জাকাত : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ | May 10, 2021 01:14 pm
জাকাত : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

জাকাত : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ - ছবি : সংগৃহীত

 

সমৃদ্ধ অর্থনীতি ও মানবীয় সংস্কৃতির বিকাশের জন্যই জাকাতের বিধান করেছে ইসলাম। মূলত সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে জাকাত একে অপরকে সুখ-দুঃখের ভাগিদার করে একদিকে যেমন মানবীয় সমাজের বিকাশ ঘটায় তেমনি তৈরি করে সমৃদ্ধ ও স্বনির্ভর অর্থনীতির মজবুত বুনিয়াদ। তাই ইসলামী শরীয়তে জাকাত একটি মৌলিক ইবাদত। প্রত্যেক বালেগ, বুদ্ধিসম্পন্ন, স্বাধীন ও ঋণমুক্ত মুসলমান নেসাব পরিমাণ সম্পদের পূর্ণ একবছরের মালিক হলেই তার উপর জাকাত ফরজ। এটি একদিকে যেমন দাতার ধনসম্পদকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধকরণের মাধ্যমে তার প্রবৃদ্ধি সাধন করে, অন্যদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করে। তৈরি হয় বৈষম্যহীন মানবীয় সমাজ। জাকাত ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ও সম্পদের সুষম বণ্টনের অন্যতম প্রধান উপাদান। একটি সমাজের কিছুসংখ্যক মানুষের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে পড়লে সেখানে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্য দেখা দেয়। এতে মানুষের অভাব অনটন বৃদ্ধি পেতে থাকে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় এবং নৈতিক চরিত্রেরও বিপর্যয় ঘটে। এসব সমস্যা থেকে মানব জাতিকে রক্ষার লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক ধনী মুসলমান ব্যক্তির উপর জাকাত ফরজ ইবাদত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।

জাকাতের শরয়ি দৃষ্টিকোণ

জাকাত পবিত্র কুরআনে বহুলভাবে ব্যবহৃত আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি পাওয়া, পরিচ্ছন্নতা, সুসঙ্ঘবদ্ধতা, পবিত্রতা, প্রশংসা প্রভৃতি। পবিত্র কুরআনের ১৬টি স্থানে এটি সাদাকাহ শব্দে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে ভূমির উৎপাদিত ফল-ফসলের জাকাতকে উশর নামে আখ্যা দেয়া হয়েছে। গচ্ছিত অর্থ, সোনা-রুপা, ব্যবসায়িক পণ্য, গৃহপালিত পশু, খনিজ সম্পদ এবং জমিতে উৎপাদিত ফসলের উপর জাকাত আদায় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর ধর্মীয়, নৈতিক ও নানাবিধ ইতিবাচক উদ্দেশ্য থাকলেও অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আল-কুরআনের ৩২টি স্থানে সরাসরি জাকাত প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কোনো মুসলিম ব্যক্তি জাকাতকে অস্বীকার করলে সে অবশ্যই কাফিরে পরিণত হবে।

খুলাফায়ি রাশিদীনের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকরের রা: খিলাফতকালে আরবের বিভিন্ন গোত্র জাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল। যদিও নামাজ-রোজা পালনে তাদের কোনো আপত্তি ছিল না। মুসায়লামাতুল কাজ্জাব, শাজাহ ও তুলায়হা প্রমুখ ভণ্ডনবীসহ তাদের অনুসারীরা জাকাত অস্বীকারকারীদের এ নীতিকে প্রবলভাবে সমর্থন জানায়। তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিকভাবে কি শাস্তি গ্রহণ করা হবে হজরত উমর রা: তা জানতে চাইলে খলিফা আবু বকর রা: দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, আল্লাহর কসম, আমি অবশ্যই সে লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, যারা নামাজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করবে।

অবশেষে হজরত আবু বকর রা: জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদেরকে পর্যুদস্ত করেছিলেন এবং জাকাতদানে বাধ্য করেছিলেন।

ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণে জাকাতের গুরুত্ব কম নয়। এটি আর্থ-সামাজিক অসাম্য দূরীকরণের এক অপূর্ব ও পরিশীলিত পদ্ধতি। এর মাধ্যমে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মাঝে যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে তা হ্রাস পায়। অসহায়কে দান করা ও দরিদ্র ব্যক্তিকে ধনীদের মাল থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়। সুতরাং সম্পদের সমবণ্টন ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় জাকাতের অবদান অতুলনীয়; যা ব্যক্তিগত শোষণ ও সামষ্টিক স্বেচ্ছাচারিতার পথ বন্ধ করে।

বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনীতিবিদরা যে সমস্ত তত্ত্ব ও কৌশল উদ্ভাবন করেছেন তার কোনোটিই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। কেননা সেখানে আয়ের ভিত্তি সুদ নামক শুভঙ্করের ফাঁকি ও শোষণের উপর নির্ভশীল। যেখানে অন্যের শ্রম শোষণ করে মুনাফা বৃদ্ধি করতে নিষেধ নেই, যেখানে নৈতিকতার কোনো মূল্য নেই সেখানে কর ফাঁকি দিয়ে মুনাফা বৃদ্ধির কাজ জোরেশোরে চলবে এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে জাকাত শুধু একটি অর্থনৈতিক সমতাবিধান পদ্ধতিই নয় বরং এটি একটি ইবাদত যা ধনবান মুসলমানদের উপর ফরয করা হয়েছে।

জনকল্যাণে নানাবিধ আইন পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান হচ্ছে রাষ্ট্র। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে প্রেরণের কারণে এর সঠিক বাস্তবায়ন রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি ছাড়া সম্ভব নয়। সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান, রাজনৈতিক নীতিপদ্ধতি, আইন-আদালত ও বিচারিক নিয়মনীতি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সামরিক নীতিকৌশল, বৈদেশিক সংযোগ এমনকি ধর্মীয় হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নের পরিবেশও রাষ্ট্রশক্তির উপর নির্ভর করে। পবিত্র কুরআনে সুরাহ আল হাজ এর ৪১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তাদেরকে পৃথিবীতে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করলে তারা সালাত কায়েম করবে, জাকাত আদায় করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে, আর প্রত্যক কাজের পরিণাম আল্লাহরই।

এ আয়াতের সূত্র ধরেই মুসলিম ফকিহদের ঐকমত্য যে, দারিদ্র্যবিমোচন ও স্বনির্ভর অর্থনীতির জন্য জাকাত আদায় এবং তা বণ্টনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ লিখেছেন যে, ‘জনগণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য রাষ্ট্র উৎপাদন, বণ্টন, বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং পূর্ত কর্মসূচির আঞ্জাম দিবে।’ ইমাম গাজালির মতে, ইসলামী শরিয়াহ প্রতিটি মুসলমানের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেয় এবং তা সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দেয়। এর একটি হলো প্রত্যেকের ন্যূনতম মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করা, যার মধ্যে রয়েছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং এমন অন্যান্য আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় বিষয় যা স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য অপরিহার্য বলে বিবেচিত। সাম্প্রতিককালের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ শহীদ সাইয়্যেদ কুতুব, ড. ইউসুফ আল কারজাবি, ড. নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী প্রমুখ মনীষী এ মর্মে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন যে, প্রতিটি মুসলিম সরকারের দু’টি যৌথ দায়িত্ব রয়েছে। যেমন, (ক) প্রত্যক নাগরিকের জন্য ন্যূনতম মানের জীবন-যাপনের নিশ্চয়তা বিধান করা এবং (খ) মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হতে না দেয়া। কাজেই দরিদ্র জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সরকারের অংশগ্রহণ শুধু প্রয়োজনই নয়; বরং অপরিহার্য। এজন্য জাকাত একাকী নয়; বরং সামষ্টিকভাবে আদায় ও বণ্টন করতে হবে। মহানবীর সা: যুগ থেকে শুরু করে খুলাফায়ি রাশিদার শাসনামল এবং পরবর্তী মুসলিম খিলাফতেও রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত ব্যবস্থাপনা সুচারুরূপে সম্পন্ন করা হতো।

