বিয়ের পর মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি

শাহীন চৌধুরী ডলি | May 13, 2021 02:02 pm
বিয়ের পর মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি

বিয়ের পর মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি - ছবি : সংগৃহীত

 

বাবার বাড়ি প্রতিটি মেয়ের সবচেয়ে আপন আলয়। কিন্তু বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি যেতেই হয়। এটাই আমাদের সমাজের প্রচলিত রীতি। শ্বশুরবাড়ি যাওয়া নিয়ে সব মেয়ের মনেই এক রকম আতঙ্ক থাকে। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি কেমন হবেন। আদৌ তাদের সঙ্গে মানিয়ে চলা যাবে কি না, ছেলে-বৌয়ের ব্যক্তিগত বিষয়ে তারা কতটা নাক গলাবেন এসব নিয়ে কমবেশি সব মেয়ের মনেই চিন্তা থাকে।

সময়ের সাথে সাথে মেয়েদের জীবনেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। অনেক মেয়েই হোস্টেলে থেকে বা মেসে থেকে পড়াশোনা করে। কর্মসূত্রেও অনেক মেয়ে বাড়ির বাইরে থাকে। ফলে নিজেদের মতো করে থাকতে থাকতে তারা তাদের নিজস্ব এক ধরনের জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের জীবনযাপনে স্বাধীনতা থাকে। সেখান থেকে পুরাপুরি সংসারের ঘেরাটোপে মানিয়ে নিতে কারও কারও সমস্যা হয়। আর যদি শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, দেবর, ননদদের সাথে থাকতে হয় তাহলে সমস্যা আরো বেড়ে যায়। কারণ সেখানে নিজের ব্যক্তিগত স্পেসটা সঙ্কুচিত হয়ে আসে।

বিয়ের পর নতুন মানুষ, নতুন সংসারে একটু আধটু অসামঞ্জস্য থাকতেই পারে। তবে একটা মেয়েকে মাথায় রাখতে হবে, যে মানুষটিকে ভালোবেসে আপনি একটি সংসারে এসেছেন তার পরিবারকে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করা যাবে না। পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সুন্দর এবং মজবুত সম্পর্ক গড়ে তোলাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। শ্বশুরবাড়ি মানেই আপনার স্বামীর পরিবার। আর তার পরিবার মানেই সেটি আপনার পরিবার, আপনার সংসার। যখন এমন ধারণা কারো মাথায় ঢুকে যায় যে এটা আমার পরিবার নয়, অন্য পরিবার, এখানে আমি হুট করে এসে পড়েছি, আমার পরিবার আমি ফেলে এসেছি- তখন শ্বশুরবাড়ির সবাইকে প্রতিপক্ষ বলে মনে হতে থাকে। শ্বশুরবাড়ি কখনোই প্রতিপক্ষ নয়। তাদেরকে নিজের পরিবারের সাথে নতুন সংযোজন বলে ভাবুন।

আপনার স্বামী এই পরিবারের ভালোবাসায়, স্নেহে, যত্নে বড় হয়েছেন। পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে তিনি এই পরিবারকেই বেশি ভালোবাসেন। তার ভালোবাসার মানুষ তাই আপনারও ভালোবাসার মানুষ। বাবার বাড়ির সাথে শ্বশুর বাড়ির তুলনা করবেন না। সম্পর্কে তিক্ততা আসতে দেবেন না। নিজের মনে ইগো বা অহংকারের স্থান দেবেন না। নতুন পরিবারটিকে ভালোবাসুন। দুটো পরিবারের পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাই তুলনা চলে না। প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব কিছু নিয়ম কানুন আছে। এগুলোকে সম্মান করুন। হয়তো নতুন পরিবারে নিজেকে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে; কিন্তু মানিয়ে নিতে পারব না- এমন মনোভাব ত্যাগ করুন।

