বিশ্বসেরাদের মঞ্চে থাকতে পারতাম আমিও : নিয়াজ মোরশেদ

রাহেনুর ইসলাম | Jun 27, 2021 04:02 pm
নিয়াজ মোরশেদ

নিয়াজ মোরশেদ - ছবি : নয়া দিগন্ত

 

১৩ বছর বয়সে হয়েছেন জাতীয় দাবা চ্যাম্পিয়ন। ২১ বছরে গ্র্যান্ড মাস্টার! এমন সাফল্যে বাংলাদেশে দাবা খেলাটার পরিচয়ের প্রতীকই হয়ে গেছেন কিংবদন্তি নিয়াজ মোরশেদ। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ক্রীড়াতারকা সাক্ষাৎকার বা প্রচারে খুব আগ্রহী নন। ‘অন্য এক দিগন্ত’ ম্যাগাজিনের হয়ে লেগে থেকে তাকে রাজি করালেন রাহেনুর ইসলাম

অন্য এক দিগন্ত : জন্মদিনের শুভেচ্ছা আপনাকে। ৫৫ বছর বয়সে দেশের হয়ে দাবা বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ায় আগাম অভিনন্দনও রইল।

নিয়াজ মোরশেদ : ধন্যবাদ আপনাকে। ১৩ মে আমার জন্মদিনটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য। আমার চেয়ে কম বয়সের অনেকে আর দাবা খেলছেন না। আমি খেলে চলেছি এখনো। মহান আল্লাহর অশেষ দয়া এটা। এই বয়সে আর একটা বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পাওয়ায় বিশেষ কিছু।

প্রশ্ন : পেছন ফিরে যাওয়া যাক। আপনি প্রথম আলোচনায় আসেন ১৯৭৫ সালে, অথচ তখন বয়স মাত্র ৯ বছর।
নিয়াজ : সে বছর আনাতোলি লুতিকভ নামে রুশ গ্রান্ডমাস্টার ঢাকায় এসেছিলেন তখন। প্রেস ক্লাবের প্রদর্শনী ম্যাচে তিনি একসঙ্গে খেলেছিলেন ৩০ জনের বিপক্ষে। ২০ চালের মতো খেলে আমি তার সঙ্গে ড্র করি। অন্যরা তার সঙ্গে পারেননি, এলোমেলো খেলেছেন। কিন্তু আমি খেলেছি দাবার ব্যাকরণ মেনে। পরে দেখি, টিভিতে তিনি বলছেন, নিয়াজ একদিন গ্র্যান্ডমাস্টার হবে। আমি তখন ৯ বছরের একটা বাচ্চা। লুতিকভের কথায় আমার মনে গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার স্বপ্নের বীজটি বোনা হয়ে যায়। ‘রোড টু চেসমাস্টার’ বইটা পড়া ছিল আমার। সেখান থেকে পেয়ে যাই দাবার থিওরিটিক্যাল নলেজ।

প্রশ্ন : আর প্র্যাকটিক্যাল নলেজ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে খেলতে?
নিয়াজ : হ্যাঁ। প্রথমবার ভালো করতে না পারলেও দ্বিতীয়বার হয়েছিলাম অষ্টম। পরেরবার যৌথভাবে আরো দু’জনের সঙ্গে শীর্ষে, কিন্তু টাইব্রেকে তৃতীয় হয়ে যাই। এই সময়টায়, ১৯৭৮ সালে, আরেকটি ঘটনা ঘটে। আমার মা-বাবার বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যায়। আম্মার সঙ্গে আমরা চলে যাই জিগাতলায়। ছোট বাসা, এলাকায় কোনো মাঠ-ঘাট নেই। নতুন এলাকা বলে বন্ধুও নেই। সব মিলিয়ে বাইরের খেলার জগৎ থেকে নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিলাম। ঘরের ভেতর সারাক্ষণ দাবা নিয়ে পড়ে থাকি। খেলতে খেলতে এমন অবস্থা হলো যে, আমি টানা চারবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন!

