উদ্বৃত্ত আমানতের শহরমুখী যাত্রা

এম এ খালেক | Jun 23, 2021 02:56 pm
উদ্বৃত্ত আমানতের শহরমুখী যাত্রা

উদ্বৃত্ত আমানতের শহরমুখী যাত্রা - ছবি সংগৃহীত

 

পানি যেমন নিচের দিকে গড়ায়, তেমনই উদ্বৃত্ত পুঁজির ধর্ম হলো কর্মচঞ্চল শহরমুখী ধাবিত হওয়া। বর্ষার নতুন পানি এলে বিল-বাওড়ের কৈ মাছ যেমন তীরের দিকে উজিয়ে ওঠে, গ্রামের উদ্বৃত্ত পুঁজিও তেমনই নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শহরে চলে আসে। উদ্বৃত্ত পুঁজির এই শহরমুখী সঞ্চালনার কারণে গ্রামীণ জনপদে পুঁজি সঙ্কট সব সময়ই প্রকট থাকে। গ্রামীণ পুঁজি শহরে এসে শহরের চাকচিক্য বৃদ্ধি করে। অন্য দিকে নিজেদের পুঁজি হারিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতি সব সময়ই ধুকতে থাকে। পুঁজিস্বল্পতায় বিঘ্নিত হয় গ্রামীণ উন্নয়নপ্রচেষ্টা। অথচ গ্রামীণ অর্থনীতিই হচ্ছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রাণকেন্দ্র। প্রয়োজনীয় সমর্থন ও আর্থিক সাপোর্ট পেলে প্রতিটি গ্রামই এক একটি অত্যাধুনিক প্রোডাকশন সেন্টার বা উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। গ্রামে পর্যাপ্ত সংখ্যক ছোট-বড় উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে উঠলে সাধারণ দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থানের বিস্তর সুযোগ সৃষ্টি হবে।

এতে গ্রামের মানুষের শহরমুখী অভিবাসন প্রক্রিয়া এমনিতেই কমে আসতে পারে। গ্রামের উদ্বৃত্ত পুঁজির শহরমুখীনতার কারণে গ্রামীণ দারিদ্র্য যে হারে কমে আসার কথা তা হচ্ছে না। করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ২১ শতাংশের মতো। করোনার কারণে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দু’টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, করোনা সংক্রমণের কারণে গত এক বছরের বেশি সময়ে দেশে অন্তত ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে। আগে এরা কোনো মতে দারিদ্র্য সীমার ওপরে অবস্থান করছিল। তাদের সেই অবস্থান টেকসই ছিল না। তাই সামান্য আঘাতেই তারা আবারো দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে। এদের বেশির ভাগই স্বল্প আয়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। এরা এক সময় পরিজন নিয়ে শহরে বসবাস করছিলেন। কিন্তু করোনার প্রভাবে তারা পুঁজি হারিয়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তারা সর্বস্ব হারিয়ে গ্রামে গিয়ে গ্রামীণ দারিদ্র্য পরিস্থিতি আরো সঙ্গীন করে তুলেছেন। করোনা পরবর্তী সময়ে এদের পুনরুদ্ধার করাটাই হবে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। গ্রামের পুঁজি ক্রমাগত শহরমুখী হওয়ার কারণে গ্রাম এবং শহরের উন্নয়ন অর্জনের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে বৈষম্য।

কোনোভাবেই আমরা এই বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না। গিনি সহগ বা গিনি কোয়েফিসিয়েন্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের সূচক ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮৩। এটা শূন্য দশমিক ৫০ তে উন্নীত হলে তাকে ভয়াবহ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। অথচ স্বাধীনতার পর ১৯৭৩-’৭৪ সালে বাংলাদেশের গিনি সহগ ছিল শূন্য দশমিক ৩৬, যা অনেকটাই সহনীয় বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশ স্বাধীনতাত্তোর বিগত প্রায় ৫০ বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করেছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই জাতিসঙ্ঘের রেটিংয়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য চূড়ান্তভাবে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে বাংলাদেশ ২০২৬ সালে চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠে আসবে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এটাই সর্বোচ্চ অর্জন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য তিন বেলা আহারের সঙ্কুলান করা সম্ভব হচ্ছিল না। আর এখন দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি।

