রেকার বাণিজ্যের নানা কথা

সাকিব সাদমান | Jun 01, 2021 04:52 pm
রেকার বাণিজ্যের নানা কথা

রেকার বাণিজ্যের নানা কথা - ছবি সংগৃহীত

 

রাজধানীর যানজটের জন্য এখন খোদ পুলিশকেই দায়ী করছেন অনেকে। পুলিশের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ অনুবিভাগই ঢাকার যানজটের নিরসনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। ভিভিআইপি আর পুলিশের গাড়ি পার করার ক্ষেত্রে অবশ্য পুলিশ বেশ পারঙ্গম- বলাই হয়, ভিভিআইপি আর ঊর্ধ্বতন পুলিশকর্তাদের ঠিকঠাক পার করতে পারলেই চাকরি রক্ষে। একটা কথা এখন তেমন উচ্চারিত হয় না; পুলিশের স্বল্পতা কিংবা যানবাহনের সঙ্কট- দুটোই বেশ বেড়েছে এতটাই যে, সরকারের অন্য কোনো দফতরের সাথে তুলনা চলে না। রাজধানীতে থানা বেড়েছে দেশের ব্যাংক বৃদ্ধির মতোই। কাজ হচ্ছে কি? এক ওসি বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ কিংবা সিলেট শহর নিয়ন্ত্রণ করতেন। এখন তার স্থলে কমিশনার, একাধিক অতিরিক্ত কমিশনার, ততোধিক ডিসি-এডিসি এবং গণ্ডা-ডজন থানা বানিয়েও সবকিছু সামাল দেয়া যাচ্ছে না। কাঙ্ক্ষিত সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে? আবার ঢাকার তিন-চার রাস্তার ব্যস্ত মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের স্বল্পতাও দেখা যায়।

ঢাকা শহরের রাস্তায় যত্রতত্র মোবাইল কোর্ট চোখে পড়ার মতো। এর কোনো দিন কিংবা সময় নেই- ইচ্ছে হলেই হলো। সেটা যানজটবহুল রাস্তায়ও হতে পারে; পেছনে কত বড় গাড়ির লাইন সেটি কোনো বিবেচনার বিষয়ই নয়, যেন মানুষের ভোগান্তিও কোনো ব্যাপার নয় এক্ষেত্রে। রাজধানীতে গাড়ির নানা রকমের কাগজপত্র দেখার এখতিয়ার পুলিশকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন স্তর সেটি দেখবে তা সুনির্দিষ্ট করে জানে না আমজনতা। ফলে কনস্টেবল থেকে শুরু করে সবাই গাড়ি ধরছেন; যখন ইচ্ছা তখন। ফলে ক্ষমতার অপব্যবহার হতেই পারে, হয়তো হচ্ছেও। দুষ্টুজনরা বলে, পুলিশের যখনই কিছু টাকার দরকার হয়- লাগাও মোবাইল কোর্ট।’ একটু দূরে দাঁড়িয়ে মোটরসাইকেলচালক থেকে কিছু নিতেও দেখা যায়; মানছি, ওরা কনেস্টবল/এএসআই বা তার ওপরের কেউ নন।

মোবাইল কোর্ট ছাড়াও তল্লøাশির জন্য চেকপোস্ট বসানো হয়। চেকপোস্ট বসানোর জন্য এক প্রকার প্রতিবন্ধক দেয়া হয়, সেটা প্লাস্টিক বা লোহার তৈরি বাক্স ধরনের- এসব আবার এখন সৌজন্যেই পাওয়া যায়; এসব বিনে পয়সায় নিলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে সমস্যার কথা আর এই সময়ের পুলিশ বিবেচনায় নিচ্ছে না আপন বিষয়। রাতে চেকপোস্ট বসানো হলো তো, সারাদিনই সেই বক্স রাস্তার মধ্যে কিংবা একপাশে শোভা পায়। এগুলো সরানোর দায় যেন কারো নেই। সাধারণরা এটিতে হাত দেয় না, পুলিশের এসব ছুঁলে আবার কী কী হয়। আর পুলিশ এসব সরানোর ব্যাপারে রা করেন না। অথচ প্রশস্ত রাস্তাকে সরু করে দিনের বেলায় এসব বক্সই যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে থাকে। পুলিশ দেখে, দেখেও না- সৃষ্টি হচ্ছে জনদুর্ভোগ। বইমেলায় ওয়াচ টাওয়ার নামে দোয়েল চত্বরের পশ্চিম পাশে একটা টাওয়ার বসায় পুলিশ, সেটি মেলা শেষ হওয়ার দু’মাস পরও সরেনি।

