ফ্রাংকফুট : অজানা খেয়ালে

মীর সালমান শামিল | Jul 06, 2021 01:54 pm
ফ্রাংকফুট : অজানা খেয়ালে

ফ্রাংকফুট : অজানা খেয়ালে - ছবি : লেখক

 

১.

আজ ফ্রাংকফুটে আমার দ্বিতীয় ও শেষ দিন। গত দিনের মতো আর উদ্দেশ্যহীনভাবে না; আজ ফ্রাংকফুট দেখতে হবে একটু গুছিয়ে। ইতিহাস ঘেটে ফ্রাংকফুট শহরের গোড়াপত্তন ঠিক কবে তা নিয়ে কোনো তথ্য পেলাম না। এই শহরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ৭৯৪ সালে। ১৩৭২ সালের ফ্রাংকফুট পবিত্র রোম সাম্রাজ্যের অধীনে রাজার বিশেষ শহরের মর্যাদা পায়।

রোম সাম্রাজ্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অনেকই খেই হারিয়ে ফেলে। কারণ এক নামে চারটা সাম্রাজ্য ছিল। দ্বিধার কিছু নেই। ব্যাপারটা আমি সহজ করে বলার চেষ্টা করছি।

প্রথমত, রোম সাম্রাজ্য ছিল একটা বিশাল সামাজ্য। এই সাম্রাজ্য ভেঙে যায় ২৮৫ সালে। ভেঙে আলদা দুটি সাম্রাজ্য হয়।

ইতালির রোমকে কেন্দ্র করে হয় পশ্চিম অঞ্চলীয় রোম সাম্রাজ্য যার পতন হয় ৪৭৬ সালে। আর কনস্টান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে হয় পূর্ব আঞ্চলীয় রোম সাম্রাজ্য। পূর্ব আঞ্চলীয় রোম সাম্রাজ্যকে বাইজেনন্টাইন সাম্রাজ্য বলেও অভিহিত করা হয়। পূর্ব আঞ্চলীয় রোম সাম্রাজ্যের পতন হয় ১৪৫৩ সালে। জুলিয়াস সিজারের পর থেকে সকল রোমক সম্রাটদের বলা হয় সিজার।
রাজা প্রথম অটো এই ধ্রুপদি নাম অনুসারে ৯৬২ সালে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠা করেন পবিত্র রোম সাম্রাজ্য (এখানে একটা বিশাল রাজনীতি আছে। সেই আলাপ একটু পরে করছি)। এই সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল ভিয়েনা, প্রাগ।

পবিত্র রোম সাম্রাজ্যে কিছু বিশেষ শহর ছিল। এই শহরগুলো অনেকটা স্বাধীনতা ভোগ করত। এই সব শহরের কোনো জমিদার বা গভর্নর থাকত না। শহরের একদল প্রতিনিধি সরাসরি সম্রাটকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিত। ফ্রাংকফুট ছিল তেমনই একটা বিশেষ শহর। এই শহরে ব্যবসায়ীদের দাপট তখন থেকেই শুরু। ১৫৬২ সাল থেকে পবিত্র রোম সাম্রাজ্যের রাজার অভিষেক হতো ফ্রাংকফুটে। ১৮০৬ সালে পবিত্র রোম সাম্রাজ্যের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই প্রথা বলবৎ ছিল। সাম্রাজ্যের পতনের পরে ফ্রাংকফুট পুরোপুরিই স্বাধীনতা হয়ে যায়। ১৮১৫ সালে ফ্রাংকফুট সংযুক্ত জার্মানিতে একটা স্বাধীন প্রদেশ হিসেবে যোগ দেয়। একই শতাব্দীর শেষের দিকে অতিদ্রুত শিল্পায়নের কারণে ফ্রাংকফুটের আকার এবং জনসংখ্যা দুটোই নাটকীয় ভাবে বাড়ে।

