লিটন : স্বপ্নরঙিন না স্বপ্নভঙের প্রতীক

আফফান উসামা | Sep 17, 2021 08:35 pm
মাশরাফী ও লিটন দাস

মাশরাফী ও লিটন দাস - ছবি : সংগৃহীত

 

যার হাত ধরে বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশের সূচনা, যার নেতৃত্বে সম্ভাবনার নতুন সূর্যের দেখা পাওয়া, যার হাতের ছোঁয়ায় ক্রিকেটের সাদা-কালো এই দেশটার লাল-রঙিন আভা গায়ে মাখা; সেদিন ছিলো তার শেষ বেলা। নেতৃত্বের সূর্য অস্তমিত হবার বিষাদমাখা ক্ষণ, দেশকে লাল-রঙিনের পথ দেখিয়ে নিজেকে সাদা-কালোর স্রোতে হারানো ব্যথাতুর বিদায় বেলা... অসংখ্য ক্যামেরার চোখ সেদিন ভিন্নভাবে খুঁজে নিচ্ছিল তাকে, সতীর্থদের অসংখ্য সুখ-স্মৃতি ঝরছিল যেন অশ্রুফোটা হয়ে। ভক্ত-সমর্থক কিংবা শুভাকাঙ্ক্ষী সবে বেদনাবিধুর হয়ে তাকিয়ে ছিল তারই পানে, অপেক্ষায় ছিল প্রিয় মাশরাফী আজ কী বলে...

‘আমার দুজন ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং সব সময় দেখতে ভালো লাগে। একটা হচ্ছে বিরাট কোহলি, অপরটা হচ্ছে লিটন’ —শেষবারের মতো অধিনায়কের সুরে অসংখ্য কথার ভিড়ে এই মন্তব্যটাই যেন সব নজর নিল কেড়ে!

শুধুই কি মাশরাফী, ব্যাট হাতে একজন লিটন দাসে মুগ্ধ না হয়ে কে থাকতে পারে? ২২ গজের ক্যানভাসে ব্যাট নামক তুলি হাতে, ছয় আউন্সের চর্মগোলকটার রং-কালিতে মন মাতানো, হৃদয় জুড়ানো, বিমুগ্ধ-বিস্মিত, বিমোহিত করা কারুকার্যে যে ছবি আঁকেন আপনমনে, স্বীয় বিস্ময়কর সৃষ্টিশীল হাতে। ক্যারাবীয় কিংবদন্তি ইয়ান বিশপের কণ্ঠে যার হলো ‘...ইজ ড্রয়িং মোনালিসা’। সত্যিই তো তাই। তার দিনে ব্যাটিংটা যে তার সাক্ষাৎ মোনালিসা, আর তিনি স্বয়ং যেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি!

সবুজের ক্যাম্পাসে উইলোর রং-তুলি হাতে কত নিখুঁত ছবি আঁকতে পারেন তা ক্ষণে ক্ষণে বেশ ভালোভাবেই জানান দিয়েছেন লিটন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে স্বপ্নের সিরিজ বা ভারতের বিপক্ষে নিজের প্রথম শতক তারই জ্বলন্ত সাক্ষী। সাক্ষী আমরাও, সাক্ষী আমাদের চোখ দুটিও। আমরা তো সৌন্দর্যের পূজারী, আমরা কি করে ভুলবো ওই সকল স্মৃতি?

কিন্তু আফসোস! আমাদের বারবার হতাশ হতে হয়। কারণ যার সম্পর্কে এত কথা বলা, তার সম্পর্কে যে তিনি নিজেই অজ্ঞাত। দারুণ সব ইনিংস খেলার পরও কিভাবে যেন আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন নিজের ওউপর থেকে স্বয়ং নিজেই! তাই তো মনে প্রশ্ন ভাসে, লিটন কি সত্যিই নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে জানে? বুঝে কি তার দৌড়ের সীমারেখা কত দূর? যদি বুঝতই তবে কি আর এমন করে বার বার আত্মহত্যা করে উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে আসে?

