বাঙালি সংস্কৃতি মানেই বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি

জি. মোস্তফা | Oct 25, 2021 08:10 pm
বাঙালি সংস্কৃতি মানেই বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি

বাঙালি সংস্কৃতি মানেই বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি - ছবি সংগৃহীত

 

প্রকৃত পক্ষে মুসলমানরাই প্রকৃত বাঙালি। তারাই প্রকৃত আদিবাসী। তারাই এই ভূমিতে প্রাচীনকালে আবাদ করেছে। তারাই এর রক্ষণাবেক্ষণকারী। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এসব সকলই মুসলমানদের দান। স্বাধীন বাংলা ও বাংলাদেশ মুসলমানদের রক্তের বিনিময়েই এসেছে।

এক. বাঙালি মুসলমানের শিকড় ও নূহের প্রপৌত্র বঙ্গ
বাঙালি হলো হযরত নূহ আ.-এর বংশধর। এ পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্ভুল জ্ঞান হলো অহি। মহাজ্ঞানী হতে হলে তাকে অবশ্যই অহির শরণাপন্ন হতে হবে।মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা বলে খ্যাত নূহ আ. ছিলেন পিতা আদম আ.-এর দশম অথবা অষ্টম অধঃস্তন পুরুষ। তিনি ছিলেন দুনিয়াতে প্রথম রাসূল।

হযরত নূহ আ.-এর প্রপৌত্রের মাধ্যমেই বাঙালি জাতির উদ্ভব হয়েছে । বাংলাদেশের ইতিহাস রচনার পথিকৃৎ গোলাম হোসায়ন সলীম জইদপুরী। তিনি বাংলার ইতিহাস নিয়ে ১৭৬৬-১৭৮৮ সালে রচনা করেন ফারসি গ্রন্থ 'রিয়াজ উস সালাতিন'। এ পুস্তকে তিনি হযরত নূহ আ.-এর সাথে বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা সম্পর্কের বিষয় উত্থাপন করেছেন। (সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান : বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), আগামী প্রকাশনী, ৩৬, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, প্রথম বর্ধিত সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ ২৮)। তিনি লিখেছেন, হযরত নুহ আ. এর পুত্র হামের জ্যেষ্ঠ সন্তান হিন্দ হিন্দুস্তানে আসার দরুণ এই অঞ্চলের নাম তাঁর নামানুসারে রাখা হয়। সিন্দ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সাথে এসে সিন্ধু দেশে বসতি স্থাপন করায় এই অঞ্চলের নাম তাঁরই নামানুসারে সিন্ধু রাখা হয়। হিন্দের দ্বিতীয় পুত্র বং (বঙ্গ)-এর সন্তানেরা বাংলায় উপনিবেশ স্থাপন করেন। আদিতে বাংলার নাম ছিল বঙ। (সূত্র : গোলাম হোসায়ন সলীম : বাংলার ইতিহাস (রিয়াজ-উস-সালাতীনের বঙ্গানুবাদ), আকবরউদ্দীন অনূদিত, অবসর প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃষ্ঠা ২৪)।

বিস্ময়কর এবং রহস্যজনক হলেও তথ্যটি বাস্তব এবং সত্য। কারণ নবি রসুলদের বংশধররাই দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বসতি স্থাপন করেন। অহির ধারক-বাহকরাই পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার আদিবাসী। বর্তমান পৃথিবীতে যত মানুষ আছে সবারই পূর্বসূরী নবি-রাসুলগণ। সে হিসেবে নূহ নবি ও তাঁর বংশধরদের সাথে বাংলাদেশের আদি ইতিহাস সংশ্লিষ্ট। এ বিষয়ে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. মোহাম্মদ হাননানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, বাঙালির ইতিহাস অতি প্রাচীন। আনুমানিক ১০ হাজার বছর পূর্ব থেকে বাঙালি জাতির যাত্রা শুরু হয়েছিলো। আরেকটি সূত্র মতে বাঙালি জাতি এসেছে নূহ আ. এর বংশ থেকেই। (সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান : বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), আগামী প্রকাশনী, ৩৬, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, প্রথম বর্ধিত সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ ৬৪৪, ৩১)। অন্যত্র তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাস নুহ আ.-এর সময় থেকেই শুরু এবং এ থেকেই অনুমান করা যায় এর ইতিহাসের প্রাচীনতার বিষয়টি। (সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান : বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), আগামী প্রকাশনী, ৩৬, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, প্রথম বর্ধিত সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ ৬৪৪, ৩০)।