তারপরও সবার জন্য কমবেশি খাদ্যের সংস্থান করা সম্ভব হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ এখন সীমিত পরিসরে খাদ্যশস্য রফতানির স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে গ্রামীণ জনপদের অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। এমন কি বর্তমানে প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে সেখানেও গ্রামীণ জনপদের মানুষের অবদানই বেশি। গ্রামীণ এলাকার মানুষের ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। শহরের বেশির ভাগ আধুনিক সুবিধা এখন গ্রামে পাওয়া যায়। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইস্তেহারের একটি বিশেষ অঙ্গীকার হচ্ছে শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাওয়া। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদ অনেকটাই শহরের রূপ ধারণ করেছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এখনো শিল্প-কারখানা পর্যাপ্ত সংখ্যায় গড়ে ওঠেনি। এ কারণে গ্রামীণ জনপদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি অত্যন্ত ধীর। বাংলাদেশ ব্যাংক গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর জারিকৃত এক সার্কুলারের মাধ্যমে এসএমই খাতের সংজ্ঞা পরিবর্তন করেছে। এসএমই সেক্টরের সাথে কুটির ও মাইক্রো শিল্পকে যুক্ত করে এই খাতের নতুন নামকরণ করা হয়েছে ‘কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্ট্রারপ্রাইজ (সিএমএসএমই)। এতে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন গ্রামীণ অঞ্চলের উদ্যোক্তারা।

তারা কুটির ও মাইক্রো শিল্প স্থাপন করলেও এসএমই খাতের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। সম্প্রতি মন্ত্রী পরিষদ সভায় এসএমই সেক্টরের জন্য জামানতবিহীন ঋণদানের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। এতে গ্রামীণ এলাকায় ছোট-বড় শিল্প-কারখানা গড়ে উঠার চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে যে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন তার বেশির ভাগই পল্লী এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে আগামীতে দেশের গ্রামীণ জনপদ কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে।
কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে অন্যত্র। যেকোনো উন্নয়ন কর্ম সম্পাদন, বিশেষ করে শিল্প-কারখানা স্থাপন করতে হলে নিজস্ব পুঁজির দরকার হয়। গ্রামের মানুষ কি সেই চাহিদাকৃত পুঁজির জোগান দিতে পারবে? গ্রামের মানুষের উদ্বৃত্ত পুঁজি নেই এটা ঠিক নয়। কিন্তু সেই উদ্বৃত্ত পুঁজি গ্রামের মানুষের হাতে থাকছে না। উদ্বৃত্ত পুঁজি নানা প্রক্রিয়ায় রূপান্তরের মাধ্যমে শহরে চলে আসছে।

প্রতিবছর প্রবাসী বাংলাদেশী, যাদের বেশির ভাগই গ্রাম থেকে উৎসারিত তাদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের অর্থও নানাভাবে শহরে চলে যাচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের অর্থ স্থানীয় বেনিফিশিয়ারিরা উৎপাদনশীল কাজে ব্যয় না করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভোগ-বিলাস এবং অনুৎপাাদনশীল সম্পদ যেমন- বাড়ি নির্মাণ, ফ্লাট ক্রয় ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করছেন। ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ শহরে চলে যাচ্ছে এবং অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন দেশের বেশির ভাগ পল্লী এলাকায় ট্রেডিশনাল ব্যাংকের শাখা দেখা যায়। কিন্তু সেসব ব্যাংক পল্লী এলাকায় বিনিয়োগের পরিবর্তে সেখান থেকে উদ্বৃত্ত অর্থ শহরে নিয়ে আসার কাজে ব্যাপৃত রয়েছে। কিভাবে পল্লী এলাকা থেকে উদ্বৃত্ত পুঁজি, যা পল্লী শিল্পায়নের জন্য একান্তই জরুরি শহরে চলে আসছে তার একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে এজেন্ট ব্যাংকিং বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এজেন্টে ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে শিডিউল ব্যাংকগুলো গ্রামাঞ্চলে শাখা স্থাপন না করেও আর্থিক লেনদেন করতে পারছে। তারা গ্রামীণ এলাকায় সাধারণ মানুষের জন্য ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি প্রদান করা হয়। আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এটা শুরু করা হয়।