আফসোসটা আরো বেড়ে যায় যখন প্রায় ২৭ বছর বয়স নিয়ে অর্ধযুগ জাতীয় দলে খেলার পরও ‘তরুণ’ তকমাটা থেকে যায়। প্রশ্ন আসে তাই ‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়? অথচ বাবর আজম, লোকেশ রাহুলরা ইতোমধ্যেই জানান দিয়েছে, ওরা আসছে রাজার বেশে ক্রিকেট রাজ্যে রাজ করতে। বাবর তো আরো একধাপ এগিয়ে, আবির্ভাবেই পাকিস্তানকে শিরোপা এনে দিয়েছে আর এখন তো সময়ের সেরা কোহলির সাথেও টক্কর দিতে শুরু করেছে। আর আমাদের লিটন সম্ভাবনা কিংবা তরুণ প্রতিভা হয়েই ধারাবাহিকভাবে অধারাবাহিক হয়ে খেলেই চলেছে!

বাবর আজম যেখানে সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ৩৫ ম্যাচে ৪২ গড়ে ২৩৬২ রান সংগ্রহে নিয়েছে, লোকেশ রাহুল ৪০ ম্যাচে ৩৬ গড়ে ২৩২১ রান তুলেছে, সেখানে লিটন দাস ২৫ ম্যাচে ৩০ গড়ে রান তোলেছে ১২২৯। ওয়ানডে ক্রিকেটে ৩০ গড়ে ৪৭ ম্যাচে লিটনের রান যেখানে ১৩৩৫, সেখানে ৮৩ ম্যাচে ৫৬ গড়ে বাবর আজমের সংগ্রহ ৩৯৮৫! লোকেশ রাহুলও সেখানে ৩৮ ম্যাচে ৫৪ গড়ে রান তোলেছে ১৫০৯। তবে আরও করুণ অবস্থা টি-২০ ক্রিকেটে। যেখানে লোকেশ রাহুলের গড় ৩৯, বাবর আজমের ৪৬, সেখানে লিটনের কুঁড়িও ছোঁয়নি, মোটে ১৯! যদিও ম্যাচ খেলে ফেলেছেন প্রায় ৪০টি, তবুও রান মোটে ৭১১।

প্রতিভা আছে, সম্ভাবনাও আছে, আছে যোগ্যতাও। তাই বলে পারফর্ম না করে ম্যাচের পর ম্যাচ খেলাটা কাকতালীয় মনেই হতে পারে। কিন্তু তা নয়, কারণ ‘বিকল্প হবার আছেই বা কে’- এই প্রশ্নটাই সব জবাব যেন দিয়ে দেয়। ৬০* (৪৫), ৪ (৫), ৬( ৫), ০ (১), -, ১ (৩), ৩৩ (২৯), ১৫ (১১), ৬ (১১), ১০ (১২)- যার শেষ ১০ টি-২০ ইনিংস, সর্বোচ্চ ইনিংসটাও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। অথচ ওই মানুষটাই বিশ্বকাপে যাচ্ছে দলের সেরা ওপেনার হয়ে! কিন্তু কী আর করা, বাঘহীন বনে বিড়ালই রাজা।

শুরুর দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর এখন জিম্বাবুয়ে, এর মাঝে ভারতের বিপক্ষে ওই একটা ইনিংস বাদে সাদা বলে আর কার সাথে কবে লিটন মুগ্ধতা উপহার দিয়েছে! ক্যারিয়ারের অর্ধেকের বেশি রানই তার জিম্বাবুয়ে আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১২ ম্যাচে ৫২ গড়ে ৫৭৭, ক্যারাবীয়দের বিপক্ষে ৭ ম্যাচে ৩৪ গড়ে ২০২, আর বাকি প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ২৮ ম্যাচে ২০ গড়ে মাত্র ৫৫৬! তার মাঝে ভারতের বিপক্ষের শতকটা বিদ্যমান, অন্যথায়...