বাংলাদেশে জাকাতপদ্ধতি

বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমানের বসবাস। বিশ্বাসে নিঃশ্বাসে আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নামের প্রতি সম্মান জানিয়ে থাকি। আনুষ্ঠানিক ও দৃশ্যমান ইবাদত এবং পোশাকি ইসলামের ব্যাপারে আমাদের রাষ্ট্রীয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে একজন সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত প্রায় সকলেই যতœবান থাকি। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি সরকারিভাবে ইনকামট্যাক্স সংগ্রহের জন্য রাজস্ব বোর্ডের নানামুখী উদ্যোগ থাকলেও জাকাত সংগ্রহ ও তা বণ্টনের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো উদ্যোগ আমাদের সমাজে নেই।
জাকাতের মূল উদ্দেশ্যে হলো, জাকাত গ্রহীতাকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার মাধ্যমে গ্রহীতার পর্যায় থেকে দাতার পর্যায়ে নিয়ে আসা। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে জাকাত দানের ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন তো হচ্ছেই না; বরং দরিদ্র শ্রেণীকে ভিক্ষুকে পরিণত করা হচ্ছে। কেননা জাকাতপ্রার্থীকে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে জাকাতের কাপড় কিংবা পয়সা সংগ্রহের জন্য। এটা ক্রমশ ভিক্ষুকের মতো হাতপাতার অভ্যাস তৈরিতে সাহায্য করছে। তা ছাড়া জাকাত যে সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি, তার সুফলও পাওয়া যাচ্ছে না। যদি সরকারি উদ্যোগে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাধ্যবাধকতার সাথে জাকাত সংগ্রহ এবং পরিকল্পনা মাফিক তা বণ্টনের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে দেশের দারিদ্র্য অনেকাংশে হ্রাস পেত। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের ব্যবস্থা চালু করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

পুনর্বাসন, দায়মুক্তি ও স্বাবলম্বীকরণ

মহানবী সা: তাঁর উম্মতগণকে এটি দেহের সাথে তুলনা করেছেন। একে অপরের অভাব-অভিযোগ, সুখ-দুঃখ সবাই মিলে উপলব্ধি করবে। তাই আল-কুরআনে সুরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে বর্ণিত জাকাতের অর্থ ব্যয়ের যে আটটি খাতের কথা বলা হয়েছে তাতে প্রথম খাতেই রয়েছে দরিদ্র ও অভাবী লোকদের মধ্যে জাকাতের অর্থসামগ্রী বণ্টন করা। এতে শুধু অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তা নয়; বরং অর্থনেতিক কার্যক্রম গতিবেগের সঞ্চায় হয়। জাকাতের অপর কল্যাণধর্মী দিক হলো, ঋণগ্রস্তদের ঋণ মুক্তি ও প্রবাসে বিপদকালে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা লাভ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দুর্ঘটনা বা অন্য কোন প্রয়োজন মোকাবেলার কারণে যদি কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং সে ওই ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে তাহলে জাকাতের অর্থ দিয়েই তার এ সঙ্কট মোচন করা যেতে পারে। দেউলিয়া হয়ে সমাজে অসম্মানিত জীবন যাপনের গ্লানি মোচনে জাকাত এক মোক্ষম হাতিয়ার। এতে শুধু সমাজই নয়, রাষ্ট্রও উপকৃত হয় সমানভাবে। দরিদ্রতা যে কোনো দেশ ও সমাজে একটি জটিল এবং তীব্র সমস্যা। অধিকাংশ সামাজিক অপরাধও ঘটে এই দরিদ্রতার জন্য। এ সমস্যার প্রতিবিধান করার জন্য জাকাত ইসলামের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। জাকাত ও ‘উশরের অর্থ সম্পদ প্রাপ্তির ফলে দরিদ্রের জীবন যেমন আনন্দ ও নিরাপদ হয় তেমনি তাদের পুনর্বাসনেরও সুযোগ তৈরি হয়।

