কাতার যেভাবে তালেবান কানেকশনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো

অন্য এক দিগন্ত ডেস্ক | Sep 22, 2021 01:32 pm
কাতারে তালেবান নেতাদের উপস্থিতি

কাতারে তালেবান নেতাদের উপস্থিতি - ছবি সংগৃহীত

 

খবরের শিরোনামে কাবুলের নাম থাকতে পারে, কিন্তু খবরের উৎস হিসেবে চুম্বক হয়ে ওঠেছে দোহা। জাপান থেকে ভারত পর্যন্ত প্রভাবশালী সব দেশ, ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রায় সবাই তালেবানের সাথে সংলাপ আয়োজন করতে এই আমিরাতের কাছে ছুটে আসছে।

এই প্রমত্ত কূটনৈতিক কারযকলাপের সর্বশেষ উদাহরণ হলো যুক্তরাজ্যের তার পররাষ্ট্রসচিব ডমিনিক র‌াবকে কাতারের আমির ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আলোচনার জন্য পাঠানো। আফগান পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য রাব এই মুহূর্তে আঞ্চলিক সফরে রয়েছেন।

কাতারিদের সাথে আলোচনার সময় র‌াবের অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল যুক্তরাজ্যের নাগরিক এবং ঝুঁকিপূর্ণ আফগানদের আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেয়া। তিনি আফগান শরণার্থীদের প্রতিবেশী দেশগুলোকে পুনর্বাসন করা নিয়ে আলোচনা করার পরিকল্পনা করেছেন যাতে তারা ইউকে ও ইউরোপের দিকে না যায়।

রাবের সফরের আগেই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর আফগান ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার বিশেষ প্রতিনিধি সাইমন গ্যাস দোহাতে যান। আলোচনার বিষয়সূচি হলো গত ২০ বছরে যুক্তরাজ্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কর্মরত আফগানদের নিরাপদে দেশত্যাগের সুযোগ করে দেয়া। এই বৈঠক তালেবান ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য কূটনৈতিক বৈঠক বলে মনে করা হচ্ছে।

যুক্তরাজ্য স্থানান্তরিত করা জন্য পরিবারসহ অন্তত ১৫০-২৫০ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে। ওইসব আফগানদের জন্য নিরাপদ দেশত্যাগ ছাড়া তালেবানের সাথে আলোচ্যসূচিতে আর কী কী আছে তা প্রকাশ করেনি ইউকে।

মাত্র এক দিন আগে ওলন্দাজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (এইচকেআইএ) কাবুলে কার্যক্রম পরিচালনা এবং বিদেশী নাগরিকসহ কয়েকজন আফগানি নাগরিককে সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে আলোচনা করতে দোহায় অবতরণ করে।

নেদারল্যান্ডসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগ্রিড কাগ কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মেদ বিন আব্দুলরহমান আল-থানির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। সাথে সাথে নেদারল্যান্ডস তার আফগান দূতাবাস দোহায় স্থানান্তর করেছে।

এদিকে জাপানি সংবাদ সংস্থা কিয়োদো নিউজ জানিয়েছে, বুধবার জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দোহায় একটি অস্থায়ী কার্যালয় খোলার ঘোষণা দিয়েছে। জুলাই ও আগস্টে তালেবানের ঝটিকা আক্রমণের পর দেশটি তার কাবুল দূতাবাস বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর এই ঘটনা ঘটল। দোহা নতুন কার্যালয়ের নেতৃত্ব দেবেন জাপানে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত তাকাশি ওকাদা।

মুসলিম বিশ্বের নিজেকে পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যস্ত তুরস্ক, যারা আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীরও অংশ ছিল, বর্তমানে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারের জন্য কাতারের সাথে লড়াইয়ে ব্যস্ত। কাবুল বিমানবন্দর চালু করতে দুই দেশ অবশ্য একসাথে কাজ করছে।

তালেবানের সাথে আরো কার্যকরভাবে সম্পর্ক গঠনের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কাতারে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত মুস্তাফা গোকসু দোহায় তালেবান প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমেরিকানদের সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে তুরস্ক প্রকাশ্যে আফগানিস্তানে আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দাবি করছে।

আফগানিস্তানের ঘটনাবলী নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণরত ভারতও এই সপ্তাহে তালেবানের সাথে সাক্ষাৎ করেছে। যে বিষয় নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন সেগুলো নিয়ে আলোচনা করতে ভারতের রাষ্ট্রদূত দীপক মিত্তাল দোহায় তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধান শের মোহাম্মাদ আব্বাস স্তানেকজাইয়ের সাথে দেখা করেছেন। এ সব বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আফগানিস্তানের মাটি থেকে যে সমস্ত সন্ত্রাসী তৎপরতা ভারতে ছড়িয়ে পড়তে পারে সেগুলো বন্ধ করা। নয়াদিল্লি আশঙ্কা করছে, আফগানিস্তানের অনেক উগ্রবাদী সংগঠন, যেগুলোর অস্তিত্ব পাকিস্তানি সমর্থনের উপর নির্ভর করে, ভারতের বিরুদ্ধে পরিচালিত হতে পারে।

