জীবনের গতি-প্রকৃতি

মুহাম্মদ ফজলুর রহমান | Feb 21, 2022 02:37 pm
জীবনের গতি-প্রকৃতি

জীবনের গতি-প্রকৃতি - ছবি : সংগ্রহ

 

বিজ্ঞান বলে, পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সব কিছুই গতিশীল। একটি আরেকটির সাপেক্ষা গতিশীল। কোন কিছুই স্থির নয়। অপরপক্ষে সাহিত্য দেখিয়ে দেয় যে, জীবনও গতিশীল, স্থির নয়। যেকোনো অবস্থায়ই হোক, জীবন চলে যায়, থেমে থাকে না। জীবনের নানা দিগি¦দিকে বস্তুর গতি-প্রকৃতির সূত্রগুলোও ব্যবহার্য। বিজ্ঞানের প্রথম কথা হলো, দৃষ্টিভঙ্গি। সাহিত্যও জীবন সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। গতি-বিজ্ঞানের ভাষ্য অনুযায়ী গতির সাপেক্ষ্য নীতি আপেক্ষিকতার ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে। একটি বস্তুর সাপেক্ষে আরেকটি বস্তু গতিশীল। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটির সাপেক্ষে চলমান ব্যক্তিটি গতিশীল। যদি দু’জন ব্যক্তি হাত ধরাধরি করে চলে, তাহলে দু’জনের মধ্যে কোন গতি থাকে না। তবে, রাস্তার পাশের গাছটির সাপেক্ষে ওই দুই ব্যক্তি গতিশীল। এভাবে মহাবিশ্বের প্রতিটি জিনিসই চলমান বা গতিশীল, একটি সাপেক্ষে আরেকটি। পৃথিবীর কেন্দ্রের সাপেক্ষে তার পৃষ্ঠ গতিশীল, আর সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবী গতিশীল, যার ফলে বছরের পরিক্রমা চলে এবং ঋতু পরিবর্তন হয়। এভাবে প্রকৃতিতে একটি সুন্দর শৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। প্রকৃতির সব কিছু যদি সমানভাবে গতিশীল হতো, তাহলে এই ভারসাম্য তৈরি হতো না।

বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন এই বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং তার ভিত্তিতেই তিনি তার ‘গতি তত্ত্ব’ আবিষ্কার করেন। তার এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ভৌত বিজ্ঞানের অনেক সূত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মানুষের বাস্তব জীবনে উপকার দিয়ে থাকে। ব্যক্তি জীবনেও সেই সূত্র কাজে লাগিয়ে জীবনকে সুন্দর করা যায়। যেমন, যেকোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই মানুষের উপকারের জন্য। উন্নততর প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে মানুষের কর্মজীবনে গতি এসেছে, যার ফলে সময়ের অনেক সাশ্রয় হওয়ার কথা। সেই সময়কে কাজে লাগিয়ে মানুষের মর্মজীবনকে কর্মজীবন থেকে আলাদা করে সেইখানে স্থিতি স্থাপনের চেষ্টা করা যায়। মর্মজীবন মানে হলো, মানুষের মনজগত বা মনস্তত্ত্ব। প্রেম-ভালোবাসা, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, আবেগ, উচ্ছ্বাস, সম্পর্ক, হর্ষ, বিষাদ প্রভৃতি মনজগতের এক একটি অনুসঙ্গ। এই জায়গাগুলোতে কাঙ্ক্ষিত অবস্থা বজায় থাকাই হলো জীবনের গতিশীলতা। জীবনের গতিশীলতা বলতে বৃত্ত-বৈভব আর খ্যাতির পেছনে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে চলা নয়। বৃত্ত মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে জানে, আর চিত্ত বাঁচে সাহিত্যের সুধা পানে। বৃত্তের জন্য বিজ্ঞান, আর চিত্তের জন্য চিন্তা (সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন)। যদি বলা হয়, সাহিত্যের সাথে বিজ্ঞানের যোগসূত্র বা সম্পর্ক আছে- কথাটি শুনতে ভালো না-ও লাগতে পারে। কিন্তু দুটির উদ্দেশ্য একই। আর তা হলো মানব জীবনের কল্যাণ। বিজ্ঞান বস্তুকে বিশ্লেষণ করে রহস্য উদঘাটন করে। তারপর বস্তুর প্রাকৃতিক নিয়মগুলো জেনে তার উপর ভিত্তি করে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটিয়ে বস্তুর নতুন উপযোগ তৈরি করার মাধ্যমে মানব জীবনের জন্য উপকারী করে তুলে ধরে। মানুষ সেগুলোকে জীবন পরিচালনার কাজে ব্যবহার করে জীবনযাপনকে সহজ করার চেষ্টা করে। অন্য দিকে সাহিত্য মানুষের জীবনকে বিশ্লেষণ করে। জীবনের সুখ-দুঃখ, ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই, সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ, যুদ্ধ-শান্তি, বিশ্বাস, অবিশ্বাস প্রভৃতিকে রূপায়িত করা ও তুলে ধরার মাধ্যমে জীবনকে সুখময় ও উপভোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। সুতরাং সাহিত্য ও বিজ্ঞান উভয়ের বিষয়বস্তু হলো জীবন এবং উভয়ের উদ্দেশ্য হলো জীবনকে বোধগম্য করা। বিজ্ঞান জীবনকে সহজ করে, আর সাহিত্য জীবনকে সুন্দর করে।

