কেন নোবেল পেলেন আব্দুলরাজাক

অন্য এক দিগন্ত ডেস্ক | Oct 11, 2021 05:17 pm
নোবেলজয়ী আব্দুলরাজ্জার গুরনাহ

নোবেলজয়ী আব্দুলরাজ্জার গুরনাহ - ছবি সংগৃহীত

 

উদ্বাস্তু-শরণার্থীর ভেতর অস্থিরতা থাকে, কোনো দিন তা যায় না। নিজের জীবনে যতই স্থির হোক না কেন সে, তবুও। নিজ-ভূমি হারানোর জ্বালা এবং পরের ভূমিকে আপন করতে না পারার ছটফটানি। বার বার তার দিকে আঙুল তুলে দেয়া– তুমি বহিরাগত, তাই খিড়কি খোলা। গেট আউট, দিস ইজ আওয়ার ল্যান্ড।… কিন্তু পালাবার পথ নেই। ও দিকে বিশাল খাদ, সশস্ত্র কাঁটাতার। আমাদের এই বাংলা, এই ভারত, এই উপমহাদেশ– শরণার্থী-মহাসমস্যা সেই কবে থেকে, এ যেন অজানা এক পথ, কে জানে কোথায় হবে শেষ…। তার বড় বড় ঢেউ মাঝে মাঝেই– ওঠে, নামে। আবার ওঠে। কখনো তা বৃহত্তর, রোহিঙ্গাদের রক্তগঙ্গা। তাদের লংমার্চের রঙিন ফটোগ্রাফিতে সয়লাপ, সঙ্কট-আলেখ্য। কখনো আবার আসামে এনআরসি, উচ্ছেদ, একটা দুটি লাশ পড়ে, চোখের পানিতে রাষ্ট্রশক্তির তেজ কমে না। ভোটে উদ্বাস্তু-শরণার্থীরা এ দেশে চাঁদমারি। নাগরিকত্ব আইনের ‘উৎসর্গপত্রে’ তো তাদেরই নাম। তাদের জীবনের আগুন থেকেই ভোটের দুনিয়ায় দিওয়ালি, তার পর ভোটে জেতাহারা শেষ হলে, রাজনীতির পাখিরা ঘরে ফেরে– শরণার্থী শিবিরে করোনা ছড়ায়। বাংলায়, ৩৪ বছর বামেরা ছিল, শরণার্থীরা তাদের ক্ষমতায় পৌঁছানোর পথে ছিল বড় সহায়। কিন্তু ঝাঁপি উলটে সেই লাল সরকারেরই সাদা পাঞ্জাবি রক্তে ভরাল মরিচঝাঁপি। বাংলার একজন পরিচালক সারা জীবন শরণার্থী সঙ্কট নিয়ে ফিল্ম বানালেন। পূর্ববঙ্গের রাজশাহির মিয়াঁপাড়ায় জন্ম, ঋত্বিককুমার ঘটক। রাজনীতির লোকজন নিজস্বার্থে ভূখণ্ড ভাগ করেন, সেই ভাগের দাগে লক্ষ-কোটি পরিবারের জীবন ম্যাজিকে পালটে যায়, তারই ঋত্বিক ছিলেন পরিচালক ঘটক। বহিরাগতের মর্ম-কথায় দপদপানো বঙ্গভূমিতে তাই কথাসাহিত্যে নোবেলজয়ী আব্দুলরাজ্জাকক গুরনার গুরত্ব কাঁটাতারে কাঁটাবিদ্ধ হয় না। তিনি উপন্যাসের উপাখ্যানে শরণার্থী মনের শহর-মফস্সল-গঞ্জের যে-কথা বলে চলেন, যা আমাদেরও কথা।

গুরনাহর বয়স ৭২। আফ্রিকার জাঞ্জিবারে জন্ম। এখন ব্রিটেনে থাকেন। তিনিই পঞ্চম আফ্রিকান লেখক যিনি সাহিত্যে এই পুরস্কারটি পেলেন। নোবেল পুরস্কারে কৃষ্ণাঙ্গ ও মহিলার সংখ্যাভাব কেন এত, বিতর্ক নতুন করে দানা বেঁধেছে, তার মধ্যেই এই গুরনাহের এই প্রাপ্তি। এখানে বলে নিই, দক্ষিণ আফ্রিকার জন এম কোয়েটজি ২০০৩ সালে এবং সেখানকারই নাদিন গর্ডিমার ১৯৯১ সালে সাহিত্যে নোবেল পান। তার আগে, মিসরীয় লেখক নজিব মাহফোজ ১৯৮৮ সালে এবং নাইজিরীয় ওলে সোয়িঙ্কা ১৯৮৬ সালে নোবেল পান। কিন্তু চারজনের মধ্যে একমাত্র ওলে সোয়িঙ্কা ছাড়া কেউই কৃষ্ণাঙ্গ নন। সোয়িঙ্কাই সাব-সাহারান (সাহারা মরুভূমির দক্ষণের ভূখণ্ড) আফ্রিকার প্রথম সাহিত্যে নোবেলজয়ী। কোয়েটজি ডাচ বংশোদ্ভুত এবং তার পূর্বজরা আফ্রিকায় আসেন সপ্তদশ শতাব্দীতে, সম্ভবত শরণার্থী হিসেবে। গর্ডিমাররাও শরণার্থী, রাশিয়া থেকে যাওয়া। আফ্রিকান হিসেবে সাহিত্যে প্রথম মহিলা নোবেলজয়ীও এই গর্ডিমার।

