শয়তান মানুষকে যেভাবে ফাঁদে ফেলে

আবদুর রশীদ | Jul 02, 2021 03:17 pm
শয়তান মানুষকে যেভাবে ফাঁদে ফেলে

শয়তান মানুষকে যেভাবে ফাঁদে ফেলে - ছবি : সংগৃহীত

 

নানাভাবে শয়তান আদম সন্তানদের প্ররোচনা দেয়। ইবলিশ এই ঘোষণা আল্লাহর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরই দিয়েছে। মানুষকে ভুল পথে যাওয়ার এই প্ররোচনা বা ফাঁদ তৈরি নানাভাবে করতে দেখা যায় শয়তানকে।

প্রথমত, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে প্রতারণা। মদ হলো এমন পানীয় যা ধারণ করলে শুরু হয়ে যায় বিবেকহীনতা। নেশাগ্রস্ত হওয়ার ফলে স্বাভাবিক বোধ হারিয়ে স্ত্রীকে ডাকে মা এবং মাকে ডাকে স্ত্রী, বাপকে ডাকে শ্বশুর এবং শ্বশুরকে ডাকে বাপ। মদ মূলত ব্যভিচার চেয়েও জঘন্য। কারণ তা বিবেককে নষ্ট করে দেয় এবং চিন্তা-চেতনাকে হরণ করে। এমনকি অবচেতন অবস্থায় মারাত্মক গর্হিত কাজেও লিপ্ত হয়ে পড়ে। যেমন- মাতাল অবস্থায় খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি সংঘটিত হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়। এই জন্য শয়তান মানুষকে এমনভাবে উৎসাহ দিয়ে বলে যে, আরে এটা তো স্রেফ পানির মতো, একটু খেলে আর কী হবে। অনেক দিন পানির স্বাদ নিয়েছ। এখন একটু অন্য জগত থেকে ঘুরে আসো- ইত্যাদি প্ররোচনার জালে বন্দী করে যেন মদ পানের মধ্য দিয়ে আরো অনেক অপরাধের শিকারে পরিণত করতে পারে।

জুয়াও নেশার অন্যতম একটি অংশ। জুয়ার বিভিন্ন ধরন ও পর্যায় রয়েছে। জুয়া এমন একটা নেশা যদি প্রথম জিতে যায় তাহলে অনেক অর্থ কিংবা সম্পদের অধিকারী হয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে শয়তান প্ররোচনা দিয়ে বলে যে, তুমি আরো খেলো। হয়তো তুমি আবার জিতবে এবং আরো অনেক অর্থের অধিকারী হবে। অতঃপর যখন পুনরায় জুয়ার আসরে বসে তখন মুনাফাসহ নিজের আসল পর্যন্ত হারিয়ে বসে। কিন্তু শয়তান বসে থাকে না, আবার বলতে থাকে, আরে একবার হারছ তো কী হয়েছে? হার-জিত সবকিছুতে থাকে। তুমি আবার চেষ্টা করো হয়তো এবার জিতবে। এভাবে প্ররোচিত হতে হতে জুয়ার আসরে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সংসার ধ্বংস হয়ে যায়। অর্থের তাড়নায় শুরু করে স্ত্রীর ওপর অমানবিক নির্যাতন। বাড়ি-ঘর ও জায়গা-জমি হারিয়ে সর্বশেষ অসহায় হয়ে পড়ে থাকে। অবশেষে আত্মহত্যার পথও অনেকে বেছে নেয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- মদ ও জুয়া আল্লøাহর স্মরণ ভুলিয়ে দেয়। এই জন্য আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ, নিশ্চয় মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও। শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?’ (সূরা মায়িদাহ, আয়াত : ৯০-৯১)