কর্মজীবনে বিজ্ঞানের প্রভূত অবদান থাকলেও মানুষের মর্মজীবনে নাই। মর্মজীবনে অবদান রাখে সাহিত্য। কর্ম, মর্ম আর ধর্ম- এই তিনটি হলো জীবনের ত্রিভুজক্ষেত্রের একেকটি বাহু। কর্ম বেঁচে থাকার জন্য। আর মর্মচর্চা হলো সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য। ধর্ম মানুষের জীবনের এ দুই দিকের উপর খরবদারির ভূমিকা পালন করে; যাতে মানুষ পথভ্রষ্ট না হয়। সুতরাং সুষ্ঠ জীবন পরিকল্পনায় এই তিনটির গুরুত্বই সমান। কিন্তু আমরা যা দেখছি, তাতে মনে হয়, বিজ্ঞান যেন দিন দিন সাহিত্যকে করে দিচ্ছে গুরুত্বহীন। মানুষ এখন শুধুই বিজ্ঞানমুখী। আর সে কারণেই হয়ত মানুষের জীবনে স্বস্তি কম, অস্থিরতা বেশি। গতি-প্রকৃতির আপেক্ষিকতা নীতির ক্ষেত্রে যেমন একটি স্থির বিন্দুকে প্রারম্ভিক বিন্দু ধরে নিয়ে অন্য বিন্দুর দূরত্ব বা গতি হিসব করা হয়, তেমনি জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও উল্লিখিত তিনটি বাহু বা বিন্দুর একটিÑ মর্ম বা মনজগৎকে স্থির ধরে নিয়ে জীবন সাজাই, তাহলে জীবন সুন্দর ও ফলপ্রসূ হবে। কিন্তু যাপিত জীবনে আমরা সব কিছুতেই সমান তাল সৃষ্টি করে জীবনকে গতিশীল করার চেষ্টা করছি। ফলে জীবনে শুধু অস্থিরতাই বাড়ছে। আর এই অস্থিরতা সুখানুভূতিকে নষ্ট করে দিচ্ছে।

সুখ লাভের জন্য আমরা চাহিদাকে বাড়িয়ে দেই। কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাহিদা সুখ দেয় না। চাহিদা বাড়ালে অভাবও বাড়ে। আর যেকোনো প্রকারের অভাব সুখকে বিতাড়িত করে। আকাক্সক্ষায় আকাক্সক্ষা বাড়ে, আর নিবৃত্তি আনে সুখ। মানুষ যেখানে নিবৃত্ত হবে সেখানেই সুখের ঠিকানা। সুখী হওয়ার জন্য বাড়তি চাহিদা, আকাক্সক্ষা, লোভ, ক্ষোভ, জিঘাংসা প্রভৃতিকে থামিয়ে দেয়া বাঞ্ছনীয়। এগুলোর বৃদ্ধিতে সুখ হয় সুদূরপরাহত। প্রাচুর্যকে প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাই স্বাভাবিকতা। প্রয়োজন পূরণের পরও যদি চাহিদা থেকে যায়, তাহলে সেই প্রাচুর্য উপভোগ্য হয় না। সূর্যের আলো ও তাপের প্রাচুর্য আছে। যেটুকু আলো বা তাপ পৃথিবীর প্রয়োজন তার অতিরিক্ত হলে অস্বস্তি সৃষ্টি হয়। পক্ষান্তরে চাঁদের আলো নেই। সূর্যের আলো সামান্য ধার করে নিয়ে চাঁদ পৃথিবীকে যেটুকু আলো দেয় তাতেই পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়, স্নিগ্ধতা ছড়ায়, মুগ্ধতা বাড়ায় এবং রাতের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলে।

