ডিজেলের দাম বৃদ্ধি এবং আমাদের অমসৃণ অর্থনীতি

ফ্লোরা সরকার | Nov 08, 2021 01:06 pm
ডিজেলের দাম বৃদ্ধি এবং আমাদের অমসৃণ অর্থনীতি

ডিজেলের দাম বৃদ্ধি এবং আমাদের অমসৃণ অর্থনীতি - ছবি সংগৃহীত

 

অধ‍্যাপক এবং অর্থনীতিবিদ আনু মোহাম্মদ ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় সম্প্রতি তার ফেসবুক স্ট‍্যাটাসে লিখেছেন, 'সাজানো নাটক ভালোভাবেই মঞ্চস্থ হলো। সব তো নিজেরা নিজেরাই। মেগা প্রকল্পে মেগা চুরির টাকা যোগানোর জন‍্যে সরকার যত জায়গায় সম্ভব কর, শুল্ক, ফি, দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে। এই ধারাতেই ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। বাস ট্রাক ভাড়া সেই ভাবে বাড়াতে যে হবেই এটা তো জানা কথা, তবে সরকার সেই দায় নেবে না।'

কথাটা উনি ঠিক বলেছেন। পুঁজিতান্ত্রিক অর্থব‍্যবস্থায় সরকারের দায় নেয়ার কথাও না। কারণ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে, অ‍্যাডাম স্মিথের ফরমুলা অনুযায়ী, বাজারে পণ‍্যের দাম 'অদৃশ‍্য হাত'-এর ইশারায় নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ এই ধরনের অর্থনৈতিক ব‍্যবস্থায় পণ‍্যের দামের ক্ষেত্রে কোনো সরকারি হস্তক্ষেপ থাকে না। জিনিসপত্রের দামের ওঠা-নামা বাজারের নিজস্ব নিয়মে হয়। এই নিজস্ব নিয়মকেই স্মিথ সাহেব অদৃশ‍্য হাত বলেছেন।

কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো, আমরা বাঙালি মনন বা চেতনা ধারণ করে ইউরোপীয় পোশাক পরে ঘুরে বেড়াই। পুঁজিবাদী অর্থনীতি বজায় রেখে মননে সমাজতান্ত্রিক চেতনা লালন করি। পুঁজিবাদী অর্থনীতির সমস‍্যার সমাধান খুঁজি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক চেতনার ভেতর। আমরা সবাই জানি, পুঁজিতান্ত্রিক অর্থব‍্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থব‍্যবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অর্থব‍্যবস্থা। খুব সহজ করে দেখলে বলতে হয়, পুঁজিতান্ত্রিক অর্থব‍্যবস্থায় বাজারের ক্ষেত্রে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করে না এবং উল্টা দিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থব‍্যবস্থায় বাজারের ক্ষেত্রে সরকার হস্তক্ষেপ করে। যে অর্থনৈতিক ব‍্যবস্থায় যে নিয়ম সেটা প্রয়োগ করলে, অর্থনীতি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়। কারণ অর্থনীতি কোনো নীতির ধার ধারে না। সে তার নিয়ম ধরে চলে।

এখন কথা হলো, নিয়ম আর নীতির মধ‍্যে গোলমাল লেগে গেলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও সেভাবে ঘটে। পুঁজিতান্ত্রিক নিয়ম ধরে চলে, সমাজতান্ত্রিক নীতি মাথায় রাখলে তো হবে না। পুঁজিতান্ত্রিক নিয়মে পুঁজির নীতিই খাটবে। কিন্তু আমাদের এখানে এক ধরনের নিয়ম রেখে অন‍্য নীতি প্রয়োগ করে চলেছি। ডিজেলের দাম বাড়া বা কমানোর কথা ডিজেলের বাজারে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে দাম বাড়িয়েছে সরকার। যেটা সরকারের এখতিয়ারের মধ‍্য পড়ে না। পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতিতে সরকারি হস্তক্ষেপ খুব প্রয়োজন ছাড়া করা হয় না।

এখন কথা হলো, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ কি খুব দরকার ছিল? অবশ্যই ছিল। কারণ মেগা চুরির, মেগা প্রকল্পের দেশে, দাম বাড়ানো ছাড়া বিকল্প রাস্তা খুব একটা থাকে না। আবার এই মূল‍্যবৃদ্ধির নিয়মও আমরা সঠিকভাবে মেনে চলি না। (যেকোনো অর্থনীতির সব থেকে দুর্বল চিত্র হলো তার মূল‍্যস্ফীতি) অর্থনীতিতে মূল‍্যবৃদ্ধিরও একটা নিয়ম আছে। যেকোনো সময়, যখন খুশি তখন মূল‍্যবৃদ্ধিকে অর্থনীতিতে কখনই মূল‍্যবৃদ্ধি বলে না। এই ধরনের 'যখন-তখন'-এর মূল‍্যবৃদ্ধি তখন স্বেচ্ছাচার বৃদ্ধি হয়ে যায়। অর্থনীতিতে মূল‍্যবৃদ্ধি তখনই বলা হয়, যখন দীর্ঘ সময়ের ব‍্যবধানে, সেটা দুই, পাঁচ বা দশ বছরের ব‍্যবধানে ঘটে থাকে। এই ধরনের সময়ের ব‍্যবধানে যখন পণ‍্যের দাম বাড়ে তখন তাকে মূল‍্যবৃদ্ধি বা মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের এখানে যে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে সেটা বছর দূরে থাক, সকাল আর বিকেলের মধ‍্যেই অনেক সময় হঠাৎ করে দাম বেড়ে যেতে দেখা যায়।

স্বেচ্ছাচারিতা অন‍্য বিষয়ে সহনশীল করা গেলেও, অর্থনীতি কিন্তু কোনো স্বেচ্ছাচারিতার ধার ধারে না। যে অর্থনীতি যে ব‍্যবস্থায় থাকে, তাকে ঠিক সেভাবেই পরিচালিত করতে হয়। পুঁজিবাদী মুখোশের আড়ালে সমাজতান্ত্রিক মনন রাখা যায় না। দুঃখ হয়, যখন দেখি, আমরা ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করার মন্ত্রটা খুব ভালোভাবে বুঝলেও, বাজার থেকে রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করার তত্ত্বটা আজও বুঝে উঠতে পারলাম না। অথচ এটাই সবার আগে বোঝা দরকার। কারণ পেটে ভাত না থাকলে, ধর্ম, রাজনীতি, রাষ্ট্র, সমাজ- কিছুই কাজে আসে না।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us