দ্বিতীয়ত, দারিদ্র্যতার মাধ্যমে প্ররোচনা। শয়তান দরিদ্রতার ভয় দেখিয়ে প্ররোচনা দিয়ে বলে যে, তুমি দরিদ্র এবং কিভাবে তোমার সন্তান-সন্ততিদের খাওয়াবে ও পড়াবে? সুতরাং বেশি সন্তান গ্রহণ করো না। তবে পরস্পর মিলন করো ‘আজল’ করে কিংবা বিশেষ জন্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। শয়তান যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা হলো হারাম ও নিষিদ্ধ পথের। একটা হালাল সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও শয়তান হারামের জন্য প্ররোচিত করে। এই জন্য আল্লøাহ তায়ালা বলেন, ‘শয়তান তোমাদেরকে দরিদ্রতার ভয় দেখায় এবং অশ্লীল কাজে উৎসাহ দেয়। আর আল্লাহ তোমাদেরকে তার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত-২৬৮)

তৃতীয়ত, অবিশ্বাস ও অশান্তি সৃষ্টি করা। একটি পরিবারে তখন অশান্তির সূচনা হয় যখন ভাইয়ের মধ্যে ভাইয়ের সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। এটা হওয়ার অনেক কারণ থাকে। শয়তান যেভাবে হজরত ইউসুফ আ: ও তাঁর ভাইদের মধ্যে সম্পর্ক বিনষ্ট করে। আল্লøাহ বলেন, ‘শয়তান ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক বিনষ্ট করে।’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত- ১০০)

আল্লাহ তায়ালা পরিবারের যে কারো আয়ের মাধ্যমে বাকি সদস্যদের রিজিকের ব্যবস্থা করেন। তাই পরিবারের যে সদস্য ভালো আয় করে তার এটা ভাবা উচিত নয় যে, আমি সবকিছু করি, আমার উপার্জনের টাকা সব এবং আমার জন্য তাদের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে ইত্যাদি। মূলত এ ধরনের মনোভাব অন্তরে শয়তান সৃষ্টি করে থাকে। আল্লøাহ চাইলে অন্যের মাধ্যমেও সবার রিজিকের ব্যবস্থা করতে পারতেন। সুতরাং অহঙ্কার করার কোনো অর্থ নেই। শয়তান বিভিন্ন খুঁত প্রদর্শন করে ভাই-ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দিতে পারে। বিশেষ করে যখন ঘরে স্ত্রী থাকে তখন এর মাত্রা আরো তীব্রতর রূপ নিয়ে থাকে।

চতুর্থত, অপব্যয় শয়তানের অন্যতম নিকৃষ্ট কর্ম। সাধারণত অর্থ ব্যয়, খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ, সময়-সর্বক্ষেত্রে অপচয় লক্ষণীয়। পান করার শেষে কিছু রেখে দেয়া, খাবার গ্রহণের শেষে পরিষ্কার করে না খেয়ে অবশিষ্ট কিছু রেখে দেয়া, অপ্রয়োজনীয় কাজে অর্থ ব্যয় ও অবসর সময়কে কাজে না লাগিয়ে নষ্ট করা ইত্যাদি সবকিছুই শয়তানের অপকর্ম। এগুলো মূলত শয়তানের চারিত্রিক গুণাবলিরই। এ জন্য আল্লøাহ বলেন, ‘নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের প্রতি খুবই অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত-২৭)
পঞ্চমত, অনেকে নেশা করে কিংবা ধূমপান করে আর অশ্লীলতার মধ্যে গড়াগড়ি করে। কিন্তু মাঝে মধ্যে নামাজ শুরু করতে চাইলে শয়তান তাদেরকে এমনভাবে ধোঁকা দেয় যেন তারা নামাজ থেকে বিরত হয়। সে বলে, তুমি এখন মদ পান করেছ, গাঁজা খেয়েছ ও ধূমপান করেছ। তোমার লজ্জা হয় না তুমি এখন নামাজ পড়বে? তোমার মুখ থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে এবং তুমি মসজিদে গেলে লোকেরা তোমাকে ছি ছি করবে। এমনকি তোমার দিকে ঘৃণার চোখেও তাকাবে ইত্যাদি। তুমি বরং কিছুক্ষণ রেস্ট নাও এবং অন্য কিছু পান করো। যখন মুখের দুর্গন্ধ চলে যাবে তখন পড়ে নিও। মসজিদে পড়তে না পারলে কি হবে, বাড়িতে হলেও পড়ে নেবে। ফলে নামাজের ওয়াক্ত গড়িয়ে যায় আর নামাজ পড়া হয় না। এ ধরনের মিথ্যা আশ্বাস ও প্ররোচনার মাধ্যমে শয়তান মানুষকে নামাজ থেকে বিরত রাখে।