২.
বন্ধুর বাসা শহরের এক প্রান্তে। ওর বাসা থেকে খানিক দূরে একটা বাগান। সকালের খাবার শেষ করে প্রথমেই বাগানের দিকে গেলাম। ঠিক গোছানো বাগান না; অনেকটা জঙ্গল প্রকৃতির বাগান। বড় করে লেখা- জঙ্গলের ভেতরে কিছু অংশে প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কারণ মহাযুদ্ধের মাইন পোঁতা আছে ওখানে। মাইন অন্যতম কুখ্যাত যুদ্ধাস্ত্র। মাইন একবার পুঁতলে সেটা আর নিস্ক্রিয় করা যায় না। আর সমস্যা হলো মাটির খানিকটা গভীরে পোঁতা হয়। তাই কিছু দিন পরে যারা মাইন বসিয়েছিল, তারাও ভুলে যায় কোথায় বসানো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাইনের শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। তাই জাতিসঙ্ঘ মাইন ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। তবে ক্ষমতাবানদের কাছে আইন কিছুই না। নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আফগানিস্তান, ইরাকে প্রচুর মাইন ব্যবহার করেছে ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি।

মাইনের সর্তকবার্তা দেখেই একটা ঘটনা মনে পড়ল। ১৯৩০-এর দশকে এক ব্রিটিশ নৃ-বিজ্ঞানী বার্মা যান। তিনি লক্ষ্য করেন, ছেলেরা আগে হাঁটে, আর মেয়েরা ছেলেদের পিছু পিছু হাঁটে। তিনি উপসংহার টানলেন- এটা পুরুষদের প্রধান্য থাকার ফল। এরপর ১৯৫০-এর দশকে তিনি আবার বার্মা যান। তিনি এবার লক্ষ্য করলেন সম্পূর্ণ উল্টা : মেয়েরা আগে হাঁটছে আর ছেলেরা হাঁটছে মেয়েদের পিছু পিছু। তিনি বুঝতে পারলেন, গত ২০ বছরে বার্মায় মেয়েদের মধ্যে একটা বিপ্লব হয়ে গেছে। এখন মেয়েরা আর ছেলেদের পিছু পিছু চলে না বরং ছেলেরাই মেয়েদের পেছনে চলে। তিনি হোটেলে ফিরেই এই ব্যাপারে একটা তাত্ত্বিক নিবন্ধ লিখে ফেললেন এবং পর দিন তার বর্মী বন্ধুকে বললেন এই নিবন্ধের কথা। এটা শুনে তার বর্মী বন্ধু বললেন, ব্যাপারই ঠিক তা না। ঘটনা হলো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানিরা পুরো বার্মাতে মাইন পুঁতেছে। মাঝে মাঝেই মাইন বিস্ফোরণ হয় নানা জায়গায়। তাই এখন ছেলেরা জোর করে মেয়েদের সামনে ঠেলে দিয়েছে মাইন আছে কিনা সেটা নিশ্চিত হতে...

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কথা এলেই প্রথমে আসে এই জার্মানির কথাই আসে। জার্মানির অনান্য অংশের মতো ফ্রাংকফুটেও যুদ্ধের থাবা পড়ে। গুরুত্বপূর্ণ শহর হওয়ার জন্য স্বাভাবিকভাবেই মিত্র শক্তির আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ফ্রাংকফুট। ১৯৪০ সালের জুন মাস থেকে মার্কিন বিমান বাহিনী ফ্রাংকফুটে বিমান হামলা শুরু করে। পাঁচ বছরে তারা ২৬ হাজার টন বোমা নিক্ষেপ করে এ শহরে আর ব্রিটিশ বিমানবাহিনী করে ১৪ হাজার টন। ফ্রাংকফুটের কিছু এলাকার ৭০ ভাগ আর কিছু এলাকার ৯০ ভাগ স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। একটি ছবি দেখলাম যুদ্ধের পরের। মাইন নদীর এক পাড় ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছিল। একমাত্র গির্জা ছাড়া আর সব ভবনই মাটির সাথে মিশে গেছে। ১৯৪৫ সালের ২৬-২৯ মার্চ জার্মান ও আমেরিকার মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে এই শহরে যুদ্ধের শেষ হয়। যুদ্ধশেষে ফ্রাংকফুটের জনসংখ্যা (৫,৫৩,০০০) প্রায় অর্ধেকে আসে (২,৩০,০০০)!