আফগানিস্তানে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার পাশাপাশি কাবুল বিমানবন্দরের কার্যক্রম চালু করার মত অন্যান্য ভারতীয় উদ্বেগ নিয়ে কথা বলেন মিত্তাল। দোহায় রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় শীর্ষ তালেবান প্রতিনিধি স্তানেকজাই অতীতে শীর্ষ ভারতীয় সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বিভিন্ন তালেবান নেতা ও যুদ্ধবাজ নেতা নয়াদিল্লিকে আশ্বস্ত করেছেন, তালেবান ভারতের সাথে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।

আফগান পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনায় মঞ্চ হিসেবে আরো একবার দোহাকে ব্যবহার করে দু’পক্ষ।

প্রায় পক্ষকাল আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মেদ বিন আব্দুলরহমান আল-থানির সাথে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে কাতারের রাজধানী সফর করেন। ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে দ্রুত এবং ব্যাপক রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণেই জয়শঙ্কর দোহার জন্য ঘন ঘন যাতায়াত করছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

ভাগ্যের পরিহাসেই বলতে হবে, যদিও অনেক দেশই তালেবানের সাথে আলাপ করার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু কেউই তালেবানকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। তবে আফগানিস্তানের দ্রুত বিকাশমান পরিস্থিতিতে যা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান তা হলো, আফগান-সমস্যা সমাধানের জন্য সবাই দোহার দিকেই ধাবমান।

দক্ষিণ এশিয়া, পারস্য উপসাগর এবং মধ্য এশিয়ার মিলনস্থল, যেখানে আফগানিস্তান অবস্থিত, সেই সমগ্র অঞ্চলে ভূ-কৌশলগত রাজনীতিতে একমাত্র ক্রীড়ানক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে কাতার। দেশটি তালেবানকে দেখবার এবং কথা বলবার জন্য বিশ্বের কাছে একটি গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে।

বিভিন্ন যুদ্ধবাজ নেতা এবং উগ্রবাদীদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকার কারণে ইসলামাবাদ স্থানীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করলে আসলেও, এই মুহুর্তে বিশ্বব্যাপী আফগান-বিষয়ক কেন্দ্রভুমিতে পরিণত হয়েছে কাতার। আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামাবাদ শুধু অল্প কিছু ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং তালেবানের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু আফগানিস্তানে দেশ নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থ থাকার কারণে সম্ভবত এ ব্যাপারে তাকে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য হিসেবে দেখা হয় না।

২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে আমেরিকা দোহায় তালেবানের সাথে বহুল সমালোচিত শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই দিনটি থেকে তেল সমৃদ্ধ আমিরাতটি আফগানিস্তানে শান্তি সৃষ্টিকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রচারের আলোয় এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে দোহা দুই চিরবৈরী যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানদের মধ্যে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করে আসছে। দেশটি তালেবানকে রাজধানীর এক বিলাসবহুল এলাকায় কার্যালয় খোলার অনুমতিও দেয়।

এই অঞ্চলে তার নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে তালেবানের সাথে আলোচনার জন্য কাতারকে বেছে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।, বিভিন্ন উপদল এবং অসংখ্য নেতায় বিভক্ত তালেবানও কাতারকে উপযুক্ত মিত্র হিসেবে পেয়েছে। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের সব বিরোধী শক্তির এই একত্রিত করার কারণে নিরপেক্ষ ভূমিতে পরিণত হয়েছে কাতার । সম্ভবত তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, দেশটি বিশ্ব ও বহু নেতৃত্ব সম্পন্ন অনানুমেয় তালেবানের মধ্যে বিশ্বস্ত অংশীদার ও নির্ভরযোগ্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পেরেছে।

কাতারের মাটিতে বহু বছর ধরে মার্কিনিরা এবং তালেবান নেতারা বৈঠক করে আসছেন, যা তালেবানের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে কাতারকে আরো বিশ্বাসযোগ্যতা দান করেছে। আফগানিস্তানে শান্তি আলোচনা আয়োজক হিসেবে দীর্ঘ, ধৈর্যশীল অপেক্ষার পর ধনী উপসাগরীয় আমিরাত কাতার এক সময়ের শক্তিশালী সভ্যতা এবং বর্তমানে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভরা পৃথিবীর এই কোণে নিজস্ব বৈদেশিক নীতির সাথে সাথে নিজের জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে ।

বিদেশী পত্রিকা অবলম্বনে


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us