ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দামকে কেন সাহায্য করেছিল যুক্তরাষ্ট্র?

আবু রূশ্দ | Jul 02, 2021 03:59 pm
সাদ্দাম হোসেন ও যুক্তরাষ্ট্র

সাদ্দাম হোসেন ও যুক্তরাষ্ট্র - ছবি : সংগৃহীত

 

ইরানের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করেছিল ইরাকই। কিন্তু ইরানিরা সফলভাবে তা প্রতিরোধ করে। তারপর ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি এসে ইরাকের বাহিনী আক্রমণ তো দূরের কথা রক্ষণাত্মক অবস্থানেও নিজেদের সুরক্ষিত মনে করতে স্বস্তি পাচ্ছিল না।

এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রশাসন ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তড়িঘড়ি করে সন্ত্রাসে সমর্থনদানকারী দেশের তালিকা থেকে ইরাকের নাম বাদ দেয়। কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে ইরাকের সাথে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপন করে। মার্কিন সম্মতিক্রমে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি ইরাকে সমরাস্ত্র বিক্রি শুরু করে। এর মধ্যে সে সময়ের অত্যাধুনিক মিরাজ জঙ্গিবিমান, এক্সোসেট মিসাইল অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাশাপাশি ১৯৮৩ সালের ১২ জুলাই স্বাক্ষরিত ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডিসিশন ডিরেক্টিভ ৯৯- এ স্বাক্ষর করেন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান যার পরিপ্রেক্ষিতে পারস্য উপসাগর এলাকাসহ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক তৎপরতা জোরদার করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। আমেরিকা অতি গোপনে ইরাককে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত ইরানের সৈন্য সমাবেশ, চলাচল, অবস্থান সম্পর্কিত তথ্যসহ আনুষঙ্গিক গোয়েন্দা সহায়তা দেয়া শুরু করে। কিন্তু প্রকাশ্যে দুই পক্ষের মধ্যে নিরপেক্ষ অবস্থানের কথা প্রচার করতে থাকে মার্কিন সরকার। তবে তারা এটা ভেবে স্বস্তি বোধ করে যে ইরাকের পর্যাপ্ত আধুনিক সমরাস্ত্র ইরানের কোনো বড় আক্রমণ থেকে ইরাককে রক্ষা করবে। এই বিশ্লেষণের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে তার অন্যতম মিত্র সৌদি আরবের কাছে অত্যাধুনিক অ্যাওয়াকস বিমান ও এফ-১৫ জঙ্গি বিমানসহ অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ জোরদার করে।

এদিকে ইরানি বাহিনীর হাতে মার খেয়ে সাদ্দাম হোসেন বড়ই অপমানিত বোধ করেন। তিনি দেখতে পান যে প্রচলিত যুদ্ধ কৌশলে ও প্রচলিত যুদ্ধাস্ত্র যেমন জঙ্গি বিমান, ট্যাংক, কামান ব্যবহার করে ইরানকে পরাস্ত করা যাবে না এবং তিনি ভীত হয়ে পড়েন এই আশঙ্কায় যে ইরানিরা ইরাকের ভূমি দখল করে নিতে পারে। সব স্বৈরশাসক সবসময় যে বিষয়টিকে ভয় পান তা হলো ক্ষমতা হারানো। যেহেতু তারা নির্বাচন বা জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে ক্ষমতায় আসেন না তাই তারা চমক দেখানোর জন্য অবকাঠামো উন্নয়নসহ কথিত আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেন শান্তিকালীন সময়ে। পাশাপাশি বিশাল সমরাস্ত্র ভান্ডার গড়ে তুলে শুধু ‘বিশ্বস্ত’ দলীয় লোকদের দিয়ে গড়ে তোলেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত বৃহৎ অবকাঠামোর সশস্ত্র বাহিনী। এটা যত না যুদ্ধের জন্য তৈরি করা হয় তার চেয়ে বেশি কাজে লাগানো হয় নিজ জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে।