আমি লিটন দাসের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না, কারণ আপনার মতো আমিও জানি তার দিনে সে কী আর কতটা ভয়ংকর। কিন্তু ওই দিন কবে আসবে, বা আদৌ আসবে তো... এই প্রশ্নটাও মাঝে মাঝে মবে উঁকি খায়। গতকাল ব্যাটিং কোচ যা বললেন, কিংবা মাশরাফী সেদিন যা বলেছিলেন, নিঃসন্দেহে লিটনের যোগ্যতা দেখেই মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবতাও মানতে হবে, সক্ষমতাও থাকলেও যে সফল হচ্ছেন না লিটন। বয়স বিবেচনায় লিটন দাস হয়তো আর সর্বোচ্চ ক্রিকেট খেলতে পারবেন ৯/১০ বছর (৩৬/৩৭ বছর বয়স)। কিন্তু ইতিহাসের সেরাদের একজন হতে এই সময়টা কি তার জন্য যথেষ্ট হবে? ইতমধ্যে ৬ বছর ওয়ানডে খেলে সংগ্রহ করেছেন মোটে ১৩০০ রান, উন্নতিহীন বাকি ১০ বছরে, তবে...

আমি বলছি না বয়স বাধা, বলছি না অসম্ভব। বয়স কখনো বাধা নয়, আর ক্রিকেটে অসম্ভব বলেও কিছু নেই। কিন্তু তার নিজেকে তো বিশ্বাস করতে হবে যে সে পারবে। ‘আমি পারব’ এই বিশ্বাসটা আদৌ তার আছে কি? নাকি দুধের শিশু হয়েই বুড়ো হবার ইচ্ছে, তরুণ তকমা, বা সম্ভাবনাময়-প্রতিভাবান হয়েই কাটিয়ে দেবার ইচ্ছে? সফল হতে হলে নিজের ভেতর জেদ থাকতে হবে, নিজের লক্ষ্য স্থির করতে হবে, উদ্দেশ্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে, বিশ্বাস থাকতে হবে নিজের উপর। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই বিশ্বাস আর দায়িত্বশীলতার অভাবই তার মাঝে ফোটে উঠেছে।

এই যে বারবার ব্যর্থ হন, এতো সমালোচনা হয়, এত কথা উঠে তাকে ঘিরে, কিন্তু কই কখনো কোনো দিনও তো দেখলাম না নিজ উদ্যোগে অনুশীলন করছেন, নিজেকে ফিরে পাবার চেষ্টা করছেন! তামিম, মুশফিকের মতো পরীক্ষিতরাও ব্যর্থ হলে যখন অনুশীলনে ঘাম ঝরান, অধিক অনুশীলন অপছন্দ করা সাকিবও যখন সময় বুঝে অতিরিক্ত অনুশীলনে মন দেন, কিংবা হালের তাসকিন, সাব্বিররাও একটা সময় ব্যক্তিগত অনুশীলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন, সেখানে লিটন যেন একটু বেশিই কুঁড়ে!

প্রিয় লিটন, আপনি কবে, কখন আর কিভাবে বুঝবেন আপনার সামর্থ্যের সীমানা আরো দূর বহুদূর, আপনি কি আদৌ জানেন আপনার উইকেটটার মূল্য কত? আপনি কি জানেন আপনার উপর কতটা অগাধ বিশ্বাস আশা আর ভরসা আমাদের? নিজেকে বুঝুন প্রিয় লিটন, নিজেকে চিনুন। আপনার একটু দায়িত্বশীলতা কোটি মানুষের মুখে হাসি ফোটাবে।।একটা সময় প্রায় সবাই বলত, আমাদেরও একটা বিরাট কোহলি আছে, যার নাম লিটন দাস। না, আমরা আপনাকে বিরাট কোহলি হতে বলি না, আমরা চাই আপনি লিটন দাসই থাকুন। এমন লিটন দাস, যেন আপনাকে দেখে আপনার মতো কেউ হতে চায়। কোনো মা যেন তার ছেলে এই বলেন ‘তুই বড় হয়ে লিটন দাসের মতো ব্যাটসম্যান হবি'! আমরা চাই না আপনি আরেকজন আশরাফুল হয়ে আশা দেখিয়ে ঝরে পড়ুন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us