প্রশ্ন : গ্র্যান্ডমাস্টার যে হচ্ছেন, সেটি কখন বুঝতে পেরেছেন?
নিয়াজ : আন্তর্জাতিক দাবায় আমার শুরু খুব উজ্জ্বল। ৭৯-এ রেটিং পেয়ে যাই। ৮১-তে সরাসরি হই আন্তর্জাতিক মাস্টার, শারজায়। তখন আমার বয়স ১৫। ওই সময়টাতেই বুঝলাম যে, গ্র্যান্ডমাস্টার হচ্ছি আমি। তবে ৮৭-র মধ্যে সেটি হয়ে যাব, তা ভাবিনি।
প্রশ্ন : সেই কলকাতা, সেই ২০ বছরের এক তরুণ, সেই গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার রোমাঞ্চ-শিহরন...।
নিয়াজ : অবিশ্বাস্য খেলেছিলাম টুর্নামেন্টটায়! তিনজন রুশ গ্র্যান্ডমাস্টার ছিলেন, কেউ আমাকে হারাতে পারেননি। একটি ম্যাচে হেরেছিলাম, বিশ্বনাথন আনন্দের কাছে। ওই খেলা ড্র করতে পারলেও আমি গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে যাই সহজে। কিন্তু হেরে যাওয়ায় বেশ কিছু রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার সময় কেটেছে।
প্রশ্ন : কেমন?

নিয়াজ : এখন গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার জন্য যেমন ৩০ গেম লাগে, তখন লাগত ২৪ গেম। কলকাতার পর দেখা গেল, আমার এক গেম কম। বিশ্ব দাবা সংস্থায় জানানো হলো। ওরা বলল, কোনো অসুবিধা নেই। বার্মা থেকে তুরস্ক- পশ্চিম এশিয়ার এই বিশাল অঞ্চল নিয়ে দাবার জোন নাইন। এখান থেকে তখনো কোনো গ্র্যান্ডমাস্টার নেই। ওরা তাই বলল, নিয়াজের এক ম্যাচ কম হলেও ওকে আমরা গ্র্যান্ডমাস্টার করছি। কী যে আনন্দের দিন ছিল সেটি!

প্রশ্ন : সঙ্গে সঙ্গেই আপনি হয়ে গেলেন বাংলাদেশের বিশাল তারকা। ফুটবলের ওই ভরা যৌবনে ফুটবলারদের টেক্কা দেয়ার মতো কেবল ওই একজনই।
নিয়াজ : আমি তো বলব, খ্যাতির দিক দিয়ে ফুটবলারদের চেয়েও এগিয়ে ছিলাম। কারণ আমি বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। ফুটবলে সেই আন্তর্জাতিক সাফল্য ছিল না। তবে আমার খ্যাতি ছিল, টাকা ছিল না। ফুটবলারদের দুটোই ছিল। ওই সময় ফুটবলাররা ২২-২৩ লাখ টাকা পর্যন্ত পেয়েছেন। আর আমি ২২-২৩ হাজারের মতো। হ্যাঁ, তাই তো। ১৯৮৩ সালে মোহামেডানে থেকে ২৫ হাজার দেয়ার কথা ছিল, দিয়েছে ২৩ হাজার। পার্থক্যটা বুঝুন। টপ দাবাড়– হয়ে টপ ফুটবলারদের এক শ ভাগের এক ভাগ!