পবিত্র বাইবেলে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, আপন আপন বংশ ও জাতি অনুসারে ইহার নূহের সন্তানদের গোষ্ঠী; এবং জলপ্লাবনের পরে ইহাদের হইতে উৎপন্ন নানা জাতি পৃথিবীতে বিভক্ত হইল। (সূত্র : পবিত্র বাইবেল: পুরাতন ও নতুন নিয়ম, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা ১৯৮১, পৃ ১২-১৩)।

এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ও গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান আরও লিখেছেন, হযরত আদম আ. থেকে আমাদের এই মানব জাতির শুরু। কিন্তু নুহের সময়ে সমগ্র পৃথিবীতে এক মহাপ্লাবন ঘটে। এই মহাপ্লাবনে দুনিয়ার সকল কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। কেউ জীবিত ছিল না। শুধু নুহের নৌকায় আরোহণ করেছিলেন ৮০ জন নুহের ভক্ত; এই ৮০ জন থেকেই মানব জাতির আবার নতুন যাত্রা।
এই নতুন যাত্রায় জাতিরও সম্পর্ক ছিল। বেঁচে যাওয়া ৮০ জনের মধ্যে ছিলেন নুহের এক পুত্র; নাম তাঁর ‘হাম’। নুহ তাঁর পুত্র হামকে বললেন, ‘তুমি মানব বসতি স্থাপনের জন্যে চলে যাও পৃথিবীর দক্ষিণ দিকে’। পিতার নির্দেশ পেয়ে হাম চলে এলেন আমাদের এশিয়া মহাদেশের কাছাকাছি। সেখানে এসে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র হিন্দকে পাঠালেন ভারতের দিকে। অনেকে মনে করেন, হামের পুত্র হিন্দের নাম অনুসারেই ভারতের নাম হয়েছে হিন্দুস্তান।

হিন্দের দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল ‘বঙ্গ’। এই ‘বঙ্গ’- এর সন্তানরাই বাঙালি বলে পরিচিতি লাভ করে। এই গল্প সত্যি হলে বলতে হবে বাঙালির আদি পুরুষ হচ্ছেন ‘বঙ্গ’। (সূত্র : ড. মোহাম্মদ হান্নান : দেশের নামটি বাংলাদেশ কে রেখেছে এই নাম, অনুপম প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ১৫-১৬)।

গোলাম হোসাইন সলীম জইদপুরীর বর্ণিত এই ইতিহাসকে আরো অনেক গবেষক সমর্থন করেছেন এবং নিজ নিজ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ড. কাজী দীন মুহম্মদ, মো. রফিকুল ইসলাম প্রমুখ। আরো অনেকেই এই মতকে সমর্থন করেছেন।

দুই. বাংলা নামের উৎপত্তি ও মুসলমান
(বঙ্গ+ আল) বঙ্গের সাথে আল যুক্ত হয়ে বঙ্গাল পরে বঙ্গালাহ ও তৎপরবর্তী বাঙ্গালা নামটি এসেছে। বঙ্গ হচ্ছেন হযরত নূহ আ. এর প্রপৌত্র আর আল শব্দের অর্থ বংশ ধর অর্থাৎ বঙ্গাল শব্দের অর্থ বঙ্গের বংশশর।(তথ্যসূত্র : ইসলাম ও মাতৃভাষা,মুফতি আব্দুস সাত্তার কিশোরগঞ্জী,পৃষ্ঠা- ১০৫) কিন্তু সে সময় বঙ্গ শব্দটি এই অঞ্চলের নাম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে।

