নজরুলের অন্যরকম শৈশব

কামাল আহমেদ | Jun 26, 2021 05:34 pm
নজরুল

নজরুল - ছবি সংগৃহীত

 

অতি দরিদ্র একটি পরিবার। তৎকালীন বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানায় বসতি। জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামের পীরপুকুরের পাশে এক জীর্ণশীর্ণ মাটির ঘরে পরিবারটির কষ্টের বসবাস। পরিবারের পূর্বপুরুষেরা পাটনা থেকে এসেছিলেন। পূর্বপুরুষেরা দরিদ্র ছিলেন না। তারা মুঘল সম্রাট শাহ আলমের সময় পাটনার হাজীপুরের পাট চুকিয়ে চুরুলিয়ায় এসেছিলেন। কথিত আছে, চুরুলিয়ায় এক সময় রাজা নরোত্তম সিংহের রাজধানী ছিল, ছিল অস্ত্র নির্মাণ কেন্দ্র। পরিবারের পীরপুকুরের বসতঘরের পূর্বদিকে ‘রাজা নরোত্তমের গড়’, হাজি পাহলোয়ানের খনন করা পীরপুকুর ঠিক বাড়ির দক্ষিণদিকে। পুকুরের পূর্বপাড়ে হাজী পালোয়ানের মাজার, পশ্চিমপাড়ে মসজিদ। প্রথম দিকে মুঘল আমলে এই পীরপুকুরে একটি বিচারালয়ও ছিল; কাজীরা সেখানে বিচার করতেন। কালের যাত্রায় এই কাজী পরিবার এক সময় চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েন।

পীর পুকুরের মাটির ঘরটিতে কাজীদের পরিবারে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে, বাংলা ১১ জ্যৈষ্ঠ তারিখে এক সুদর্শন ফুটফুটে শিশু জন্মায় চরম দরিদ্র্যকে সাথে নিয়ে। সেদিন ছিল প্রচণ্ড ঝড়ের রাত, রাতেই জন্ম। নাম তার দুখু মিয়া, কখনো নজর আলী। পিতা কাজী ফকির আহমদ, পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহ। মাতা জাহেদা খাতুন। মাতামহ তোফায়েল আলী। পিতা, পিতামহ ছিলেন মাজারের খাদেম। এই ছেলেটিই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

১৯০৮ সালে পিতার মৃত্যু হলে ৯ বছরের নজরুলের পরিবারে অভাব-অনটন চারপাশ থেকে ঘিরে থাকল। মক্তবের পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেল। পিতার পেশায় খাদেম হিসেবে মাজারে লেগে গেলেন, মসজিদে ঝাড়ামোছা করেন। এতে কি অভাব ঘোচে? ইতোমধ্যেই চাচা ফজলে আহমদ ও চাচা বজলে করিমের কাছে ফার্সি শেখেন। কবিতা লেখার শুরু তখন থেকেই, উর্দু-ফার্সি-বাংলা মিশিয়ে।

এক দিকে ক্ষুধাযুদ্ধ, অন্য দিকে শৈশবেই বাউণ্ডুলে মন ও বিচিত্র জীবনবোধ- সব মিলিয়ে নজরুল আর মাজারের খাদেমের কাজটা চালিয়ে যেতে পারলেন না। যোগ দিলেন ‘লেটো দলে’। লেটো দলে নাচ, গান, কবিতার লড়াই, গানের লড়াই, তর্কযুদ্ধ ইত্যাদি জমে উঠত। এতে নজরুলের যে কিছুটা বাড়তি রোজগার হত তা-ই নয়; পেশাটিকে তিনি ভালোবেসেও ফেলেছিলেন। এ রাস্তায় তিনি এ বয়সেই বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। একাধিক দলের নাটক লিখে দিতেন। এভাবেই মূলত নজরুলের ধীরে ধীরে সাহিত্য সংস্কৃতির সাথে প্রাথমিক পরিচিতি গড়ে ওঠে। অর্জন করেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। হিন্দু পুরাণ ও আঞ্চলিক লোকসংস্কৃতির পরিচয়ও এখানে। এসবের ধারাবাহিকতায় তিনি ‘চাষার সং’, ‘মেঘনাদ-বধ’, ‘শকুনি-বধ’, ‘দাতাকর্ণ’, ‘রাজপুত্র’, ‘আকবর বাদশা’ আখ্যায়িকামূলক নাটক ও প্রহসন রচনা করেন। বাউণ্ডুলে নজরুল-মন এ জগতেও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তবে বিস্ময়কর প্রতিভার গুণে অল্পদিনের এই লেটো-জগৎ নজরুলের পরবর্তী জীবনের উপর যথেষ্ট প্রভাব রাখে।
বলা প্রয়োজন, নজরুল বাউণ্ডুলে হলেও পাঠ বিমুখ ছিলেন না। বইপড়ায় তার অন্যরকম টান ছিল বরাবরই।

