লিবিয়ায় সাইফ গাদ্দাফি কার ট্রাম্প কার্ড?

মাসুম খলিলী | Nov 23, 2021 03:48 pm
সাইফ গাদ্দাফি

সাইফ গাদ্দাফি - ছবি সংগৃহীত

 

অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে, নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ায় জাতিসঙ্ঘ মিশনের মেয়াদ এক বছরের জন্য পুনর্নবীকরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ব্রিটেনের তৈরি করা একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে ব্রিটিশ-রাশিয়ান বিরোধে শুধুমাত্র চলমান কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিরোধটি যুদ্ধাপরাধীদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং বিদেশী বাহিনী ও ভাড়াটে সৈন্যদের প্রস্থান সংক্রান্ত বিষয়টি প্রস্তাবে থাকার উপর ভিত্তি করে দেখা দিয়েছে।

ব্রিটিশ খসড়া প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদে নতুন রুশ অবস্থানের কঠোরতা বোঝা যায়, সাইফ গাদ্দাফির রাজনৈতিক ভূমিকার বিরোধিতা করার আমেরিকান অবস্থানের প্রতিক্রিয়া হিসাবে এটি হয়েছে বলে মনে হয়। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সাইফ গাদ্দাফির প্রার্থিতা বিশ্বের জন্য একটি সমস্যার প্রতিনিধিত্ব করে আর রাশিয়া তার উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কার্ড হিসেবে বাজি ধরছে যার মাধ্যমে লিবিয়ায় তার পূর্বের প্রভাব পুনরুদ্ধার করতে চায় মস্কো। বিশেষ করে হাফতারের ভূমিকার পতনের সাথে সাথে রুশ প্রভাব যে কমেছে সেটাকে পুনরুদ্ধার করতে চায় তারা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নিয়ন্ত্রণকামীদের কাছে লিবিয়া এক আকর্ষণীয় দেশ। জনসংখ্যা ৭০ লাখেরও কম কিন্তু আফ্রিকার সবচেয়ে বড় তেল-গ্যাসের রিজার্ভ আছে এখানে। এর অবস্থান ইউরোপের ঠিক উল্টো দিকেই। এখানকার হাইড্রোকার্বন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সরাসরি রফতানি হতে পারে। অন্যদিকে উপসাগরীয় এলাকার প্রতিদ্বন্দ্বী তেল-গ্যাস উৎপাদকদের জাহাজগুলোকে আসতে হয় বিপজ্জনক সমুদ্রপথ দিয়ে।
সর্বশেষ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগে জাতীয় ঐক্য সরকারের প্রধানমন্ত্রী ফায়েজ আল সেররাজকে সমর্থন করছে তুরস্ক, কাতার ও ইতালি। জেনারেল হাফতারকে সমর্থন করে আরব আমিরাত, জর্দান, মিসর, রাশিয়া ও ফ্রান্স। এখন দৃশ্যত সব পক্ষই ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে যার মাধ্যমে একটি একক সরকার লিবিয়ার কর্তৃত্ব গ্রহণের কথা।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র একেক সময় একেক রকম রাজনৈতিক সঙ্কেত দেয়। কখনো ত্রিপলির সররাজ, কখনো বেনগাজির জেনারেল হাফতারকে উৎসাহ দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হওয়ার পর জাতিসঙ্ঘের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগকে বাইডেন প্রশাসন সমর্থন করছে বলে মনে হয়; যদিও যুক্তরাষ্ট্রের ভয় রয়েছে, রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন হয়তো লিবিয়ায় নিজের প্রভাব কায়েম করবেন, ঠিক যেভাবে তিনি সিরিয়ায় করেছেন।

২৪ ডিসেম্বরের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে খলিফা হাফতারকে এক সময় রাশিয়া আমিরাত মিসর ফ্রান্স সবাই সমর্থন করেছিল। এখন রাশিয়া সাইফুল ইসলাম গাদ্দাফি, মিসর আকুলা সালেহ এবং ইসরাইল-আমিরাত খলিফা হাফতারকে সমর্থন করছে বলে মনে হয়। আঙ্কারা সম্ভবত সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ফাতিহ বাসাংঘা প্রেসিডেন্ট হলে বেশি স্বস্তি অনুভব করবে। তুরস্ক অবশ্য কোনোভাবেই চাইছে না খলিফা হাফতার ক্ষমতাশালী হয়ে উঠুক আবারও।

