বিশ্বে সম্ভবত বাংলাদেশেই গরুর গোশতের জন্য রক্ত ঝরেছে

মীর সালমান শামিল | Jul 21, 2021 10:31 pm
কোরবানির গরু

কোরবানির গরু - ছবি : সংগৃহীত

 

বাংলাদেশের অভিনবত্ব সম্ভবত একটা জায়গাতেই, গরুর গোশত। গরুর গোশতের জন্য সংগ্রাম, আন্দোলন এবং রক্ত দিতে হয়েছে, এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর আছে কিনা সন্দেহ। বনী ইসরাইলের সামেরির পরে ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গরু হলো পূর্ব বাংলার গরু।

সিলেটের রাজা গৌড় গৌবিন্দ সম্পর্কে কম-বেশি সবারই জানার কথা। শেখ বোরহানউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি তার শিশুপুত্রের আকিকার জন্য গরু কোরবানি করেছিলেন। এতে গৌড় গোবিন্দ ক্রুদ্ধ হয়ে শেখ বোরহানউদ্দিনের হাত কেটে দেন, শিশু পুত্রকে হত্যা করেন। বোরহানউদ্দিন বাংলার সুলতান শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের কাছে গিয়ে বিচার প্রার্থনা করেন। ফিরোজ শাহ তার ভাতিজা সিকান্দার গাজীর নেতৃত্বে একটা সেনাবাহিনী পাঠান। গৌড় গোবিন্দের শক্তিশালী বাহিনীর কাছে সিকান্দার গাজী দুবার পরাজিত হন। তৃতীয়বার প্রধান সেনাপতি নাসিরুদ্দিনের নেতৃত্বে আবারো অভিযান প্রেরণ করা হয়। এই জিহাদে ৩৬০ জন দরবেশকে নিয়ে হজরত শাহজালাল র. নাসিরুদ্দিনের বাহিনীর সাথে যোগ দেন। এবার গৌড় গোবিন্দ পরাজিত হয়, সিলেট বাংলা সালতানাতের সাথে যুক্ত হয়। সময়টা ছিল ১৩০৩ সাল।

একই ধরনের ঘটনা ঘটে মুন্সিগঞ্জে। ১১৭৮ সালে এখানে ইসলাম প্রচার করতে আরব থেকে আসেন হযরত আদম র.। তিনি একটি গরু কোরবানি করেন। এতে রাজা বল্লাল সেন ক্রুদ্ধ হয়ে সসৈন্যে হযরত আদম র.-এর বিরুদ্ধে অভিযানে নামেন। বল্লাল সেন আদম র.-কে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করেন। এর প্রতিক্রিয়াতে মুন্সিগঞ্জও বাংলা সালতানাত প্রতিষ্ঠা হয়।

১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্ত যায়। ব্রিটিশ ফিরিঙ্গিদের আমলে সূর্যাস্ত আইন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ বিভিন্ন আইনের কারণে প্রায় সব মুসলিম জমিদার পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের স্থানে বসানো হয় হিন্দুদের। হিন্দু জমিদাররা পুনরায় তাদের পূর্বোক্ত গৌড় গৌবিন্দ, বল্লাল সেনদের মতো গরু কোরবানির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেন।

মুসলমানরা এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সংগ্রাম করে, ব্রিটিশ সরকারকে একাধিকবার স্মারকলিপি দেয়। তবে হিন্দু জমিদাররা চরমতম নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে তা দমন করে।

ঢাকায় নবাব পরিবারের প্রভাব ছিল, একমাত্র এই ঢাকা ছাড়া সারাদেশে কোথাও মুসলমানরা গরু কোরবানি দিতে পারত না। সবাই ছাগল (বকরি) কোরবানি দিত। তাই কালক্রমে ঈদুল আজহা 'বকরির ঈদ' নামে পরিচিতি লাভ করে।

এভাবেই চলে শত বছর। এরপর খাজা সলিমুল্লাহ প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম লীগ। তারপর শেরে বাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তারপর ১৯৪৭। পূর্ব বাংলা মুক্ত হয় ব্রিটিশ বেনিয়া এবং হিন্দু জমিদারদের কালো হাত থেকে।

সুবাতাস বইতে শুরু করে। তবে তা একদিনে হয়নি। প্রাক্তন আমলা পি.এ নজির 'স্মৃতির পাতা থেকে' শীর্ষক বইয়ে চাকরি জীবনের কিছু ঘটনা উল্লেখ করেন (এই বইটা সম্ভবত এখন নিষিদ্ধ)। ১৯৫৬ সালেও নাটোরের মানুষ গরু কোরবানি দেবার কথা ভাবতেও পারত না। উনার উদ্যোগে ১৯৫৭ সালে নাটোর শহরে প্রথমবারের মতো গরু কোরবানি দেয়া হয়, তাও বহু কাঠখড় পুড়িয়ে। একের পর এক বাধা আসে। একই অবস্থা ছিলো ময়মনসিংহ, যশোরে।

এখন এই পূর্ব বাংলায় মুসলমানরা গরু কোরবানি দিতে পারে কিন্তু পশ্চিম বাংলার গল্প ভিন্ন। নড়বড়ে সীমান্তের ওপারে আরএসএস, বিজেপির ভারতে এখনো গরু কোরবানি করা নিষিদ্ধ। কাশ্মিরে তো সব ধরনের কোরবানিই নিষিদ্ধ। এখনো পশ্চিম বাংলা এবং ভারতের মুসলমানরা ঈদুল আজহাতে ছাগল কোরবানি করে। এখনো পশ্চিম বাংলায় এবং ভারতে ঈদুল আজহাকে বকরির ঈদ বলে অভিহিত করা হয়।

গরুর গোশত নেহাৎ একটা খাবার না। গরুর গোশত পূর্ব বাংলার মুসলমানদের শত বছরের সংগ্রামের একটা চিহ্ন। এজন্য সম্ভবত নজরুল বলেছিলেন,

"ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।
ওরে সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!
ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।"


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us