"বঙ ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের যে স্থানে এসে বসতি স্থাপন করে সেই স্থানের নাম তাঁরই নামানুসারে হয় বঙ্গদেশ অথবা বঙের সন্তানরাই বঙ্গাল বা বাঙ্গাল অথবা পরবর্তীকালে বাঙ্গালী, আরও পরে বাঙালি বলে খ্যাতি লাভ করে। (সূত্র : ড. মোহাম্মদ হাননান : বাঙালির ইতিহাস (প্রাচীন যুগ থেকে ১৯৭৪), আগামী প্রকাশনী, ৩৬, বাংলাবাজার ঢাকা-১১০০, প্রথম বর্ধিত সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০১৪, পৃ ২৯)।
মুসলমান শাসকদের আমলে দেশের নাম নামটি বাঙ্গালাহ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে । সম্রাট আকবরের
আমলে সমগ্র বাংলা "সুবহে বাঙ্গালাহ" নামে পরিচিতি পায়। বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা (১৩০৪-৭৩)
প্রথমবারের মতো মধ্যযুগে বঙ্গাল নামটি উচ্চারণ করেন। ঐতিহাসিক আবুল ফজল তার আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে সর্বপ্রথম দেশবাচক বাংলা শব্দ ব্যবহার করেছেন।
(বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- মাহবুবুল আলম,পৃ. ২২)
অতএব সুনিশ্চিতভাবে বলা যায় বঙই হলেন বাঙালি জাতির আদিম পুরুষ, আদি গুরু ও আদি জনক। বঙ থেকেই বাঙালি জাতির পয়দা বা উৎপত্তি। বঙ্গোপসাগরের নামকরণও এই বঙ থেকে। বঙই বাংলা ও বাংলাদেশের গোড়াপত্তন ঘটান। তাই বঙই বাঙালি জাতির স্থপতি, প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ। বর্তমান বাঙালি ও বাংলাদেশিরা তাঁরই উত্তরসূরী।

তিন : অখন্ড বঙ্গ গঠন ও বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তি স্থাপন
ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি যখন বাংলায় আগমন করেন তখন প্রকৃত অর্থে বাংলা নামে কোনো সুসংহত রাষ্ট্র ছিল না। প্রাচীনকালে এ ভূখণ্ড ছিল বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত। এগুলো হচ্ছে রাঢ়, বরেন্দ্র, পুন্ড্র, গৌড়, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল ইত্যাদি।

এগুলোতে বিভিন্ন রাজন্যবর্গরা স্বায়ত্বশাসন চালাত।
সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ মলত মূলুকে বাঙ্গালা বা অখণ্ড বাংলা গঠন করেন। ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার ও ড. নীহার রঞ্জন রায়ের মতো ঐতিহাসিকরাও এ কথা মেনে নিয়েছেন।
( মিহওয়ার তৃতীয় সংখ্যা, মূল প্রবন্ধ : বখতিয়ার খিলজী যদি না আসতেন, ফাহমিদ-উর-রহমান, পৃ. ১০৮)
মুসলিম শাসনামলের আগে বাংলা নামের কোনো দেশ ছিলো। দেশের অধীবাসীদের জন্য বাঙালি পরিচয় কিংবা তাদের ভাষার নামকরণ বাংলা তখনো হয়নি।

মুসলিম শাসকরাই বাংলার সব অঞ্চলকে একটি রাজনৈতিক ঐক্যে সুসংহত করেন এবং এই নবগঠিত অঞ্চলের নাম বাংলা নাম ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা করেন।
(তথ্যসূত্র : বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ড. এম এ রহীম)

সুতরাং মুসলিমরাই বাঙালি জাতিসত্তার ভিত্তি নির্মাতা।

চার. মুসলমানদের বাঙালি পরিচয়
অতীতকাল থেকেই দেখা যায়, মুসলিমরা নামের সাথে বাঙাল বা বাঙালি শব্দ ব্যবহার করছে। উদাহরণস্বরূপ, লালবাগ কেল্লার পরিবিবির কবরের দক্ষিণ পাশে ফাঁকা জায়গায় একটি কবর আছে। নামফলকে লেখা মির্জা বাঙালির সমাধি। (সূত্র : মাসিক ইতিহাস আন্বেষা, ১৩বর্ষ, এপ্রিল ২০১৬, ফকিরাপুল ঢাকা, পৃ ২৬)।

বাংলাদেশে একজন বিখ্যাত মুসলিম মনীষী ছিলেন যার নাম তিতুমীর ও হাজী শরীয়ত উল্লাহদের সাথে উচ্চারণ করা হয়। তাঁর নাম ইমাম উদ্দীন বাঙ্গাল রহ.।(তথ্যসূত্র : মাসিক প্রেরণা, অক্টোবর-২০২০, পৃ. ৮৯) এই যে একজন মনীষীর নামের সাথেও বাঙ্গাল নামটি জুড়ে দেয়া ছিল। বাংলার স্বাধীন সুলতানদের মধ্যে সুলতান হোসেন শাহ ( রাজত্বকাল ১৪৯৩-১৫১৮) এবং তার পুত্র নসরত শাহ ( রাজত্বকাল ১৫১৮-৩২) খুবই খ্যাত হয়ে আছে। সম্রাট বাবর তার আত্মজীবনীতে নসরত শাহর খুব প্রশংসা করেছেন। তিনি নসরত শাহকে বলেছেন নসরত শাহ বাঙ্গালী।(বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার ও প্রসার, এবনে গোলাম সামাদ,মাসিক প্রেরণা,অক্টেবর-২০২০, পৃষ্ঠা- ২৯)।

মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই ধারণ করেছেন বাঙ্গাল ও বাঙ্গালী নামের উপাধি। যেমন 'ফখরে বাঙ্গাল','শের-এ-বাংলা' ইত্যাদি।
বর্তমানেও দেখা যায় অনেক মুসলিমই নামের আগে বা পরে বাঙাল বা বাঙালি শব্দ ব্যবহার করেন। কিন্তু কোনো হিন্দু বা অমুসলিমকে এসব পরিভাষা ব্যবহার করতে দেখা যায় না। এর কারণ নূহের প্রপৌত্র বঙ ছিলেন মুসলিম এবং আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী। তার স্মৃতির জন্য হোক বা দেশ-জাতি প্রেম হোক মুসলিমরা নামের সাথে শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন, করছেন। অন্যদিকে অমুসলিমরা সচেতনভাবেই এসব শব্দ এড়িয়ে চলেছে। বাংলাদেশি হিন্দুরা এখনো মুসলমানদের বাঙ্গাল বলে ডাকেন।

এমনকি স্বাধীন সুলতান মুবারক শাহ নিজেই শাহ-ই-বাঙ্গালা উপাধি ধারণ করেছিলেন। শুধু তাই নয় বাংলার মানুষের সঙ্গে তারা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। তারা এই দেশকে একেবারে হৃদয় থেকে আপন করে নিয়েছিলেন।

সালাহউদ্দীন আহমদ লিখেছেন- 'তের শতকের প্রথম দিক থেকে চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশ দিল্লী সালতানাতের অধীনে ছিল। চৌদ্দ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ আফগান (পাঠান) সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ্ বাংলার প্রায় সমস্ত অঞ্চল জয় করে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং বাংলাদেশে স্বাধীন সুলতানী যুগের সূচনা করেন। বাংলার স্বাধীন সুলতান “শাহ ই বাঙ্গালা” উপাধি ধারণ করেন। পরবর্তী প্রায় দুশ বছর বাংলাদেশে স্বাধীন পাঠান সুলতানরা রাজত্ব করেন। এই সব পাঠান সুলতানরা বহিরাগত হলেও এ দেশের মাটি ও মানুষের সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। হুসেন শাহী আমলে বাংলার ভাবজগতে এক অভূতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল।'(bdnews24. ২৮ মে, ২০১১)।

পাঁচ. বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পুনরুজ্জীবনে মুসলমান
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে রয়েছে মুসলমাদের অভূতপূর্ব অবদান। তারাই বাংলা ভাষার জন্মদাতা ও বাংলা সাহিত্যের স্থপতি। তুর্কি মুসলিম সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বঙ্গদেশে মুসলিম রাজত্ব কায়েমের ফলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নবজন্ম ঘটে। মুসলমান শাসক হুসেন শাহ, গৌড়ের সামসুদ্দিন ইউসুফ শাহ এবং অপরাপর মুসলিম সম্রাটরা বাংলা ভূখন্ডে বাংলা ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে আমাদের সাহিত্যে এক নতুন যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। এসব ইতিহাস সামনে রেখে দীনেশ চন্দ্র সেন মন্তব্য করেন, ''মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ-সাহিত্যের এইরূপ জন্মদাতা বললে অত্যুক্তি হয় না। বঙ্গ-সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গ-ভাষা বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা।''

হিন্দু শাসনাধীন বাংলায় বাংলা ভাষাকে ম্লেচ্ছ ভাষা,নীচ ভাষা, ইতরজনের ভাষা ইত্যাদি বলে উপহাস করা হতো।
বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা ছিল নিষিদ্ধ। মুসলমানরাই পরে এ ভাষার পুনরুজ্জীবনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। সর্বশেষ ১৯৫২ সালে মুসলমান যুবকরাই বাংলা ভাষার জন্য প্রাণোৎসর্গ করে। যার ফলে আমরা পেয়েছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। পাক আমলে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম দাবি তুলেছিলেন নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ।