মোবাইল কোর্টের ক্ষেত্রে দু’টি মৌলিক পরিবর্তনের দেখা মেলে। দুটিই অযৌক্তিক, হয়রানিকর এবং অমানবিক। প্রথমত, ‘মোবাইল কোর্ট থেকে প্রাপ্ত অর্থের হিস্যা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সাথে সম্পৃক্তরা পাবেন’। যারা এটি করেছেন, ভাবেননি যে, এতে হয়রানি বেড়ে যাবে। সামান্য ত্রুটির কারণেও জরিমানা করার ঘটনা ঘটবে। গাড়ির কাগজপত্র আর চালকের দোষ ধরা খুবই সহজ । সহনীয় দৃষ্টিতে দেখার চেয়ে এই হিস্যা পদ্ধতি মানুষের হয়রানির উপাদান হয়ে দেখা দিচ্ছে। এতে দুর্ঘটনা কমছে না, যানজটও কমছে না। এই দেশে আইন প্রয়োগকারীরা সতর্কতার সাথে আইন প্রয়োগ করেন না- এমন নজির থাকার পরও হিস্যা ভাগাভাগির এই কারণ বোধগম্য নয়।

অধিক আয়ের জন্য তাই বাড়ছে মোবাইল কোর্ট। দ্বিতীয়ত, এসআই-সার্জেন্টদের মোবাইল কোর্ট করার ‘মাসিক টার্গেট’ নির্ধারণ। ঘোরতর অন্যায় এটি। মোবাইল কোর্ট চালু হবে অপরাধের সাথে তাল রেখে; এখানে টার্গেট করে দিলে অপরাধ হোক বা না হোক টার্গেট পূরণ তথা চাকরি রক্ষার জন্য আইনের অপপ্রয়োগ হবেই। মাসে মাসে আসামি ধরার ওপর চাকরি দাঁড়িয়ে গেলে নিরপরাধও গ্রেফতার হবেন। এখন তো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই অলক্ষ্যে ক্যামেরায় ছবি তুলে জরিমানার জন্য ডাকা হচ্ছে খোদ রাজধানীতেই। এই ডিজিটাল পদ্ধতির অপপ্রয়োগও অসম্ভব নয়। বিশেষ করে, পুলিশের কতিপয় সদস্যের নানা কর্মে গোটা পুলিশ বাহিনীর ওপরই মানুষের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। সৎ-যোগ্যদের হাতে না হোক, অসৎদের দ্বারা অলক্ষ্যে এই জরিমানা আরোপ করা হলে মানুষের বিশ্বাসহীনতা বেড়ে যেতে পারে।

পুলিশকে রেকার দেয়া হয়েছিল দু’-তিনটি কাজের জন্য। দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ির উদ্ধার কাজ, রাস্তায় অকেজো গাড়ি পড়ে থেকে যেন যান চলাচলে বিঘ্ন না ঘটায় সেটি নিশ্চিতকরণ, এবং দুর্যোগকালে জনসহায়তা। কিন্তু ঢাকা শহরে সেটি এখন মরণ ফাঁদ হিসেবে আভির্ভূত হয়েছে। গাড়ি রেখে কিছু একটা কিনতে গেলেন- বেরিয়ে দেখবেন, আপনার গাড়ির সামনে রেকারের চেইন লেগে গেছে- না, নিয়ে যাবে না, জরিমানা গুণতে হবে। এর জন্য কোনো রসিদ দিতে বাধ্য নয় পুলিশ। আবার রসিদ মিললেও সেটি সরকারি নির্ধারিত ফরমে যেমন নয়; আবার বিভিন্ন ধরনের, ভিন্ন ভিন্ন রঙের; টাকার অঙ্কেরও কোনো মিল নেই- ‘যার থেকে যতটা নেয়া যায়। অর্থাৎ এই জরিমানার টাকা সরকারি কোষাগারে যাচ্ছে কি না। সেই প্রশ্নের মীমাংসা হচ্ছে না। ফলে রেকার এখন মূল লক্ষ্য হারিয়ে বাণিজ্যে নেমেছে।