জাকাতের অর্থ দিয়ে দরিদ্র, নিঃস্ব ও বেকারদেরকে কর্মক্ষম করার জন্য পুনর্বাসন এবং কল্যাণধর্মী কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। এ প্রস্তাবিত কর্মসূচির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, এতিম, বিধবা, প্রতিবন্ধীদের প্রতিপালন ও পুনর্বাসন, বৃদ্ধদের জন্য মাসোহারা, কন্যাদায়গ্রস্তদের বিবাহ সম্পাদনে সাহায্য-সহযোগিতা, ঋণগ্রস্ত কৃষকদের জমি অবমুক্তকরণে সাহায্য, শরণার্থী সহায়তা ও উদ্বাস্ত পুনর্বাসন এবং অভাবী সাধারণ জনগণের সুচিকিৎসার জন্য ইউনিয়নভিত্তিক মেডিক্যাল সেন্টার স্থাপন। এছাড়া জাকাতের অর্থ দিয়ে গরিবদের জন্য স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করে দেয়ার নিমিত্তে রিকশা, ভ্যান, ইজি বাইক কিনে দেয়া থেকে শুরু করে স্থায়ীভাবে বিভিন্ন ধরনের হালাল ব্যবসায় পুঁজি জোগান দিয়ে তাদেরকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করা যেতে পারে।
শিক্ষা ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি

শিক্ষাই জাতিকে ঘুরে দাঁড়াতে শেখায়। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠীই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায় সামনের দিকে। বাংলাদেশের মতো একটি মধ্যম আয়ের জনবহুল দেশে জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা এখন সময়ের দাবী। এক্ষেত্রে জাকাতের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়েও শিক্ষা ও প্রশিক্ষণমূলক অনেক কর্মসূচির বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্য জাকাতের অর্থ দিয়ে গরিব ছাত্রদের বই কিনে দেয়া থেকে শুরু করে তাদের শিক্ষা জীবনের বিভিন্নপর্যায়ে শিক্ষা বৃত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে কম্পিউটারসহ নানা রকমের প্রযুক্তি নির্ভর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে গরিব ও মেধাবী জনশক্তিকে অধিকতর উৎপাদনমুখী করা যেতে পারে এই অর্থ দিয়েই। এ ছাড়া ইসলামী সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য জাকাতের অর্থ ব্যয় করে নানারকম প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে জনসাধারণকে পরিশীলিত ও মননশীল রূপে গড়ে তোলার উদ্যোগও গ্রহণ করা যেতে পারে।

কর্মসংস্থান ও গৃহায়ণ কর্মসূচি

জাকাতের অর্থ দিয়ে কর্মস্থান তৈরির মাধ্যমে নিঃস্ব ব্যক্তিদের ভিক্ষার হাতকে কর্মীর হাতে রূপান্তরিত করে উৎপাদনও বৃদ্ধি করা সম্ভব। গরিব কৃষকদের হালচাষে সহায়তা করা, যোগ্যতা অনুসারে বেকার অসহায় মানুষকে চাল, চিঁড়া-মুড়িসহ শুকনো খাবার তৈরি, নার্সারি প্রতিষ্ঠা, তাঁতসামগ্রী তৈরি, হাঁস-মুরগি পালন, মাছের চাষ, সেলাই মেশিন, ইলেকট্রিকসামগ্রী মেরামত, রিকশা-ভ্যান তৈরি ও মেরামত ইত্যাদি প্রশিক্ষণমূলক প্রকল্প গ্রহণে সহায়তার মাধ্যমে ক্ষুদ্র আকারের উৎপাদনমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করা। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়, যেমন মুদি দোকান, চায়ের স্টল, মিষ্টি দোকান, মাছের ব্যবসা, ফলের ব্যবসায় ইত্যাদি পরিচালনা করার জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি এককালীন প্রদান করাও যেতে পারে। সেই সাথে দারিদ্র্যবিমোচনে তাদের জন্য প্রয়োজনপরিমাণ কৃষিজমি ক্রয় করে চাষবাসের ব্যবস্থা করা এবং বেশি সংখ্যক বেকার ও অসহায় মানুষের কর্মসংস্থান হয় এমন কলকারখানা স্থাপনের ব্যবস্থা করা।