৩.
পার্ক ছেড়ে এবার ফ্রাংকফুটের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবন দর্শনের উদ্দেশে বের হলাম। জায়গাটার নাম রোমার। এখানেই কয়েক শ' বছর পবিত্র রোম সাম্রাজ্যের সম্রাটদের অভিষেক অনুষ্ঠান হতো। প্রথমে উবান নিলাম। উবান থেকে নেমে মিনিট সাতেক হাঁটতে হবে। কিভাবে চিনব!? গুগুল মানচিত্র! আমি ভূগোলে বেশ কাঁচা, তাই ফোন ধরে চলতে গিয়েও রাস্তা হারিয়ে ফেললাম। তিন/চার মিনিট বেশি লাগল। তবে গিয়ে কিঞ্চিৎ হতাশই হলাম। খুবই জৌলুসপূর্ণ একটা প্রাসাদ হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু একাবারেই সাদামাটা। পাশাপাশি তিন/চারটা ভবন। অটো সম্রাটরা খুবই মানবিক ছিল পড়েছিলাম, কথাটার যে সত্যতা আছে সেটা প্রথমবারের মতো অনুভব করলাম। রোমার পাশেই মাইন নদী, নদীর পাড়ে গিয়ে বসলাম। অটো রাজাদের এই সাদামাটা প্রসাদ ইতিহাসের সব গল্পকে মাথায় উসকে দিলো। একে একে মাথার মধ্যে সব আসা শুরু করল।

আগেই লিখেছিলাম পবিত্র রোম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা মহামতি প্রথম অটো। একটা ব্যাপার আমাদের মাথায় রাখতে হবে রেনেসাঁর আগে পর্যন্ত ইউরোপে যেই রাজা থাকুক না কেন ক্ষমতার রশি ছিল ভ্যাটিকানের হাতে। তখন সম্রাটকে বলা হতো ঈশ্বরের প্রতিনিধি আর গির্জা হলো ঈশ্বরের ছায়া। রাজদণ্ডে যেই বসুক না কেন ঈশ্বরের ছায়া গির্জার পাদ্রিদের নির্দেশ মতো সব করতে হতো। 'সম্রাট ঈশ্বরের প্রতিনিধি' ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের এই দর্শন দ্বারা পরে কিছু মুসলমান সুলতান প্রভাবিত হয়। তারা বলা শুরু করেন, 'আস সুলতানু জিল্লুল্লাহ ফিল আরদ।' সুলতান দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতিনিধি।

৪.
৭৬৮ সাল। পশ্চিমঞ্চলীয় রোম সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে প্রায় তিন শ' বছর। এই বছর ফ্রাঙ্কিয় রাজ্যের (বর্তমানকালের বেলজিয়াম, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড এবং পশ্চিম জার্মানি) সিংহাসনে বসলো উচ্চাবিলাশী রাজপুত্র শার্লেমাইন। বসেই সে হারিয়ে যাওয়া রোম সাম্রাজ্য এবং পবিত্র ক্রুশের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার জন্য শুরু করলেন অভিযান। যারাই পোপের আনুগত্য শিকার করতে অস্বীকার করত তাদের উপরই নেমে আসত গজব। শার্লেমাইনের সেনাবাহিনী পিশে ফেলতে লাগল একের পর এক শহর। ৭৮২ সালের এক দিনে শার্লেমাইনের বাহিনী ৪ হাজার ৫ শ' স্যাক্সনকে পশুর মতো হত্যা করেল। শার্লেমাইনের এই বাহিনীর সামনে স্যাক্সনদের জন্য রাস্তা ছিল দুটা, হয় মৃত্যু না হয় খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ। স্যাক্সন সম্রাটরা দ্বিতীয় পথই বেছে নিলেন এবং খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন বা বাধ্য হলেন। তাই এ কথা বহুকাল প্রচলিত ছিল স্যাক্সনরা বিশেষ করে স্যাক্সন রাজারা খ্রিস্টান নয়। শার্লেমাইন তাদের হত্যা ও খ্রিস্টীয়করণই শুধু নয়, স্যাক্সনদের সমাজ, সংস্কৃতি সবই ধ্বংস করে দেন। আইন করে মিনার তৈরি নিষিদ্ধ করেন। (হ্যাঁ, মুসলমানদের পাশাপাশি জার্মানির স্যাক্সনদেরও সংস্কৃতির অংশ এই মিনার!)