এ পর্যন্ত ৬০টি ব্যাংকের মধ্যে ২২টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি লাভ করেছে। যদিও ১৯টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের অভিজ্ঞতা বেশ ভালো। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ফলে পল্লী এলাকার সাধারণ মানুষ ট্রেডিশনাল ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছেন। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের নামে শিডিউল ব্যাংকগুলো কিভাবে পল্লী এলাকার উদ্বৃত্ত পুঁজি শহরে নিয়ে যাচ্ছে? ২০১৯ সালে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমে নিয়োজিত ব্যাংকগুলো পল্লী এলাকায় মোট ৫২ লাখ ৬৮ হাজার ৮৯৬টি অ্যাকাউন্ট খুলেছে। তার আগের বছর তারা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খুলেছিল ২৪ লাখ ৫৬ হাজার ৯৮২টি। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে ১১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২০২০ সালে রেমিট্যান্স বিতরণ করা হয়েছে ১৫ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলে এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবসায়রত শিডিউল ব্যাংকগুলো তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে মোট ৭ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে তারা পল্লী এলাকায় বিনিয়োগ করেছে মাত্র ৪৪৬ কোটি টাকা।

অর্থাৎ তারা সংগৃহীত আমানতের ৯৪ শতাংশই শহরে নিয়ে এসেছে। এখনো দেশের বেশির ভাগ মানুষ ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়ে গেছে। যদিও বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি বলে কেউ কেউ মনে করেন। বাংলাদেশে প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেকটাই মিশ্র প্রকৃতির। বিশ্বে দুই ধরনের ব্যাংক ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং, যা যুক্তরাজ্যে প্রচলিত রয়েছে। ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ব্যাংকের সংখ্যা থাকে কম কিন্তু তাদের শাখার পরিমাণ অনেক বেশি। পর্যাপ্ত সংখ্যক শাখার মাধ্যমে তারা জনগণকে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে থাকে। অন্য দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং ব্যবস্থা হচ্ছে ইউনিট পদ্ধতির। সেখানে সামান্য কয়েকটি শাখা নিয়ে এক একটি ব্যাংক স্থাপিত হয়। প্রয়োজনে সমজাতীয় অন্য ব্যাংকের সহযোগিতা নিয়ে তারা জনগণকে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে থাকে। ঐতিহ্যগতভাবেই ব্যাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্র্যাঞ্চ ব্যাংকিং পদ্ধতির। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক নতুন ব্যাংক স্থাপনের মাধ্যমে এই অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও সরে আসার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে টাকা সংরক্ষণের প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। কারণ ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ সংরক্ষণ করতে হলে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করতে হয়। যারা অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করছেন তারা তাদের উপার্জিত অর্থ ব্যাংকে সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে সাহসী হন না। আবার সবার পক্ষে মুদ্রা পাচার করাও সম্ভব হয় না। একটি সূত্র মতে, ২০১০ সালে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে ছিল ৪৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯ সালে এসে তা ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকা হাতে থাকাই যথেষ্ট। দেশে এত ব্যাংক ব্যবসায়রত রয়েছে কিন্তু তারা জনগণের হাতে থাকা এই উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে নিয়ে আসতে পারছে না।

