অপরাজেয় খোরাসান

রাহাত খান রাছি | Jul 10, 2021 03:55 pm
অপরাজেয় খোরাসান

অপরাজেয় খোরাসান - ছবি : সংগৃহীত

 

যুদ্ধ, যোদ্ধা আর অস্থিতিশীলতার দেশ আফগানিস্তান। যুদ্ধময় জীবনে যারা পরাজিত হতে শিখেনি। কোনো গোত্রের কেউ প্রতিপক্ষের হাতে হত্যার শিকার হলে তার কবরের উপর একটি বর্শা বিদ্ধ করে তাতে প্রথমে হত্যাকারী তারপর ঘনিষ্ঠতার ক্রমানুসারে তার গোত্রের অন্যদের নাম লেখা হতো। আর ও তালিকার একাধিক ব্যক্তির উপর প্রতিশোধ নেয়ার পর উৎসব করে ওই বর্শা খোলা হতো (সৈয়দ মুজতবা আলী)- পাথুরে পাহাড়ের মতো দৃঢ় আর তীক্ষ্ণ ধারালো চেতনা আর পাথুরে নদীর মতো সরল আফগানদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে এই গল্পটা বহুল আলোচিত।

আফগানিস্তানে বহু বিচিত্র জাতির সমাহারে এক সঙ্কর জাতি। মধ্য এশিয়া, চীন, ভারতীয় উপমহাদেশ ও ইরান- এই চার সাংস্কৃতিক অঞ্চলের মিলন ঘটেছে এখানে। ফলে দেশটিতে সৃষ্টি হয়েছে বিপুল ভাষাগত ও জাতিগত বৈচিত্র্য। আফগানিস্তানের মানুষ ইরান, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, মঙ্গোলিয়া, চীন, আরব উপদ্বীপ ও আরো বহু জায়গা থেকে এসেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের চলাচল, রাজনৈতিক বিপ্লব, আক্রমণ, রাজ্যবিজয় ও যুদ্ধ বহু মানুষকে এই অঞ্চলে নিয়ে আসে। এদেরই কেউ কেউ আফগানিস্তানকে নিজের মাতৃভূমি বানিয়ে নেয়। রাজনৈতিক দল ও জাতিসত্তার ধারণা বহু পরে এই বিচিত্র জাতি-সমাহারের ওপর অনেকটা চাপিয়ে দেয়া হয়।

প্রাচীন খোরাসান তথা আফগানিস্তানের বর্তমান সীমারেখা ১৮ শ' শতকের শেষ দিকে দেশটিকে রুশ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যবর্তী 'বাফার' অঞ্চল হিসেবে বিবেচনা করে নির্ধারণ করা হয়। এই কৃত্রিম সীমান্ত বহু জাতির ঐতিহ্যবাহী বাসস্থলকে ভাগ করে ফেলে, যাদের মধ্যে আছে পশতু, তাজিক ও উজবেক। বহু যুদ্ধ আফগানিস্তানে জাতিগত বিদ্বেষ জিইয়ে রাখে। এমনকি এখনো আফগানিস্তানে অনেকে জাতি ও আত্মীয়তার বন্ধনকে রাষ্ট্রীয় বন্ধনের চেয়ে বড় হিসেবে গণ্য করেন। (উইকিপিডিয়া)

প্রাচীন ইতিহাসের মহাবীর আলেক্সান্ডার থেকে শুরু করে বারবার আক্রান্ত এই ভূমি প্রতিবারই তাদের অপরাজেয় পরিচয় ও ভাবমূর্তির প্রমাণ দিয়ে এসেছে।

মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বীর আর বিজেতা হিসেবে পরিচিত মহামতি আলেক্সান্ডার খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে আফগান ভূমি দখল করেন, কিন্তু স্বল্পায়ু আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পর পরই স্থানীয় আফগানরা তা পুনঃদখল করে নেয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে খোরাসানে বিজয়ী আলেক্সান্ডার ওই যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হন, যা তার মৃত্যুর কারণ।

তেমনই সপ্তম শতকের আরব ইসলামী খেলাফতের মুজাহিদরাও খোরাসান (আফগান) দখলে নিলেও তা তাদের দখলদারিত্ব রক্ষা করতে পারেননি। খোরাসানের ভূমিতে ইসলাম টিকলেও আরবদের শাসন টিকেনি। যদিও পরে আরেক আফগান উপজাতি উজবেক সামাদিন রাজবংশ ও গজনীর গজনবী রাজবংশের মাধ্যমে এই ভূমিতে ইসলাম ও ইসলামি শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুসংহত অবস্থান লাভ করে। এখানে উল্লেখ্য যে উজবেক আর গজনিও এই বৃহত্তর খোরাসানের অংশ।

একইভাবে গত সহস্রাব্দের সূচনা লগ্নে মোঙ্গল কিংবদন্তি চেঙ্গিস খান বিশ্ব জয়ের রুট হিসেবে আফগান ভূমি ব্যবহার করেন। কিন্তু এই পশতুন ভূমিতে শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি, বিশ্ব বিজেতা চেঙ্গিস তার যুদ্ধ যাত্রার প্রয়োজনে যাত্রা পথে বহুবার খোরাসান আক্রমণ করেন, বহু পশতুন জাতি গোষ্ঠীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে তাদের বহু ক্ষতিসাধন করলেও তিনি এ ভূমিতে কোনো ভিত্তি স্থাপন করতে পারেননি। অবশ্য তার বংশধরদের অনেকেই পরে আফগান জাতি সত্তার অংশ হয়ে আফগানিস্তান শাসন করছে। কিন্তু তাদের মোঙ্গল পরিচয়ের বদলে আগে ওই মাটির সন্তান পরিচয় গ্রহণ করে তবে।

