য তত বেশি থাকবে। একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বেশি হলে আন্তর্জাতিকভাবেও দেশটির সম্মান বৃদ্ধি পায়। দাতারা সহায়তা দানের ক্ষেত্রে অধিকতর আস্থাশীল হয় দেশটির প্রতি। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সূত্র থেকে ঋণ আনার ক্ষেত্রে দেশটির সুবিধা হয়। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বেশি থাকলে সেই দেশে ঋণদানের শর্ত সহজতর হয়। কারণ ঋণের কিস্তি পরিশোধের সামর্থ্য নিয়ে কোনো সন্দেহ বা সংশয় থাকে না।

উচ্চ মাত্রায় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ আমরা সংরক্ষণ করছি এটা যদি এমনি আগেই বরা হয়েছে রিজার্ভের অর্থ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ করা উচিৎ নয়। বিশেষ করে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ করা ঠিক নয়। কারণ কখন অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ আসবে তা কেউ বলতে পারে না। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা সৃষ্টি হলে আমাদের অর্থের প্রয়োজন হবে। এজন্য সাধারণত স্বল্পকালীন এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ খাতে রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগ করা যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে বর্তমানে যে স্ফীতি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে তা মোটেও স্বাভাবিক নয়। এটা অর্থনীতির এক ধরনের স্থবিরতার লক্ষণ বলা যেতে পারে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এক ধরনের মন্থরতা বিরাজ করছে। অনেক দিন ধরেই ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ জিডিপি’র ২২/২৩ শতাংশে সীমিত রয়েছে। অবশ্য একই সময়ে সরকারি খাতে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। কিন্তু সরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির নেতিবাচক দিক হচ্ছে এতে দেশে দুর্নীতি বৃদ্ধি পায়। অপচয়ের দুয়ার খুলে যায়। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরকার সাধারণত কোনো উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগ করে না। সরকারি বিনিয়োগ হয় অবকাঠামো নির্মাণ কাজে।

বর্তমানে দেশে যে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ হচ্ছে তা অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখে। কিন্তু এই অবকাঠামো নির্মাণ কাজ কতটা স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন হচ্ছে তা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন। দেশের সর্ববৃহৎ মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ প্রায় সম্পন্ন হবার পথে। বলা হচ্ছে, এই সেতু নির্মাণ শেষে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হলে দেশের জিডিপি’র হার অন্তত দেড় শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। কথাটি শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু কিভাবে এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে? পদ্মা সেতু নিজে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে তেমন কোনো অবদান রাখতে পারবে না। পদ্মা সেতুর দুই পাশের্^ যদি ব্যাপকভিত্তিক শিল্পায়ন হয় তাহলেই কেবল এই প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। কিন্তু বিনিয়োগ তো আর এমনি এমনি হবে না। এ জন্য উদ্যোক্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু দেশের বিদ্যমান বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে কতটা উৎসাহী হবেন সেটাই বিবেচ্য বিষয়।

বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ কোনো স্থিতিশীল কিছু নয়। করোনাকালীন অর্থনৈতিক স্থবিরতা কেটে গেলে, অর্থনীতি পুনরায় চাঙ্গা হলে রিজার্ভ হ্রাস পেতে শুরু করবে। যদি বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি যোগান কমে যায় তাহলে আমাদের অবস্থা কেমন হবে তা কি আমরা বিবেচনা করেছি? বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ করে আমরা বাহবা পেতে পারি। কিন্তু এর সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কেও আমাদের সচেতন থাকতে হবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us