যে জায়গায় গাড়ি রাখার কথা নয়, সেখানে গাড়ি রাখলে জরিমানা করা হবে। সকালে গাড়ি ছিল, দুপুরেও ছিল, ছিল ১৫ মিনিট আগে- একজন কী করে বুঝবেন, এখানে গাড়ি রাখলে রেকার টেনে নেবে? পুলিশ তাঁর কথা শুনতেও রাজি নয়, বলতেও রাজি নয়। লক্ষ্য একটাই, বাণিজ্য। পুলিশের স্থির করার কথা নয় যে, কোথায় গাড়ি রাখলে অপরাধ হবে। রাস্তার মালিক সিটি করপোরেশন কোনো সাইনবোর্ডও ঝুলিয়ে দেয়নি। শত শত বিপণি বিতান, রাস্তার পাশে দোকান-পাট, অফিস; কর্তৃপক্ষকেই নির্দিষ্ট করতে হবে কোনটি পার্কিং এলাকা, কোনটি নয়। সব বড় শহরেই রঙ দিয়ে মার্কিং করা থাকে- পার্কিং, নন-পার্কিং, ফি দিয়ে পার্কিং, নির্ধারিত সময়ের জন্য পার্কিং। এখানে কিছুই নেই। আবার গোটা শহরজুড়েই শপিংমল, বিপণি বিতান, দোকান-অফিস।

আইনে ‘পার্কিং এলাকা’ বলতে বলা হয়েছে, ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা নির্ধারিত স্থানসমূহ যেখানে কোনো মোটরযান দাঁড়াতে বা অবস্থান করতে পারবে, তবে এরূপ দাঁড়ানো বা অবস্থানের সময়সীমা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।’

সর্বশেষ সংশ্লিষ্ট আইনের ৪৭ ধারায় আরো বলা হয়েছে- ১. সরকার গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ বা কোনো প্রতিষ্ঠান বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে; ২. ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত বাংলাদেশ পুলিশের পরামর্শ গ্রহণ করে; ৩.মোটরযান পার্কিং এলাকা, থামানোর স্থান এবং যাত্রী ও পণ্য উঠা-নামার স্থান ও সময় নির্ধারণ করতে পারবে; ৪. পার্কিং সুবিধা প্রদানকারী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবহন কমিটির অনুমোদনক্রমে, মোটরযানের পার্কিং ফি আদায় করতে পারবে।’

পুলিশই ‘পার্কিং এলাকা’ নির্ধারণ করবে, ফি আদায় করবে- তা আইনে খুঁজে পাওয়া যায় না। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কিংবা পুলিশের পরামর্শ গ্রহণ করে মোটরযান পার্কিং এলাকা নির্ধারণ করেছে- এমন হদিস পাওয়া ভার। পরিবহন কমিটির অনুমোদনক্রমে ফি আদায়ও সুদূর পরাহত। অন্যদিকে, তাও যদি রাস্তাগুলো মার্কিং থাকত, ‘পার্কিং করা যাবে’ কিংবা ‘পার্কিং নিষিদ্ধ’ অথবা ‘এই সময়ের জন্য পার্কিং চলবে’। সবাইকে অন্ধকারে রেখে রেকার দিয়ে গাড়ির রাশ টেনে ধরা কোনো কাজের কথা নয়। রীতিমতো আইনের বরখেলাপ আর শক্তির মহড়া মাত্র; হয়তো অপপ্রয়োগও। একটি শৃঙ্খলিত ও চৌকস বাহিনী থেকে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ২০২১ সালেও কি এইভাবে চলবে?


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us