প্রশ্ন : এজন্যই কি দাবাকে কম গুরুত্ব দিয়ে পড়াশোনা বেছে নিলেন? কারণ গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পরপর আপনি দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। যুক্তরাষ্ট্রে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভিনিয়ায় অর্থনীতিতে পড়তে।
নিয়াজ : দেখুন, দাবাটা আমি কখনো টাকার জন্য খেলিনি। সেই চিন্তা করার মতো অবস্থাই ছিল না। বুঝেছিলাম, দাবায় থাকলে খেয়ে-পরে বাঁচা যাবে, তবে উপার্জন খুব ভালো হবে না। বুঝিনি যে, টপ দাবাড়– হতে পারলে সেসবই হতো।

প্রশ্ন : সেজন্য অনুশোচনা হয় এখন?
নিয়াজ : হুম... হয়। আসলে আমার ওই সময় গাইডেন্স ঠিকমতো হয়নি। বাবা ছিলেন না তো। নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতাম। এখন বুঝি সেই সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি। পেনসিলভিনিয়ার মতো অত বড় ভার্সিটিতে না গেলেই হতো। ওখানে পড়ালেখার এত চাপ যে, দাবার চর্চাটা হয়নি।
প্রশ্ন : দেশে ফিরলেন ১৯৯০ সালে। তত দিনে দাবার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে, তাই না?
নিয়াজ : হয়েছে। তারপরও ১৯৯৩ পর্যন্ত চেষ্টা করেছি। পরে ভাবলাম, নতুন কিছু করলে এখনই করতে হবে। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় ঢুকে গেলাম। ৯৭-তে বিয়ে করলাম। দাবার জন্য তেমন কোনো সময়ই আর রইল না।

প্রশ্ন : খুব দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বনাথন আনন্দ আর আপনার নাম ব্রাকেটবন্দী হয়ে উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে। ভারত ওর বিশ্বসেরা হওয়ার পথে অনেক সুযোগ-সুবিধা করে দিয়েছিল, সেসব পেলে আপনিও কি তেমনটা হতে পারতেন না?
নিয়াজ : খুব আফসোস হয়। কিন্তু কী করব বলেন! দাবার প্রতিভার দিক দিয়ে আমরা হয়তো কাছাকাছি। গড-গিফটেড প্রতিভা। কিন্তু আনন্দের যে চেষ্টা, যে একাগ্রতা, সবকিছু ছেড়ে দাবায় দাঁত কামড়ে লেগে থাকা- সেটি আমার মধ্যে একেবারেই নেই। থাকলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতাম কি না জানি না, তবে বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং পেয়ার থাকতাম অবশ্যই। বিশ্বসেরাদের মঞ্চে থাকতে পারতাম আমিও।

প্রশ্ন : আপনি তো গানের অ্যালবামও করেছিলেন। গল্পটি একটু বলুন।
নিয়াজ : গল্প আর কী! অবসর সময় ছিল তখন, তাই ভাবলাম একটি গানের অ্যালবাম করলে কেমন হয়! সেটি ১৯৯৪ সাল। ঠিকানা খুঁজে বের করে আমি রেনেসাঁর নকীব ভাই, পিলু ভাইদের কাছে গেলাম। তাদের সহযোগিতায় গানের অ্যালবাম বেরিয়েছিল। নাম অথচ একদিন। এখন আর গান গাই না। তবে গিটার বাজাই মাঝে মাঝে। করোনার এই ঘরবন্দী দিনগুলোতে গিটারটা ভালো সঙ্গ দিচ্ছে। নইলে পাগল হয়ে যেতাম হয়তো।

প্রশ্ন : দাবা, পড়াশোনা, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, গান- আর কিছু করেননি?
নিয়াজ : করেছি তো। কবিতার বই লিখেছি। ২০০৯ সালে বেরিয়েছিল। কবিতার বইটির নাম ছিল ‘মাত্র এক কুড়ি’।