নারী উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি

নারী-পুরুষ মিলেই গঠিত হয় সমাজ। আদর্শ সমাজকাঠমো বিনির্মাণে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও রয়েছে মুখ্যভূমিকা। এ জন্য ইসলাম নারীদেরকে পুরুষের সমমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। আধুনিক বিশ্বে নারী উন্নয়ন ছাড়া সমাজকে সঠিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। উপযুক্ত শিক্ষা ও সহযোগিতামূলক মানসিকতার অভাবে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদ এবং শহরতলি এলাকাসমূহে নারীরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তাই গরিব, দুঃস্থ, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তাসহ অসহায় প্রতিবন্ধী নারীদেরকে জাকাতের অর্থ দিয়েও শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও কর্মক্ষম করে গড়ে তোলা যেতে পারে।

ইসলাম সম্প্রসারণ কর্মসূচি

আল্লাহর জমিনে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার এ ফরজ কাজকে এগিয়ে নেয়ার জন্য জাকাতের অর্থ ব্যয় করার নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত ব্যক্তিদের জীবিকা নির্বাহ ও পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে। ইসলাম বিরোধীদের অপতৎপরতা মোকাবেলা করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ইসলামী পাঠাগার স্থাপন করাও যেতে পারে।

বাস্তবায়ন পদ্ধতি

রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত আদায় ও বণ্টন ব্যস্থাপনাই ইসলামের নীতি। যেহেতু বাংলাদেশে সরকারিভাবে জাকাত আদায় ও বণ্টনের জন্য বাস্তবভিত্তিক কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই নিজস্ব পরিমণ্ডল ও সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় এ ব্যাপারে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জাকাত ব্যবস্থাপনা বিভাগকে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনার আলোকে এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চালানো। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশে প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকসমূহের জাকাতফান্ডকে দারিদ্র্যবিমোচনমূলক বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে জনকল্যাণে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গণআস্থা অর্জনের চেষ্টা করা। তৃতীয়ত বাংলাদেশের রাজধানী, বিভাগীয় ও জেলা শহর থেকে শুরু করে বিভিন্ন মফস্বল এলাকায় নিজস্ব পরিমণ্ডলে অর্থনৈতিক সংস্থা অথবা এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা যায়। তার মাধ্যমে জাকাতের অর্থ সংগ্রহ করে দারিদ্র্যবিমোচনে গরিবদের জন্য স্থায়ী আয়ের নানাবিধ কল্যাণমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। চতুর্থত ব্যক্তি উদ্যোগে জাকাতের ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা করলেও তা যেন দারিদ্র্যবিমোচনে খানিকটা হলেও ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা।

উপসংহার

বাংলাদেশের মতো একটি দেশে দারিদ্র্যবিমোচনের মাধ্যমে স্বনির্ভর অর্থনীতি ও মানবীয় সংস্কৃতির বিকাশে জাকাতের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে দারিদ্র্যবিমোচনে মানব কল্যাণমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করলে সমাজের পুঁজিহীন নিঃস্ব খেটে খাওয়া মানুষের জন্য যেমন বেঁচে থাকার একটি বড় অবলম্বন হবে তেমনি ধনী ও গরিবের ব্যবধানও অনেকাংশে হ্রাস পাবে। এছাড়া পুঁজিবাদী আগ্রাসন ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের ফলে বাংলাদেশের শহর নগর থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনপদে যে অপরাধপ্রবণতা দেখা দিয়েছে তারও মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে। এজন্য দারিদ্র্যবিমোচনে জাকাতের অর্থ থেকে এককালীন দান অথবা সুদমুক্ত করজে হাসানা প্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রয়াস চালানো দরকার।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us