ঠিক তেমনই তাতার বীর তৈমুর লং আফগান দখল করে ভারতবর্ষ শাসনে অগ্রসর হন। তার বংশধর ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকাররা পরে আফগান জাতির পরিচয় ধারণ করেন। একই কথা সত্য মোগলদের ক্ষেত্রেও। অবশ্য তার সমসাময়িককালে ভারতবর্ষ শাসক গোষ্ঠীগুলো ও মোগলদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী পাঠান (খান, লোদি, ঘোরি, সুরি) রাজবংশগুলো ও আফগান জাতি গোষ্ঠীর।

মোগল ও পাঠান কেউই কোনো দিন সম্মিলিত খোরাসান বা আফগান বা পশতুন ভূমির নিরঙ্কুশ শাসকে পরিণত হতে পারেনি। তাদের পর সাফাভি, হুতাক আর দুররানি রাজবংশের ভাগযোগের শাসনের অবসান ঘটিয়ে আফগান দখল করে বসে তৎকালীন উনিশ শতাব্দীর বিশ্বের মহাপরাক্রমশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।

ব্রিটিশরা আফগান দখল করলে ও তারা একদিনও শান্তিতে শাসন করতে পারেনি। শেষে ১৯১৯ সালের তৃতীয় ব্রিটিশ আফগান যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মহাপরাক্রমশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি একপ্রকার অপমানিত হয়েই আফগানিস্তান ত্যাগ করে।

তারপর আফগানিস্তানের উপর নজর পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রুশ সমাজতান্ত্রিক বলয়ের তারা আফগান দখল করে স্থানীয়দের নিয়ে পুতুল সরকার গঠন করে। কিন্তু আফগান মুজাহিদদের প্রচণ্ড জেহাদি জোশের কাছে টিকতে না পেরে একপ্রকার পলায়নই করে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, এই আফগান যুদ্ধ দিয়েই শুরু হয় মহাশক্তিধর সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক ও আদর্শিক পতন।

এখানে উল্লেখ্য যে এই আফগান সোভিয়েত যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ছায়াযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম দেয় আল কায়েদা, তালেবানসহ বহু স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর। এরাই আবার প্রয়োজন ফুরানোর সাথে সাথে মার্কিন কালো খাতায় নাম উঠায় জঙ্গি, সন্ত্রাসী মানবতাবিধ্বংসী সংগঠন হিসেবে।

নয়-এগারোর মহা চাঞ্চল্যকর ঘটনায় আমেরিকার অহঙ্কার পেন্টাগন আর অলংকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসলীলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ইসলামী মৌলবাদী সামরিক নেটওয়ার্ক আল-কায়েদা আর আল-কায়েদার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আশ্রয়দাতা তালেবান গোষ্ঠী ও তাদের অধীনস্ত সার্বভৌম রাষ্ট্র আফগানিস্তানকে। আর তার তথা কতিথ বদলা নেবার নামে তার অনুগত ন্যাটো জোট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সদা যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগান ভূমিতে।

আবার আফগানরা শিকার হলো দুই দশকব্যাপী আগ্রাসনের । আবার শুরু হলো যুদ্ধ। এই দুই দশকে তাদের গেরিলারা নাস্তানাবুদ করে তুলেছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী সামরিক জোট ন্যাটোকে। যার ফলে অনেকটা পালিয়ে যাবার অবস্থায় পড়ে ন্যাটো বাহিনী। আর ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এত বড় সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিকর ও ভয়াবহ অবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বা ন্যাটো বাহিনীকে মোকাবিলা করতে হয়নি।

ব্রিটিশ বাহিনী তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করেছে অনেক আগে সম্প্রতি জার্মান আর ইতালীয়রা তাদের সেনাবাহিনীর সর্বশেষ অংশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। অন্য ক্ষুদ্র ন্যাটোর অংশীদাররা প্রায় সবাইই ছেড়ে গেছে। আর নাইন ইলিভেনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও আনুষ্ঠানিকভাবে ছেড়ে দেবে আফগানিস্তান।

যেখানে বৈশ্বিক সমর কারবারি মার্কিনিরা সকল যুদ্ধ সংঘাত থেকেই তাদের বাণিজ্যিক মুনাফা আদায় করে নেয়, সেখানে তারা আফগান আক্রমণ করে হচ্ছে প্রচণ্ড অর্থনৈতিক লোকসানের শিকার। অর্থাৎ ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর আরেকটা সমর-রাজনৈতিক পরাজয়ের মুখোমুখি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

এ প্রসঙ্গে ৮ জুলাই ২০২১-এ এক সংবাদ সম্মেলনে বাইডেন স্পষ্ট করে বলেন, [এত দিন যা কিছু হয়েছে তা থেকে] ভিন্ন কোনো ফলাফল আসার যুক্তিপূর্ণ কারণ পাওয়া না গেলে আমি আর কোনো মার্কিন সেনাকে আফগানিস্তানে পাঠাব না।

বাইডেন ‘ভিন্ন কোনো ফলাফল’ পরিভাষা ব্যবহার করে আনুষ্ঠানিকভাবে একথার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে আফগানিস্তানে গত ২০ বছরের মার্কিন সেনা উপস্থিতির ফলাফল শূন্য। মার্কিন বাহিনী ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো আফগান যুদ্ধেও পরাজিত হয়েছে।

প্রবল অপরাজেয় মানসিকতা, সদা যুদ্ধংদেহী মনোভাব, পার্বত্যময় ভৌগোলিক পরিমণ্ডল আর অনাকাঙ্ক্ষিত জলবায়ু যুগের পর যুগ ধরে আফগান জনগোষ্ঠীকে করে তুলেছে স্বাধীনচেতা অজেয় এক জাতি।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us