প্রশ্ন : এবার আপনার দাবায় প্রত্যাবর্তনে ফেরা যাক।
নিয়াজ : ২০০৩ থেকে ফিরতে শুরু করেছি। ব্যবসা গুটিয়ে ফেললাম ২০০৬ সালে। পরের বছর আমার ডিভোর্স হয়ে গেল। আবার তাই দাবায় ফিরি পূর্ণমাত্রায়। ২০১২ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নও হয়ে যাই। সেটা ৩০ বছর পর। ২০১৯ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুট জিতেছি আরেকবার। সব মিলিয়ে ছয়বার। ২০১৯ সালে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্যই সুযোগ পেয়েছি দাবা বিশ্বকাপে। এখন দাবা খেলাকে জনপ্রিয় করতে কাজ করতে চাই। এজন্য চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরে দাবা নিয়ে একটি প্রোগ্রাম করেছিলাম। চেস কিউব। দাবার জন্য শুরুটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। চার থেকে ছয় বছরের বাচ্চাদের মাথায় দাবার ভালোবাসা ঢুকিয়ে দিতে পারলে এমনিতেই ভালো দাবাড়– বেরোবে।

প্রশ্ন : দাবা ফেডারেশনে নির্বাচন করার কারণ কী?
নিয়াজ : নিজের আগ্রহ ছিল। অন্যদেরও আমাকে আনার ব্যাপারে আগ্রহ ছিল। এখন বুঝি এটি ভালো আইডিয়া ছিল না। আমার নির্বাচনে হারাটা দাবার জন্য পরোক্ষে ভালোই হয়েছে। কারণ আমি সব বিষয় সামলাতে পারতাম না। কে জানে, খেলাটাই হয়তো নিয়মিত করতে পারতাম না। এর চেয়ে এখন যারা এসেছেন, তারা ভালো।

প্রশ্ন : আগের কমিটির যে ‘বিতর্কিত’ সাধারণ সম্পাদক মোকাদ্দেস হোসেন, তার সঙ্গে আপনার সখ্যের কারণ কী?
নিয়াজ : সেটি ভিন্ন কারণে। আমার সঙ্গে অন্যদের যে সমস্যা ছিল, ওটার রেশ ধরে তাকে সমর্থন দিয়েছিলাম। কিছুদিন ভালোই চালিয়েছিলেন। পরে দেখলাম, তার ঝামেলা আছে।
প্রশ্ন : তার আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুজাউদ্দিনের সঙ্গেও আপনার ঝামেলা ছিল, তাই না?
নিয়াজ : ঝামেলা থাকবে না কেন? তিনি একনায়কের মতো একাই সব সিদ্ধান্ত নিতেন।

প্রশ্ন : কিন্তু তার সময়ই তো পরের চার গ্রান্ডমাস্টারকে পেল বাংলাদেশ।
নিয়াজ : সেখানে তার কৃতিত্বটা কোথায়? জিয়া-রিফাত-রাজীব-রাকিবরা কেউ তার সময়ে তৈরি হয়নি। ৯৬-৯৭ সাল থেকেই ওদের প্রতিভার কথা সবাই জানতেন।

প্রশ্ন : নির্বাচনে আপনি হেরে গেলেন। এরপরও পাঁচ গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়ে ইস্তানবুলে যায় বাংলাদেশ। দাবার জন্য সেটি অনেক বড় সুখবর নিশ্চয়ই।
নিয়াজ : অবশ্যই। আমাদের গ্র্যান্ডমাস্টারদের মধ্যে যে বিভেদ ছিল, সেটি একটু কমে আসে। কিছু রেষারেষি আছে তারপরও। আমি-জিয়া-সাগর মোহামেডানে যারা খেলি, তারা একসঙ্গে। ওদিকে তারা তিনজন আবার অন্যদিকে। এমনটি হওয়া মোটেই উচিত না।

প্রশ্ন: পরের প্রজন্মের দাবাড়ুদের মধ্যে কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়?
নিয়াজ : ফাহাদ ছেলেটিকে আমার খুব পছন্দ। আমার বিশ্বাস ও গ্র্যান্ডমাস্টার হবে। আমার চেয়ে কম বয়সেই হবে। বাংলাদেশে দাবার ভবিষ্যৎ আছে। এখন শুধু সঠিক দিক নির্দেশনায় এগিয়ে যেতে হবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us