গুরনাহর কাজ

দশটি উপন্যাস। রয়েছে অনেক ছোট গল্প এবং প্রবন্ধ। ডিপার্চার (১৯৮৭), পিলগ্রিমস ওয়ে (১৯৮৮), প্যারাডাইস (১৯৯৪), বাই দ্য সি (২০০১), ডিসার্শন (২০০৫), গ্র্যাভেল হার্ট (২০১৭), এবং সাম্প্রতিকতম উপন্যাস আফটার লাইভস উল্লেখ করা যেতে পারে। শরণার্থীদের অস্তিত্ব এবং সংস্কৃতি হারানোর টানাপোড়েন রয়েছে তাঁর লেখা জুড়ে। বেশির ভাগ উপন্যাসে মূল চরিত্র হয়ে উঠেছে কোনও আফ্রিকান আরব, যে চরিত্র মূলচ্যুত হয়ে নতুন এলাকায় এসে নতুন সংস্কৃতিকে কিভাবে দেখছে, খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে চলেছে নব-অবস্থানে, তারই বয়ান। তার উপন্যাস প্যারাডাইস, যা বুকার পুরস্কারের জন্য শর্ট লিস্টেড হয়েছিল, উপন্যাসটি সম্পর্কে একটু বলি। মূল চরিত্র একটি বাচ্চা ছেলে, নাম ইউসুফ, জন্ম তানজানিয়ার মফস্সলি শহর কাওয়ায়, বিশ শতকের শুরুতে। ইউসুফের বাবা, ঋণে জর্জিত, বাধ্য হয় আজিজ নামে এক আরব ব্যবসায়ীর কাছে বিনা বেতনে কাজ করতে। আজিজের ক্যারাভানে ইউসুফ মধ্য আফ্রিকা, কঙ্গো অববাহিকায় ঘুরতে থাকে। নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয় সে। পূর্ব আফ্রিকায় ক্যারাভ্যান ফিরে যখন এল, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিসমিল্লাহ। জার্মান সেনার তানজানিয়ায় দাপটও চলছে। জার্মানরা অফ্রিকান পুরুষদের জোর করে তাদের বাহিনীতে ঢোকাচ্ছে। আজিজের ক্যারাভ্যান জার্মান সেনার কোপে পড়ে গেল সে সময়।… এক আশ্চর্য স্মৃতি-চেরা মায়াবি ভাষায় লিখে যান গুরনাহ।