গোয়েন্দা বাহিনীর অবস্থাও থাকে একইরূপ। লক্ষ্য সবার এক, বসকে ক্ষমতায় রাখা। তার স্বার্থ রক্ষা করা। দলের জন্য প্রয়োজনে হাজার হাজার, লাখ লাখ বিরোধী মতের মানুষ মেরে ফেলা, গুম করা হয়। কিন্তু যখন যুদ্ধ আসে তখন বোঝা যায় ওই সেনাবাহিনীর আসল ক্ষমতা। ঘুণে ধরা, বিলাস-ব্যসনে মত্ত, দলীয় ক্যাডারের মতো ওই সেনাবাহিনী তখন সাধারণ অস্ত্রে সজ্জিত শত্রুর হাতেও পিটুনি খায় খুবই সহজে। সাদ্দামের সশস্ত্র বাহিনীও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ইরানিরা লড়েছিল আদর্শের ওপর ভিত্তি করে, দেশের সম্মানের জন্য। আর সাদ্দাম বাহিনী লড়েছে একনায়ক সাদ্দামকে রক্ষার জন্য।

এক পর্যায়ে সাদ্দাম বুঝতে পারেন যে তিনি যদি যুদ্ধে কোনোভাবে পরাজিত হন তাহলে তার পরিবারসহ পুরো বাথ পার্টি ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই যেভাবেই হোক ক্ষমতায় থাকতে হবে। তিনি তাই বেছে নেন অপ্রচলিত কিন্তু ভয়ঙ্কর পথ। ১৯৮৩ সালের শুরু থেকে ইরানের সেনাবাহিনীসহ সাধারণ জনগণের ওপর শুরু করেন বিষাক্ত গ্যাস রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার। অমানবিক এসব গ্যাস আক্রমণে মারা যায় হাজার হাজার ইরানি নারী ও শিশু। এমনকি সকালে স্কুলে যাওয়ার পথে মার হাত ধরে পথ চলা শিশু রাস্তাতেই মরে পড়ে থাকে। ইরাকের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে মার্কিন আর্মি ইন্টেলিজেন্সের একজন সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিক ফ্রাংকোনা যিনি একসময় বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে নিয়োজিত ছিলেন, ২০০২ সালে ব্রিটিশ গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেন, ‘ইরাকিরা যুদ্ধের প্রতিটি ধাপে মাস্টার্ড গ্যাস ব্যবহার করেছে... তারা ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে টাবুন নামের নার্ভ গ্যাস ব্যবহার শুরু করে... এবং ১৯৮৮ সালের মধ্যে সারিন গ্যাস উৎপাদনে সক্ষম হয়।’ এমনকি ১৯৮৩ সালের ১ নভেম্বর তদানীন্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ শুলজকে গোয়েন্দা সংস্থা ‘প্রায় প্রতিদিন ইরাকি বাহিনীর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের’ তথ্য প্রদান করে।

ইরানের কয়েকটি বড় শহরে যখন ইরাকি বাহিনী রাসায়নিক অস্ত্র নিক্ষেপ করে হাজার হাজার নিরীহ বেসামরিক মানুষ হত্যা করে তখন ১৯৮৩ সালেই ইরান জাতিসঙ্ঘের কাছে এ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য দেয়। কিন্তু তখন প্রায় সব বৃহৎ শক্তির সাথে ইরান কূটনৈতিক পর্যায়ে অনেকটা বিচ্ছিন্ন থাকায় সেসব অভিযোগ খুব একটা পাত্তা পায়নি। এমনকি ১৯৮৩ সালের নভেম্বর মাসে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এক মেমোতে উল্লেখ করা হয় যে, সাদ্দাম হোসেন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কুর্দিদের বিরুদ্ধেও ব্যাপক হারে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করছেন। মার্কিনিরা এসব ঘটনায় প্রকাশ্যে আনমুভড থাকলেও ভিতরে ভিতরে অনেকটা নার্ভাস হয়ে পড়ে এই ভেবে যে ইরাক যদি এভাবে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে সঙ্কট আরো বেড়ে যাবে, মার্কিনিদের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে যা কিনা তখন আফগানিস্তানে চলমান সোভিয়েতবিরোধী যুদ্ধে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এমনও হতে পারে যে মুসলিম বিশ্ব যারা কিনা প্রায় একচেটিয়াভাবে আফগানিস্তান ইস্যুতে মার্কিনিদের পক্ষাবলম্বন করেছে তারা সমর্থন প্রত্যাহার করতে পারে।

এসব বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট রিগ্যান সিদ্ধান্ত নেন ইরাকি কর্তৃপক্ষের সাথে উচ্চ পর্যায়ে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার। তখন বেছে নেয়া হয় প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সময়ে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী ডোনাল্ড রাফসফেল্ডকে প্রেসিডেন্টের বিশেষ প্রতিনিধি হিসাবে ইরাকে পাঠানোর জন্য।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us