স্বামীর সহযোগিতা নিয়ে নতুন পরিবারকে জানার চেষ্টা করুন। তিনিই হবেন আপনার সবচেয়ে বড় সহযোগী। আত্মীয়-স্বজনদের চিনুন, তাদের সাথে নিজ থেকে আলাপ করুন। কোন বিষয়ে অস্বস্তি বোধ করলে সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। বাড়ির শিশুদের সাথে মিশুন। তাদের আদর করুন, তাদের সাথে গল্প করুন, পড়াশোনা বা ছবি আঁকায় সাহায্য করুন, তাদের পছন্দের খাবার তৈরি করে দিন। শিশুদের সাথে আপনার সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠলে বাড়ির বড়রাও আপনার ব্যাপারে ভালো মনোভাব পোষণ করবেন।

বাড়ির বড়দের সম্মান করুন। বেয়াদবি হয় এমন আচরণ তাদের সাথে করবেন না। পরিবারের সবার সাথে একই সময়ে একই সাথে খাবার টেবিলে বসে আহার করুন। অন্যদের সাথে পারিবারিক আলোচনায় যুক্ত হোন কিন্তু নিজের মতামত আগ বাড়িয়ে দিতে যাবেন না। পুরো বিষয়টা আগে বুঝুন তারপর ভাবুন মতামত দেয়া সঙ্গত কি না। তারপর মতামত দেবেন তবে তা যেন কাউকে আঘাত না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখুন। অবসর সময়ে শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে গল্প করুন। তাদের পুরনো দিনের গল্প শুনুন, এতে তারা আনন্দিত হবেন। শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজের বাবা-মায়ের স্থানে বসান। সম্পর্ক করে তুলুন মধুর।

সংসারের ছোট ছোট বিষয়ে সাহায্য করুন। ঘর গোছানো বা রান্নার ব্যাপারে আপনার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। তবে একটু সতর্ক থেকে কাজটি করার আগে শাশুড়ি বা ননদের কাছে জেনে নিন- তারা কাজটা কিভাবে করেন। প্রত্যেক বাড়িতেই কাজের আলাদা কিছু নিয়ম থাকে সেগুলো জেনে নিয়ে কাজ করলে দেখবেন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এটাতে আপনি ছোটো তো হবেনই না বরং পরিবারের কাছে অধিক আদরণীয় হয়ে উঠবেন।
যদি পরিবারের সাথে না থেকে আলাদা থাকেন তাহলে শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। ফোনে তাদের খোঁজখবর নিন। সারাদিন কি কি করলেন সে সম্পর্কে তাদের সাথে গল্প করুন। এতে সম্পর্কের বাঁধন মজবুত হবে। ননদ-ভাবীর সম্পর্ক হোক বোনের মতন, দেবর বা ভাসুরের সাথে সম্পর্ক যেন হয় ভাইয়ের মতো।

আপনি বা আমি, আমরা কেউই সম্পূর্ণ নির্ভুল মানুষ নই। ভালো দিক বা বিরক্তিকর দিক সবারই আছে। সম্পর্কের শুরু থেকে স্বামীর প্রশংসা করুন। স্বামীর পরিবারের সদস্যদের কাছে তার কোনো আচরণ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করতে যাবেন না। আপনার স্বামীর পরিবারের সদস্যরা আগে থেকেই তাদের সন্তানের ভালো-মন্দ ব্যাপারগুলো জানেন।

সঙ্গীর উপর ভরসা রাখুন। তিনি এমন কিছু করবেন না যাতে আপনার খারাপ হয়। তিনি এমন কিছু চাইবেন না যাতে আপনার ক্ষতি হয়। যেকোনো সমস্যা স্বামী-স্ত্রী দু’জন মিলে সমাধান করুন। সঙ্গীর মা-বাবা, ভাইবোনের সাথে কোনো বিষয়ে মানিয়ে নিতে সমস্যা হলে অনুযোগ, অভিযোগ না করে সমস্যাটি নিয়ে সঙ্গীকে বলুন। সমস্যা সমাধানে তার পরামর্শ চাইতে পারেন।