প্রেক্ষাপট

১৯৪৮ সালের ২০ ডিসেম্বর জাঞ্জিবারে জন্ম গুরনাহের। জাঞ্জিবার এখন তানজানিয়ার অংশ, যদিও এটি স্বায়াত্তশাসিত। তখন ব্রিটিশের শাসনে ছিল এই ভূখণ্ড। জার্মানির সাথে এলাকা ভাগাভাগিতে এই অংশটি পেয়েছিল ব্রিটিশরা। ১৮৯০ সালে হেলিগোল্যান্ড-জাঞ্জিবার চুক্তির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। যে চুক্তির ফলে ভাগাভাগিতে সিলমোহর পড়ে। জাঞ্জিবার নয়– তখন বলা হত জাঞ্জিবার সলতানত। কারণ, ১৬৯৮ সালে জাঞ্জিবার ওমানের শাসন জারি হয়। ওমানের ইমাম সাইফ বিন সুলতান মোম্বাসায় পোর্তুগিজদের হারিয়ে এটির দখল নেন। কিন্তু কালের স্রোতে ব্রিটিশের বজ্রগর্জন। তাদের হাতে সুলতানি শাসন নড়বড়ে হয়ে যায়। ১৮৯৬ সালের অগস্টে হামাদ বিন থুওয়ানির মৃত্যুর পর, খালিদ বিন বারঘাশ জাঞ্জিবারের ক্ষমতা দখল করেন, স্টোন টাউনে প্রসাদ দখল করে রাখেন। ব্রিটিশরা ৩৮ মিনিটের যুদ্ধে বারঘাশকে পরাজিত করে, গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট যুদ্ধ। ব্রিটিশরা হামুদ বিন মোহম্মদকে সিংহাসনে বসায় এর পর, যদিও হামুদ কুরসির অন্যতম দাবিদারও ছিলেন, তিনি ব্রিটিশ পুতুল হন। ব্রিটিশের প্রত্যক্ষ প্রভাবে এই হামুদই জাঞ্জিবারে ক্রীতদাসত্ব নিষিদ্ধ করেছিলেন, সে জন্য ইতিহাস তাকে সম্মান করে। এখানে একটা কথা বলতে হবে যে ক্রীতদাসের বাজারের জন্য জাঞ্জিবার এক সময় প্রসিদ্ধ ছিল, পৃথিবীর সর্বশেষ খোলা কৃতদাসের বাজার ছিল এখানেই। ১৮৭৩ সালে যা ব্রিটিশরা বন্ধ করে দিয়েছিল। ১৯৬৩-র ডিসেম্বরে ব্রিটিশরা এই এলাকা হাত তুলে নেয়। ফের সুলতানের পুরো নিয়ন্ত্রণে যায় জাঞ্জিবার। কিন্তু ভূমিপুত্র আফ্রিকানরা আরব সরকারের বিরুদ্ধে গর্জন করে ওঠেন। তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৯৬৪ সালে সেই বিদ্রোহে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয় সুলতান জামসিদ বিন আবদুল্লাহকে। এবং আবররা সে দেশে সংখ্যালঘু, সংখ্যালঘুর উপর নেমে আসে ভয়ঙ্কর অত্যাচার। জাঞ্জিবার ক্রমে তানজানিয়াভুক্ত হয়, কিন্তু ২০ হাজার সংখ্যলঘু নিহত হলেন সেখানে। এই অবস্থায় ১৯৬৮ সালে গুরনাহ স্বদেশ ছেড়ে হাজির হন ব্রিটেনে। তখন তার বয়স ১৮। বোঝাই যাচ্ছে, একটু সুরক্ষার খোঁজেই তাদের ব্রিটেনে আসা। পড়াশুনা, অধ্যাপনা, নোবেলপ্রাপ্তি, ঈর্ষণীয় কেরিয়ার। যদিও ১৯৮৪ পর্যন্ত তিনি দেশে ফিরতে পারেননি। পিতার মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে তার সাথে ছেলে রাজাক দেখা করতে পারেন।

রাজ্জাকের মাতৃভাষা সোয়াহিলি। যে ভাষায় তানজানিয়াসহ পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার বহুজনের মাদার টাং। রাজাক ২১ বছর বয়সে লিখতে শুরু করেন ইংরাজিতে। ইংরাজির প্রফেসরও হলেন। ইউনিভার্সিটি অফ কেন্ট থেকে তিনি পিএইচডি পেয়েছেন। নোবেল ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে, তার শিক্ষাসময়ের কাজেও রয়েছে উপনিবেশ-পরবর্তী, অভিবাসীদের নিয়ে অনেক কিছু। সালমান রুশদি, সোয়িঙ্কাদের সারিতেই তাকে ফেলা যায়। জাঞ্জিবার, এক কসমোপলিটন শহর– আরবি, হিন্দি, জার্মান ভাষার নানা প্রকাশভঙ্গি তাই সহজেই ঢুকে পড়েছে রাজ্জাকের লেখায়।

অনুপ্রেরণা

তার ২০০৪ সালের একটি প্রবন্ধ, রাইটিং অ্যান্ড প্লেস-এ গুরনাহ লিখেছেন, ‘… যখন আমি বাড়ি ছেড়েছিলাম, আমার লক্ষ্য ছিল সহজ-সরল। সেটা কঠিন লড়াইয়ের সময়। রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে মাথা গোঁজার লক্ষ্য ছিল। বড় হওয়ার সাথে সাথে ইংল্যান্ডে লেখালিখি করার কথা ভাবতে লাগলাম। সেই লেখা হবে অন্য রকম।… সময়ের সাথে সাথে আমি আমার কাজে অবাক হয়ে থেমে গেলাম। তার পর বুঝতে পারলাম আমি নিজের স্মৃতি থেকে লিখছি। কী উজ্জ্বল সেই স্মৃতি। ইংল্যান্ড-বাসের প্রথম বছরগুলোতে যে হালকা-ফুলকা অস্তিত্ব ছিল আমার, তার থেকে যেন বহু দূরে চলছিল লেখালিখি।… বিগত জীবনটা নিয়ে আমি লিখব ঠিক করে ফেলি, হারানো জায়গা, যা আমার স্মৃতিতে আছে, তাই আমার লেখায় এসেছে।’

সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us