ভেতরে ভেতরে স্যাক্সন রাজারা এই বীভৎস অতীত ভোলেননি। পোপের অধীনে ফুট-ফরমায়েশ খাটা থেকে বের হবার রাস্তা খুঁজেছেন সব সময় এবং এক সময় পেয়েও যান।

স্যাক্সন সম্রাট মহামতি প্রথম অটো স্পেনের মুসলিম সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। যোগাযোগের শুরুটা ছিল অবশ্য একটা ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে। স্পেনের সুলতানের সৈন্যরা আল্পস পর্বতের অনেক গিরিপথ দখল করে নিয়েছিল। তার ফলে জার্মান ব্যবসায়ীদের বাণিজ্য বহরের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। সুলতানের সৈন্যরা যেন আল্পসের গিরিপথগুলো ছেড়ে দেয় অথবা বাণিজ্যবহর যাতায়াতের অনুমতি দেয়, ৯৫৩ সালে এই অনুরোধ নিয়ে সম্রাট প্রথম অটোর প্রতিনিধিদল সুলতান আবদুর রহমানের রাজধানী কর্ডোভায় একটা যায়। প্রতিনিধিদল এক মাস কর্ডোভায় ছিল। সুলতান আব্দুর রহমান সম্রাট অটো'র সম্মান রেখেছিলেন। এটাই শুরু। প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে সম্রাট অটো জানতে পারলেন, মুসলমানদের আচার স্যাক্সনদের আচারের মধ্যে অনেক মিল। উভয়েরই জীবন যাপন সহজ সরল, মূর্তি বা দেবতা পূজা নেই, সমাজে কোনো শ্রেণীভেদ নেই, মুসলমানদের মসজিদের মিনার স্যাক্সনদের মিনারের মতোই।

তিনি ভেবেছিলেন, রোমকদের অত্যাচার-আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে স্পেনের সুলতানদের সাথে ঐক্য হতে পারে একটা সমাধান। এই ঐক্য হলে একটা বিরাট শক্তি হিসেবে দেখা দেবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সম্রাট অটো স্পেনের সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের কাছে আরো একটা প্রতিনিধিদল পাঠালেন। এবার পাঠালেন একটা গোপন চিঠি দিয়ে। সময়মতো জবাবও এলো। চিঠির জবাবে সুলতান আবদুর রহমান যা লিখেছিলেন তার সারংশ হলো, 'সম্রাটের বক্তব্য ও মতামতকে স্পেনের খেলাফত সাদরে গ্রহণ করেছে। রাসুলুল্লাহ সা.-এর উত্তরসূরি এই খিলাফত জাতি, বর্ণ, ভাষাসহ সকল অবিচারের বিরোধী। যে ঐক্য-সহযোগিতা মানুষের মর্যাদা এবং সমৃদ্ধির স্বার্থে, আমরা তার পক্ষে। এ নীতির ভিত্তিতে সম্রাটের সাথে আমাদের ঐক্য ও সহযোগিতা হতে পারে। এই লক্ষ্যে সম্রাটের সাথে আমাদের আরো আলোচনা চলবে।

আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছিল। কিন্তু ৯৬১ সালে সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের মৃত্যু হলে তাতে ছেদ পড়ে। অন্যদিকে একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের উত্তরসূরি দ্বিতীয় হাকামের কাছে শোক প্রকাশ ও আবার আলোনা শুরু সংক্রান্ত প্রথম অটোর একটা চিঠি যাত্রাপথে সম্রাটের প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে চুরি হয়ে যায় এবং তা পোপের হাতে পড়ে!
ভ্যাটিকানে এর প্রতিক্রিয়া হয় জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পরে যেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো তেমন। হয়তো স্যাক্সন রাজারা পোপের ক্রোধের আগুন পুড়ে ছাড়খার হয়ে যেতেন। তবে ভাগ্য সাহায্য করে স্যাক্সন রাজাদের। ওই সময়ে ভ্যাটিকানের লক্ষ্য আরো অনেক বড়, পবিত্র ভূমি জেরুসালেম। তারা এই প্রস্তুতি পর্বে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধকে তারা সমুচিত মনে করেনি।