কারো জাকাত আদায়ের সময় হলে শয়তান দুশ্চিন্তা নিয়ে উপস্থিত হয় এবং বলে, তুমি অনেক কষ্টের বিনিময়ে অর্থ উপার্জন করেছ আর তা সঞ্চয় করেছ অতি যতেœ। এখন কি না বিনা কারণে তোমার উপার্জিত টাকার কিছু অন্যের হাতে দিয়ে দেবে? তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? আচ্ছা, যাক যদি দিতে চাও তাহলে আরো কিছু অর্থ উপার্জন করো এবং পরের বছর ভালো করে দান করো। শয়তান এভাবে পরের বছরও একই ধোঁকার শিকার করে। ১০ হাজার টাকা জাকাত দিতে তার দুশ্চিন্তা এমনভাবে শয়তান বাড়িয়ে দেয় যেন ১০ লাখ টাকার মাথাব্যথা শুরু হয়।
ফজরের অ্যালার্ম বেজে উঠলে শয়তান বলে- আরো অনেক সময় রয়েছে, উঠবে আরকি। আর পাঁচ মিনিট রেস্ট নাও। ফলে পাঁচ মিনিট হয়ে যায় সকাল ১০টা। যখন ফজরের নামাজ মিস হয় তখন শয়তান জোহরের সময় হলে বলে, আজ ফজর মিস করেছ। এখন ভাঙাচুরা কী নামাজ পড়বে! আগামীকাল থেকে নতুন করে শুরু করিও। এভাবে শয়তান আসর, মাগরিব ও এশা নামাজও কাজা করায়।

কোনো আড্ডায় কিংবা কোনো উৎফুল্ল আলোচনায় ডুবন্ত থাকলে এবং নামাজের সময় উপস্থিত হলে তখন আলোচনার আনন্দ আরো দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। ফলে মসজিদের দিকে পা এগিয়ে যায় না, যেন পেছন দিক থেকে কেউ টেনে রাখে। অতঃপর যখন কোনো মুসল্লিø পথ দিয়ে হেঁটে যায় এবং আহ্বান করে নামাজের তখন শয়তান প্ররোচনা দিতে শুরু করে এবং সন্দেহের জাল বোনে অন্তরে। আর বলে, তুমি এখন প্রস্রাব করতে গিয়ে ভালো করে পরিষ্কার হওনি কিংবা তোমার কাপড় অপবিত্র। সুতরাং নামাজ পড়লে হবে না ইত্যাদি।

কোনো খারাপ স্বভাব ত্যাগ করতে চাইলে তখন শয়তানের তৎপরতা আরো বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেমনÑ আগে অশালীন মুভি দেখতে কিংবা গান শুনতে এবং তা এখন পরিত্যাগ করেছ। দেখবে, দু’দিন অতিবাহিত হতে না হতেই সেই মুভি দেখা কিংবা গান শোনার তীব্রতা আগের চেয়ে পাঁচগুণ বেড়ে গেছে। মূলত এই তীব্রতা হলো শয়তানের প্ররোচনা। এভাবে ভালো কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে শয়তান বাধা সৃষ্টি করে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us