সরকার গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। শহরের অত্যাধুনিক সুবিধাগুলোকে গ্রামীণ জনগণের জন্য সহজলভ্য করতে চাচ্ছেন। এ জন্য গ্রামীণ কৃষিনির্ভরতা কাটিয়ে শিল্পায়নের দিকে ধাবিত হতে হবে। আর শিল্পের জন্য ব্যক্তিগত পুঁজির কোনো বিকল্প নেই। কাজেই গ্রামের মানুষের উদ্বৃত্ত পুঁজি বা অর্থ গ্রামেই রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু জোর করে এই কাজটি করা কোনোদিনই সম্ভব হবে না। গ্রামীণ উদ্বৃত্ত পুঁজি যাতে শহরের দিকে ধাবিত হতে না পারে সে জন্য গ্রামাঞ্চলে পুঁজির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রামাঞ্চলের উদ্যোক্তাদের জন্য পুঁজি সহজলভ্য করতে হলে গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার শহরাঞ্চলের সুদের হারের তুলনায় কিছুটা কম রাখা যেতে পারে। যেমন, শহর ও শিল্পাঞ্চলের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার যদি ৯ শতাংশ হয় তাহলে গ্রামীণ এলাকার উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে তা ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা যেতে পারে। অন্য দিকে শহরাঞ্চলে আমানতের ওপর ৬ শতাংশ সুদ প্রদান করা হলে গ্রামীণ আমানতকারীদের ৭ বা সাড়ে ৭ শতাংশ সুদ প্রদান করা যেতে পারে। এটা করা হলে গ্রামীণ উদ্যোক্তারা তুলনামূলক স্বল্প সুদে ব্যাংক পেতে পারবেন। আবার তারা গ্রামাঞ্চলে ব্যাংক শাখায় আমানত সংরক্ষণে উৎসাহিত হবেন।

এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে গ্রামের উদ্বৃত্ত পুঁজির শহরমুখী প্রবণতা রোধ করা যেতে পারে। গ্রামীণ পুঁজির শহরমুখী অভিযাত্রা রোধ করতে হলে শুধু মুখের কথায় তা হবে না। এ জন্য কার্যকর বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এখানে সঙ্গত কারণেই এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের মতো অত্যধিক জনবহুল ও স্বল্প উদ্বৃত্ত পুঁজির একটি দেশে কোন ধরনের শিল্পায়ন বেশি উপযোগী? অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের মতো একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দ্রুততর করতে হলে সিএমএসএমই খাতের ওপরই বেশি জোর দিতে হবে। বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক টেকসই ও কার্যকর করতে হলে এসএমই খাতের বিকাশে সবচেয়ে বেশি জোর দিতে হবে। বর্তমানে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২৫ শতাংশ। এটাকে অন্তত ৬০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। গ্রাম পর্যায়ে সিএমএসএমই খাতের ব্যাপক বিস্তার ঘটাতে হবে। গ্রামপর্যায়ে সিএমএসএমই খাতের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটাতে হলে ‘ওয়ান ভিলেজ, ওয়ান প্রোডাক্ট’ (ওভিওপি) অত্যন্ত কার্র্যকর বলে বিবেচিত হতে পারে। ওয়ান ভিলেজ, ওয়ান প্রোডাক্ট বা ওভিওপি হচ্ছে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যভিত্তিক শিল্পায়ন প্রচেষ্টা। প্রত্যেকটি এলাকা কোনো না কোনো পণ্যের জন্য বিখ্যাত। এমন অনেক পণ্য আছে যা সংশ্লিষ্ট এলাকার নামের সাথে একাকার হয়ে গেছে। যেমন- রাজশাহীর সিল্ক, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, টাঙ্গাইলের চমচম, জামালপুরের নকশিকাঁথা, দিনাজপুরের সতরঞ্চি, কুমিল্লার রসমালাই, ঝিটকার হাজারি গুড়, বগুড়ার দই ইত্যাদি। এসব ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা হলে দেশের সব অঞ্চলের দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হতে পারে। এসব এলাকায় পরিকল্পিতভাবে সিএমএসএমই শিল্প স্থাপন করা হলে স্থানীয়ভাবে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের জোগান নিশ্চিত করা যাবে। এতে পণ্য উৎপাদকগণ যেমন উপকৃত হবেন তেমনি কাঁচামাল সরবরাহকারীরাও লাভবান হবেন। তুলনামূলক স্বল্প পুঁজির এসব শিল্পে বিনিয়োগ করে যে কেউ চেষ্টা করলেই নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। বর্তমান সরকারের একটি নির্বাচনী অঙ্গীকার হচ্ছে শহরের সুবিধা গ্রামে নিয়ে যাওয়া।

এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হলে ‘ওয়ান ভিলেজ, ওয়ান প্রোডাক্ট’ অ্যাপ্রোচে সিএমএসএমই খাতের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপের কোনো বিকল্প নেই। কয়েক বছর আগের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছিল, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১ শতাংশ শহরে বাস করে। আর অবশিষ্ট ৬৯ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। অথচ জাতীয় অর্থনীতিতে শহরের অবদান হচ্ছে ৬০ শতাংশেরও বেশি। এই অনাকাক্সিক্ষত অবস্থা গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করে রেখেছে। গ্রামের উদ্বৃত্ত পুঁজি গ্রামে বিনিয়োগ না হয়ে শহরে চলে আসছে। ফলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমেই বাড়ছে। সারা দেহের রক্ত মুখে এসে জমা হলে তাকে যেমন সুস্থতা বলা যায় না তেমনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুধু শহরে কেন্দ্রীভূত হলে সেটা সুষম উন্নয়ন কৌশল নয়। আমাদের যেকোনো মূল্যেই হোক এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। আর এ জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় হতে পারে ‘ওয়ান ভিলেজ, ওয়ান প্রোডাক্ট অ্যাপ্রোচ।’ এই পদ্ধতি কাজে লাগানো হলে প্রতিটি গ্রামেই কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে। গ্রামের দরিদ্র মানুষকে আর কর্মসংস্থানের জন্য শহরমুখী হতে হবে না।

‘ওয়ান ভিলেজ, ওয়ান প্রোডাক্ট অ্যাপ্রোচ জাতীয় শিল্পনীতির পরিপন্থী নয় বরং সহায়ক। শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে প্রণীত ‘জাতীয় শিল্পনীতি-২০১৬’-এর অধ্যায় ৫ এর অনুচ্ছেদ ৫.১২’তে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, “এসএমই উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও উন্নয়নে ‘ওয়ান ভিলেজ, ওয়ান প্রোডাক্ট’ নীতি গ্রহণ করার উদ্যোগ নেয়া হবে।” কাজেই ‘ওয়ান ভিলেজ, ওয়ান প্রোডাক্ট’ অ্যাপ্রোচ জাতীয় শিল্পনীতির সাথে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। ‘ওয়ান ভিলেজ, ওয়ান প্রোডাক্ট’ অ্যাপ্রোচে সিএমএসএমই শিল্প বিকাশের উদ্যোগ নেয়া হলে তা গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সঙ্কট দূরীকরণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। ট্রাডিশনাল ব্যাংক এবং অন্যান্য অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই খাতে প্রয়োজনীয় ঋণ ও অর্থায়নের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শহর ও গ্রামের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের জন্য ব্যাংক অর্থায়নের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের চিন্তা করেছিলেন। তিনি গ্রামের উদ্বৃত্ত পুঁজি যাতে শহরে চলে না আসে এবং গ্রামেই বিনিয়োজিত হয় সে লক্ষ্যে গ্রামাঞ্চলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার শহরের তুলনায় কিছুটা কম রাখার চিন্তা করেছিলেন। অন্য দিকে গ্রামীণ আমানতকারীদের তুলনামূলক বেশি সুদ প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে গ্রামের উদ্বৃত্ত পুঁজি শহরে চলে না আসে। বর্তমানে দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স।

গত অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ ১ হাজার ৮০০ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এ বছর রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। অর্থ বছরের প্রথম ১০ মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ৩৯শতাংশ। গত এপ্রিল মাসে ২০৭ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। চলতি অর্থবছর থেকে প্রবাসী আয়ের ওপর ২ শতাংশ নগদ আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। অন্যান্য কারণের পাশাপাশি এই আর্থিক প্রণোদনা রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে। আগে যারা হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতেন এখন তারা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাচ্ছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় আগামী বাজেটে প্রবাসী আয়ের ওপর দেয়া নগদ আর্থিক প্রণোদনার হার দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের এই প্রস্তাব বিবেচনার দাবি রাখে। প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে তার বেশির ভাগই সঞ্চারিত হয় গ্রামীণ অর্থনীতিতে। কিন্তু গ্রামে বিনিয়োগের উপযুক্ত আবার শহরে চলে আসছে। এই ক্যাপিটাল ফ্লাইট রোধ করার জন্য হলেও গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের বিকল্প সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us