১৯১১ সালের শেষদিকে তিনি বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোটে চলে গেলেন। অজয় নদীর তীরবর্তী মাথরুন গ্রামের নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউটে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। অর্থ-কষ্ট আবারো পিছু নিলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলো। এবারো তার ভবঘুরে জীবন। যোগ দিলেন বাসুদেবের কবি দলে। কবি দলের গান তিনিই লিখতেন। সাথে কবিতা, নাটক চলত। কখনো ঢোল বাজিয়েও আয় করতেন। গান গেয়ে মাতিয়ে রাখতেন সবাইকে।

এই বাসুদেবের দলে গান করতে গিয়ে বর্ধমানে এক খ্রিস্টন রেলওয়ে গার্ড এর সাথে পরিচয়। গার্ড নজরুলকে চাকরির প্রস্তাব করতেই রাজি হলেন। চাকরি হলো। কাজ রেল স্টেশন থেকে প্রসাদপুর বাংলোয় গার্ড সাহেবকে খাবার পৌঁছে দেয়া। দেড় মাইল মাটির পথ হেঁটে টিফিনবাক্সে করে প্রতিদিন খাবার আনতে হত। কখনো আসানসোল থেকে মদ আনতে হতো। অবসরে গার্ড সাহেব ও তার স্ত্রীকে গান শোনানোও নজরুলের কাজ ছিল।
সেই গার্ড সাহেব এক দিন তাদের নিজেদের আপদমুক্ত করতে কিশোর নজরুলকে মিথ্যা কলঙ্কে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন। গার্ড সাহেবের স্ত্রীর আগের স্বামীর এক খোড়া কন্যাসন্তান তাদের কাছে ছিল। তার বাবা তাকে ফেরত চাইলে গার্ড ও তার স্ত্রী কন্যাটিকে প্রাসাদপুরের বাংলোতে কিশোর নজরুলের সাথে পাঠিয়ে দিলেন। এ দিকে মেয়ের বাবাকে জানিয়ে দিলেন, মেয়েটি গার্ড সাহেবের মুসলমান ‘বয়’ নজরুলের সাথে কোথাও পালিয়ে গেছে। ঘটনায় নজরুলকে দুই মাসের মাইনে ৫০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে বিদায় দেয়া হলো।

নজরুল তাঁর এক বন্ধু রুস্তম আলীর কল্যাণে আসানসোলে এসে এম বকসের রুটির দোকানে খাওয়া-থাকাসহ মাসিক পাঁচ টাকা মাইনেতে চাকরি নেন। সারা দিন রুটি তৈরি ও বিক্রি করাই কাজ ছিল। কাজের ফাঁকে কোনো একটা সুযোগে নজরুল আসানসোল ইংরেজি হাইস্কুলে ভর্তি হলেন। বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেন। নজরুল স্কুলের হেডমাস্টার কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের প্রিয় পাত্র হয়ে গেলেন। সেখানে একই ক্লাসে পড়ুয়া কাজী আবুল হোসেন বন্ধু হয়ে গেলেন। সেই সুবাদে আবুল হোসেনের বড়ভাই কাজী রফিক উদ্দিন দারোগার সাথে পরিচয় ও পারিবারিক আসা যাওয়া হতো নজরুলের। নজরুল ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলেন; কিন্তু বেতন বকেয়া থাকায় নাম কাটা গেল। স্কুল ছাড়তে বাধ্য হলেন নজরুল।
১৯১৪ সালে ময়মনসিংহের দরিরামপুরের কাজীর সিমলায় বন্ধু কাজী আবুল হোসেনের বাড়িতে চলে আসেন নজরুল। এখানে দরিরামপুর ইংরেজি হাইস্কুলে দু’জনেই ভর্তি হলেন। নজরুল বিনাবেতনে পড়ার সুযোগ পেলেন। কাজীর সিমলা থেকে দরিরামপুরের দূরত্ব পাঁচ মাইল তাই দু’জনেই স্কুলের কাছে ত্রিশালে বিচুতিয়া ব্যাপারীর বাড়িতে জায়গীর নিলেন। ছুটির দিনে দরিরামপুর আর অন্য সময় ত্রিশালে কাটাতেন।

নজরুলের দূরন্ত ও অভাগা জীবনের সাথী ছিল- বই।

সব সময় সাথে বই থাকতোই। দূরন্তপনার সময়টকু ছাড়া বাকি সময় বই পড়েই কাটত। খাবারের সময়ও পাশে বই। তখনো কবিতা লিখতেন, সুযোগ পেলে নাট্যাভিনয়। স্কুলে বা বিয়ে বাড়িতে অনুষ্ঠানে গান গেয়ে, নেচে আসর জমাতে তার জুড়ি নেই।