প্যারিস সম্মেলনের বার্তা
লিবিয়া নিয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্যারিস সম্মেলনও নির্বাচন অনুষ্ঠান বা স্থগিত করার গিঁট খুলতে সক্ষম হয়নি। এতে লিবিয়ায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছিল। গত ১২ নভেম্বর দুই ডজনেরও বেশি নেতার একটি দল ঘোষণা করেছে, লিবিয়া জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে যার অর্থ উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে ছয় বছরের গৃহযুদ্ধের পর স্থিতিশীলতা আসবে।

ফরাসি রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ লিবিয়ার পরিকল্পিত নির্বাচনকে ট্র্যাকে রাখার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বৈঠকের জন্য মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস এবং জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলসহ অন্য নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানান। এই সম্মেলনে বিশ্ব শক্তিবর্গ বলেছে যে, তারা ২৫ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া লিবিয়ার নির্বাচন প্রক্রিয়াকে সমর্থন করছে। অবশ্য একই দিনে সংসদীয় এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানানো থেকে তারা বিরত থাকে। লিবিয়ায় জাতিসঙ্ঘ মিশনের মধ্যস্থতায় অক্টোবরের একটি যুদ্ধবিরতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জাতীয় চুক্তির সরকার এবং বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মির মধ্যে লড়াই থামিয়ে দেয়। দেশব্যাপী নির্বাচনের জন্য দেশকে প্রস্তুত করতে ফেব্রুয়ারিতে একজন অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী এবং তিন সদস্যের রাষ্ট্রপতি পরিষদ নির্বাচিত হয়। তবে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি যুদ্ধবিধ্বস্ত লিবিয়ায় জোরপূর্বক এবং ভয়ভীতি ছাড়াই অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছে।

প্যারিস সম্মেলনে বলা হয়েছে, যে সব ব্যক্তি বা সত্তা, লিবিয়ার অভ্যন্তরে বা বাইরে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বাধা দেয়া, দুর্বল করা, কারচুপি বা মিথ্যা বলার চেষ্টা করবে তারা নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি নেবে। ১২ নভেম্বরের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের এক ভিডিও বার্তায়, জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস লিবিয়ার কর্মকর্তাদের তাদের নিজস্ব স্বার্থের চেয়ে জাতির মঙ্গলকে এগিয়ে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, যে কোনো পক্ষ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে শান্তি নষ্ট করে বা নাশকতা করে, তাকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে ।

শঙ্কা কোথায়?
লিবিয়া যে সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়গুলোর মুখোমুখি হতে পারে তা হলো, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা এর ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে আবারো দেশের পূর্বে একটি সরকার এবং পশ্চিমে আরেকটি সরকার গঠনের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এই দ্বৈততা মুছে ফেলা হয়েছিল আবদেল হামিদ আল দাবাইবার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য সরকারের মধ্য দিয়ে। এর ব্যত্যয় ঘটলে আবারো লিবিয়ার তেল রফতানি বন্ধের হুমকি ফিরে আসার আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরে যদি বিদেশী বাহিনী এবং ভাড়াটেরা এই বা সেই দলটিকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে। আর সাইফুল গাদ্দাফি এবং হাফতারের মতো সমস্যাযুক্ত প্রার্থীদের উপস্থিতি নিয়ে একটি সহিংস গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাও একেবারে অমূলক হবে না। তাদের প্রার্থীরূপে ঘোষণার পরে হাই ইলেক্টোরাল কমিশনের কয়েকটি দফতরে যে হামলা হয় তা কেবল এমন একটি ভীতিকর সম্ভাবনার পূর্বাভাস দিয়েছে যা উপজাতীয় ও আঞ্চলিক সংবেদনশীলতাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
কেউ কেউ ভাবেন, নির্বাচন পেছানো হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে কি না। এক্ষেত্রে যুক্তি হলো বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন পরিচালনা করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে যেহেতু এর সততার সমস্যাগুলো মোকাবেলার জন্য সময় খুব কম। এই সমস্ত শঙ্কা অনুমানের মধ্যে, লিবিয়ান এবং এর পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোও যারা তাদের ভালোবাসে তাদের শ্বাস আটকে আছে এক রাশ অনিশ্চয়তায়।

mrkmmb@gmail.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us