ছয়. শিক্ষায় মুসলিম অবদান
বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তনে রবীন্দ্র পরিবারের কোনো ভূমিকা নেই। নবাব সলিমুল্লাহ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যিাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক ভূমিকা রাখেন। বুয়েটসহ অগণিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকায় প্রথম বিদ্যুতায়ন ও পানি সরবরাহরের কৃতিত্বও নবাব সলিমুল্লাহর।

সাত : বঙ্গীয় রাজনীতিতে মুসলমান
হাজী শরিয়তুল্লাহ, মাওলানা তিতুমীর, শেরে বাংলা,
সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাষানী, মাওলানা তর্কবাগীশ
প্রমুখ মুসলিম রাজনীতিবিদরা বাঙালির কল্যাণে রাজনীতিতে সর্বাত্মক ভূমিকা রাখেন। যুগে যুগে বাঙালি মুসলমানরা স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য সংগ্রাম করেছেন অথচ বাঙালি হিন্দুরা চেয়েছে অখণ্ড হিন্দুস্তান।

আট. স্থাপত্যশিল্পে মুসলমান
মুসলমানরাই বাংলাদেশে প্রথম স্বতন্ত্ররীতি সম্পন্ন স্থাপত্য নির্মাণ করে । মসজিদ নির্মিত হলে সরাসরি তা জনকল্যাণে সম্পৃক্ত ছিল। মুসাফির খানা, লঙ্গরখানা, পথিক ছাউনি, রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদিতে মুসলমানদের একচ্ছত্র ভূমিকা ছিল।

নয়. পোশাক শিল্পে ভূমিকা
মুসলমানদের আগে বাংলায় সেলাই করা কাপড়ের প্রচলন ছিল না। তারাই প্রথম সেলাই করা কাপড় পরিধান করে। এজন্য দর্জিদের বলা হয় খলিফা।

তাদের বিশেষ ভূমিকায় পাঞ্জাবি পাজামা টুপি
ইত্যাদির প্রচলন ঘটে। মোজা শব্দটি আরবি মোজাস থেকে এসেছে। এছাড়া বাংলায় মুসলমানরাই প্রথম আতর-সুগন্ধি ইত্যাদি ব্যবহার করে।
পরে রবীন্দ্রনাথ ও রাজা রামমোহন রায়সহ অনেক হিন্দুরা মুসলিম অনুকরণে পোশাক পরিধান করত।

দশ. উন্নতমানের খাবার প্রচলন
মুসলমানরাই এই ভূমিতে মোগলাই, কোর্মা, কাবাব, কালিয়া, কোপ্তা, রেজালা, বিরিয়ানি, পোলাও ইত্যাদি খাবারের প্রচলন করে। যা ইতোপূর্বে ছিলো না। তারাই প্রথম তরকারি ও মিষ্টি দ্রব্যে সুগন্ধি ও মশলার ব্যবহার শুরু করে। এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, কিসমিস, পিঁয়াজ, রসুন, আদা প্রভৃতির ব্যবহার মুসলমানদের রন্ধন প্রকৌশলের ফল।

এগারো. বাঙালি সংস্কৃতি ও মুসলমান
মুসলমানরাই মূলধারার বাঙালি। মুসলমানরাই বাঙালি সংস্কৃতির প্রবর্তক। বাঙালি সংস্কৃতি মানেই বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতি।
তারাই প্রথম বাংলা সন চালু করে। এর উদ্ভাবক ছিলেন আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজী। ১ বৈশাখ, হালখাতা, মিলাদ, উরুস, ঈদ উৎসব এসব কিছুই বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি। মুসলমানরাই এদেশে জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, মারফতি, কাওয়ালি প্রভৃতি গানের প্রচলন ঘটিয়েছে। সানাই, সেতার, তবলার ব্যবহার প্রচলন তারাই ঘটিয়েছে।

এই বাংলাভূমির সাথে বাঙালি মুসলমানের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং বাঙালি সংস্কৃতি মানেই হলো বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি। এর বাইরে যা রয়েছে তা হলো হিন্দু সংস্কৃতি, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিংবা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের সংস্কৃতি।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us