১৯১৫ সালে দরিরামপুর ইংরেজি হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ওঠেন ফার্স্ট হয়ে। পরীক্ষায় ফার্সিতে যেখানে বেশির ভাগ ফেল, সেখানে নজরুল আটানব্বই পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন।
তখনই এক দিন বন্ধু আবুল হোসেনকে সাথে করে ময়মনসিংহ শহরে ঘুরতে এসে সেখান থেকেই বন্ধুকে বিদায় দিয়ে আসানসোল চলে এলেন। পেছনে রেখে গেলেন ত্রিশাল, দরিরামপুর বা কাজীর সিমলার বহু স্মৃতি।

১৯১৫ সালে নজরুলকে রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি না করায় দীর্ঘ এক চিঠি লিখে এক বন্ধুর কাছে রেখে গেলেন। চিঠি পড়ে চিঠির ভাষায় হতবাক হেডমাস্টার দ্রুত খবর দিয়ে নজরুলকে ভর্তির ব্যবস্থা করলেন। ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণীতে। থাকার ব্যবস্থা হলো মোহামেডান বোর্ডিংয়ের মাটির ঘরে। বোর্ডিং খরচ, বেতন, খাওয়া খরচ নজরুলকে দিতে হতো না। রাজবাড়ী থেকে সাত টাকা বৃত্তি পেতেন তিনি। সেখানে তার বন্ধু হন পরবর্তী সময়ের বিখ্যাত সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। দু’জনে দুই স্কুলে পড়লেও রোজ দেখা হতো। একসাথে লিখতেন, খেলতেন, ঘুরতেন গ্রান্ড ট্রাংক রোড, ইআই রেলওয়ে লাইন ও নিকটবর্তী অরণ্যে। পুকুরে সাঁতার কাটা, সিয়ারসোল পুরনো বটতলার এক জটাজুটধারী সন্যাসীর গঞ্জিকাসেবন দেখতে যেতেন। এয়ারগান নিয়ে দু’জনে খ্রিষ্টানদের নির্জন কবরস্থানে ইংরেজ মারা খেলতেন। সাহিত্যচর্চাও চলতে থাকে। ১৯১৭ সালে দশম শ্রেণীতে উঠলেন। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল ভারতবর্ষেও লাগল। নজরুল সৈনিক জীবনে যোগ দেন। তারপর অন্যটাও বহু ভাঙ্গা-গড়ার ইতিহাস।

সহসাই সৈনিক জীবনের ইতি হলো। শুরু হলো পৃথিবীর তাবৎ বিস্ময় নিয়ে আবির্ভূত কবি নজরুলের বিচিত্র জীবন। তখনো দারিদ্র্য তার পিছু ছাড়েনি, তার আজন্ম স্বভাবটাও দারিদ্র্যের পিছু ছাড়েনি। তবুও তিনি পেয়েছিলেন হিমালয় সমান ভালোবাসা। আবার জীবদ্দশার শেষ প্রায় অর্ধেক জীবন হিমালয় সমান কষ্টও পেয়েছেন আমৃত্যু। এমন এক মহাত্মা মানুষের এই দুঃখ-জীবন, হয়তো স্রষ্টার ইচ্ছেতেই হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজয়ী এই মানুষটি অমরত্বের সারথি হয়ে হাজার বছর বেঁচে থাকবেন তার অমর সৃষ্টিতে, ‘সৃজন ছন্দে... মহা আনন্দে...’।

দরিদ্র ও অভিভাবকহীন কাজী পরিবারে নজরুলের শৈশব না কেটে যদি উল্টো হতো, তবে হয়তো আজকের কাহিনী লিখতে হতো না। হতে পারত, তিনি অসাধারণ ধীশক্তির অধিকারী হিসেবে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে ব্রিটিশদের কাছে বড় কোনো চাকরি নিয়ে বা রায়বাহাদুর খেতাব নিয়ে বেশ সুনামে জীবন উপভোগ করতেন। আজ হয়তো অনেকেই তা ভুলে যেত। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছে ছিল অন্যরকম। জীবনভর ক্ষুধা, শৃঙ্খলায় না বাঁধা জীবন, হিসাব-নিকাশ না করা, স্বভাবজাত দ্রোহবোধ ও সবশেষ সর্বনাশা দীর্ঘ ব্যাধি নিয়ে যেটুকু ‘সৃজন ছন্দে’ তিনি মেতে উঠেছিলেন, সেটুকুই নিয়েই আজকের বিদ্রোহী নজরুল, জাতীয় কবি নজরুল, মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় নজরুল।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us