আপনার দাম্পত্য সম্পর্ক হোক মধুর। পরিবারের কোনো সদস্যদের সাথে সমস্যা হতেই পারে। তাতে প্রথমেই সিরিয়াস হবেন না। প্রথমে ভালোভাবে বুঝুন, আদৌ সেটা সিরিয়াস কি না। যদি মনে হয় সিরিয়াস তাহলে বিনয়ের সাথে শাশুড়ির সাথে সরাসরি কথা বলুন। নিজের চেষ্টাতেই ভালো সমাধান করার চেষ্টা করুন।

সুখী দাম্পত্য জীবনের সহজ রহস্য সম্পর্কে আপনাকে জানতে হবে। কোনো সমস্যাকে নেগেটিভভাবে না নিয়ে, বোঝার চেষ্টা করুন। এই সময়টা একে অন্যকে জানার, ভালোবাসার। ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে নিজেদের মানসিক শান্তি নষ্ট না করে বুদ্ধিমত্তার সাথে এগুলো সামলে নিন। দেখবেন কয়েক মাস যেতে না যেতেই নতুন পরিবারটিও আপনার আপন হয়ে গেছে।

সবসময় স্বামীকে আঁচলে বেঁধে রাখতে হবে এমন মনোভাব ত্যাগ করুন। সবসময় একসাথে থাকতে হবে, কোথাও যেতে হবে- এমন না করে স্বামীকে মাঝে মধ্যে বলুন বাবা-মায়ের সাথে বেড়িয়ে আসতে। তাদের জন্য স্পেস তৈরি করে দিন। আর আপনিও নিজের বাড়ি থেকে সময় কাটিয়ে আসুন। দেখবেন সম্পর্ক ভালো থাকবে।
সন্তানরা যাতে দাদা-দাদীর সাথে সময় কাটাতে পারে সেদিকে নজর দেবেন। শিশুদের কখনোই তাদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না। যদি দূরে থাকেন তাহলে নিয়ম করে অবশ্যই তাদের সাথে সন্তানদের নিয়ে দেখা করুন। অদূরবর্তী স্থানে কাছে থাকলে সপ্তাহান্তে আসুন, খুব দূরে থাকলে মাঝেমধ্যে এসে কয়েকদিন তাদের সাথে কাটিয়ে যাবেন।

বৌমা যেমন শ্বশুরবাড়িকে আপন করে নেবে তেমনি বৌমাকেও আপন করে নেয়ার দায়িত্ব শ্বশুরবাড়ির সবার। আজকালকার মেয়েরাও নিজের কর্মজগতে অত্যন্ত ব্যস্ত। ফলে কাজের শেষে নিজেদের কাজ গুছিয়ে সবার সাথে গল্প করার সময় খুব একটা থাকে না। দিন অনেক বদলেছে। অনেক শাশুড়ি আশা করেন বৌমা রান্না করবে, চা-নাশতা দেবে, ঘর গুছাবে। বিয়ের পর প্রথম দিকে কিছুদিন করলেও দিনের পর দিন এভাবে করা সম্ভব নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বৌমার সমস্যাটাও শাশুড়িকে বুঝতে হবে।

বৌমাকে নিজের মেয়ের স্থানে বসিয়ে দেখতে হবে। অনেক মা ভাবেন, বিয়ের পর ছেলেকে বৌমা দখল করে নিয়েছে। ছেলে বৌমার কথাকে যতটা গুরুত্ব দেয়, তার কথাকে ততটা গুরুত্ব দেয় না। সেই সাথে ভাবে ছেলে যাবতীয় ভালো কিছু বউকেই দিয়ে দিচ্ছে। এমন ধারণা ঠিক নয়। শাশুড়িকে বুঝতে হবে, বউমার সাথে তার কোনো প্রতিযোগিতা নেই। বয়সেও বউমা অনেক ছোট। তাকে সন্তানের দৃষ্টিতে দেখুন, সেভাবে ভালোবাসুন। সে-ও আপনাকে মায়ের মতো ভালোবাসবে, শ্রদ্ধা করবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us