এই অবস্থায় সম্রাট অটো পরিস্থিতিকে শান্ত করার জন্যে চুপ হয়ে যান এবং স্পেনের সাথে যোগাযোগ আপাতত বন্ধ করে দেন। নতুন করে সাম্রাজ্যের নামকরণ করেন, নাম রাখেন পবিত্র রোম সাম্রাজ্য। এতে পরিস্থিতি শান্ত হয়। কয়েক বছর পর হয়তো সম্রাট অটো আবার যোগাযোগ শুরু করতেন তবে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই অসুখেই ৯৭৩ সালে সম্রাট অটো মারা গেলেন। এভাবে সম্রাট প্রথম অটোর একটা স্বপ্ন একের পর এক ধাক্কা খেয়ে পেছনে পড়ে যায়, যা আর সামনে এগোয়নি। আহারে কোথায় হারিয়ে গেল খেয়া ঘাটের দশটি কড়ি!

৫.
আবার পথে নামলাম। লক্ষ্য মহাকবি ফন গ্যোথের বাড়ি। গ্যোথে ১৭৪৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। কবির জন্মের সময় ফ্রাংকফুর্টের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ হাজার! আমাদের শুধু উত্তরাতেই ৫/৭ লক্ষ মানুষ আছে কমপক্ষে। বেশ কয়েক বাঁক পেরিয়ে কবির বাড়ি খুঁজে পেলাম। মহাকবি গ্যোটে তার জীবনের ২৫ বছর কাটিয়েছিলেন এখানে৷ বাড়িটি এখন লাইব্রেরি ও জাদুঘর। অবধারিতভাবে সব বন্ধ। এখন পৃথিবীর অসুখ। কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। গুরু, দেখা হবে অন্য কোনো দিন!

ভ্যায়ার্টার লিখে তিনি জার্মান উপন্যাসের ধারা বদলে দেন; সেসেনহাইমার লিখে বদলে দেন জার্মান কবিতার রীতি; আর শেষে ‘গ্যোৎস’ নাটকটি দিয়ে তিনি জার্মান নাটকে বিপ্লব এনেছেন। এক ব্যক্তি কিভাবে এত কিছু করলেন! আহারে, এত কাছে এসেও কবির বাড়ির ভেতরটা দেখতে না পারার জন্য বেশ আক্ষেপ হলো। বাড়ির চিলেকোঠা দিয়ে পেছনের ফ্রাংকফুটের অট্টালিকা দেখা যাচ্ছিল। ব্যাপারটার একটা প্রতীকি গুরুত্বও থাকতে পারে!

পড়েছিলাম ফ্রাংকফুর্ট হলো জাদুঘরের শহর। আজ সেটা প্রত্যক্ষ অবোলকন করলাম। যেখানে আছি এই এলাকার প্রতি রাস্তার মোড়ে মোড়ে একটা করে জাদুঘর আর আছে গির্জা। কিছুটা ক্লান্ত হয়ে গেলাম এই আধিক্য দেখে৷ এই জাদুঘর আর গির্জা দেখতেই মাস পার হয়ে যাবে।

আবার যাত্রা শুরু হলো। অনেক হাঁটাহাঁটি করায় বেশ ক্ষুধা পেয়েছে। জার্মানিতে প্রবাসীদের জাতীয় খাবার হলো ডোনার কাবাব। আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ। আমিও তাদের বাইরে না। ঝলসানো মাংস সাথে সালাদ আর কয়েক পদের সস, কমপক্ষে ২০০/২৫০ গ্রাম মাংস দেয়। দাম মাত্র ৪ ইউরো। কথায় আছে সঙ্গদোষে লোহা ভাসে, আমার অবস্থাও অনেকটা তেমন। তিন বেলা হাতের চার আঙ্গুল দিয়ে মাখিয়ে ভাত খাওয়া আমি খাচ্ছি কাঁটা চামচ দিয়ে। পাতলা সসে ঝলসানো মাংস, সালাদ একত্রে মুখে দিতেই... ফাবি আইয়ে আলা রাব্বিকুমা তুকাযজিবান। তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে!

৬.
ফ্রাংকফুর্টের একটা ভালো ব্যাপার হলো, এখানে একটা বেশ বড় বাংলাদেশী দোকান আছে। বাংলাদেশী চানাচুর, চিপস, সিঙ্গারা, ডালপুরি সবই নাকি পাওয়া যায়। আজই ফিরব। কয়েক ঘণ্টা বাদে ট্রেন৷ যাবার আগে বাংলাদেশে দোকানে না গেলেই নয়। টুক টুক করে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম চলে। মনভরে কেনাকাটা করলাম। আমার প্রিয় মি. টুইস্ট না পেলেও বম্বে সুইটসের পটাটো ক্যাকার্স পেলাম। যেখানেই যাবেন হাত বাড়ালেই পাবেন! এই ছুতোয় একটা তথ্য দেই, মিট শব্দের মূল অর্থ ছিল খাবার। পরবর্তী মিট শব্দের ব্যবহার শুধু মাংস জাতীয় খাবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।

ব্যাগ ভারী হয়ে গেছে। কাঁধ বিদ্রোহ করবে। আর ট্রেন ছাড়তেও বাকি ঘণ্টা দুয়েক। দোকান থেকে বেড়িয়ে আবার নদীর দিকে গেলাম। বসার জায়গায় ব্যাগ রাখলাম। সামনে বই রাখার কাচের আলমারি দেখলাম। জার্মানির এই আচারটা আমার বেশ প্রিয়, লাইব্রেরি, খেলার মাঠ বা বাগানের পাশে বই রাখার আলমারি থাকে। যাদের কাছে অতিরিক্ত বই আছে বা পড়া শেষ তারা রেখে যায়। আপনার যে কয়টি ইচ্ছা নিতে পারবেন। দেখলাম কী কী বই আছে। আফসোস, সব বই-ই জার্মান ভাষায়। জার্মান ভাষাকে স্থানীয়রা বলে ডয়েচ। জার্মানিকে বলা হয় ডয়েচল্যান্ড। অস্ট্রিয়ার মানুষের ভাষাও জার্মান। মনটা খারাপ হয়ে গেল একটা বইও নিতে পারলাম না। এই ভাষাটা দেড় বছরেও রপ্ত করতে পারলাম না ঠিকমতো। জার্মান ভাষা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ভাষার একটা। একটা নমুনা বলি, কলমের জার্মান হলো ক্রুগেলসাইবার। বলা হয়, লাইফ ইজ টু শর্ট টু লার্ন জার্মান।

ঠান্ডা বাতাস বইছে বেশ জোরে। এই বাতাস শুধু শরীর না মনকেও দুর্বল করে দেয়। হঠাৎ করে যেন সবকিছুর ছন্দ পতন হলো। একটা আবেশ ঘিরে ধরল আমাকে। বসে রইলাম। সামনে মাঠ, উপরে নীল আকাশ। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। নিচে মাঠের পর নদী, নদীর ওপারে রাস্তা। হাঁটার রাস্তা। রাস্তা দিয়ে শিশু, কিশোর, তরুণ, মধ্য বয়স্ক, বয়স্ক; সব বয়সী মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। কেউ কেউ ফুটবাইক নিয়ে যাচ্ছে, কারো হাতে তার পোষা প্রাণীর দড়ি, কেউ কেউ আমার মতো উদাস হয়ে নদীর পারে বসে আছে, কেউ গল্প করছে, কেউ ফোনে কথা বলছে। রাস্তার পরে একটা গির্জা। সকল নীরবতাকে চুরমার করে দিয়ে গির্জায় ঘণ্টা ডং ডং করে বেজে উঠল। জানিয়ে দিলো আমার ট্রেন ছাড়তে আর বেশি দেরি নেই...


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us