পার্থিব জীবনে সংসার সুখের সুতিকাগার। সংসার-জীবনে নারী-পুরুষ দু’টি পক্ষ মিলে একটি অক্ষ তৈরি করে। লক্ষ্য, একটি সুখের বীজ বোনা। তবে, দু’জনের কক্ষপথ ভিন্ন। দুয়ে মিলে একটি বৃত্তের মত। বৃত্তের একটি কেন্দ্র থাকে, আর একটি পরিধি। কেন্দ্রবিন্দু ছাড়া বৃত্ত হয় না। দু’টি বিন্দু যদি সোজাভাবে চলতে থাকে, তাহলে কোন দিনই বৃত্ত তৈরি হবে না। একটি বিন্দুকে থামতে হবে, আরেকটিকে স্থির বিন্দুর চারপাশে আবর্তন করতে হবে, তবেই তৈরি হবে বৃত্ত। জগতের অস্তিত্বের মূলে যে পরমাণুটি রয়েছে, সেখানেও আমরা দেখব একই অবস্থা। পরমাণুর কেন্দ্রের নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রনগুলো ঘুরছে। অর্থাৎ সেখানেও একটি বৃত্তের মত কর্মকাণ্ড চলছে। আর এভাবে জগতের অস্তিত্ব টিকে আছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, জগতের প্রত্যেকটি জিনিস গতিশীল, আর প্রত্যেক গতিই আপেক্ষিক গতি এবং প্রত্যেক গতিই ঘূর্ণনগতি। গতিতত্ত্বের এই সূত্র প্রয়োগ করে অনেক কিছু আবিষ্কার হয়েছে। তেমনি, জীবনের ক্ষেত্রেও এই তত্ত্ব প্রয়োগ করে জীবনকে প্রাণবন্ত ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করা যায়।

বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে প্রাচুর্য বেশি, আবার সংসার ভাঙার প্রবণতাও বেশি। তুচ্ছ কারণে সংসার নামকগুচ্ছ ব্যবস্থাপনাটি ভেঙে খান খান হয়ে সুখ বিদায় নিচ্ছে। মানুষগুলো হতাশায়, বিরহে, বেদনায় আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। এর ফলে সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সর্বত্র শুধু হানাহানির চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে। কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে, এর অন্যতম কারণ, জীবন যাপনে নারী-পুরুষের সরল রৈখিক গতিতে চলা। নারী-পুরুষ উভয়ে সরল রৈখিক গতিতে চললে জীবন চলবে না। এখানে একজনকে থামতে হবে। নারীই সেই সংসার-বৃত্তের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার উপযুক্ত। কারণ, তার ভিতর সম্মোহিনী শক্তি আছে। তার আছে আবেগ, আসক্তি, ভক্তি। আছে মধ্যাকর্ষণ শক্তির মতো নিজের দিকে টানার ক্ষমতা।

নারী-পুরুষ উভয়েই মানুষ, উভয়েই সমান; কিন্তু এক নয়। পরস্পরের কাছে পরস্পরের চাহিদা এক রকম নয়। প্রয়োজনও আলাদা। পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাসবে; কিন্তু একই ভঙ্গিতে নয়। সংসারে নারী পুরুষের ভূমিকা এক রকম হলে সেটা হবে রৈখিক গতিতে চলার ন্যায়। সমাজ জীবনেও নারী পুরুষের ভূমিকায় ভিন্নতা রয়েছে। ঠিক ডান হাত বাম হাতের মতো। তারা একে অন্যের পুরিপূরক। আবার বৃত্তের উদাহরণ দেই; বৃত্তের ভেতরে যা কিছু হয়, সব কেন্দ্রবিন্দুকে কেন্দ্র করে। সমাজ-সংসারে নারীর ভূমিকা ঠিক তেমনি কেন্দ্রীয় ভূমিকা। মানব জীবনে সভ্যতার এই নাট্যমঞ্চে নারী হলো কেন্দ্রীয় চরিত্র। সুতরাং গতি-প্রকৃতির এই তত্ত্ব শুধু বস্তুজগতে নয়, ব্যক্তি ও পরিবার জীবনের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য।

বস্তুজগতে পরমাণু যেমন পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ, তেমনি সভ্যতা বিনির্মাণে নারী পুরুষের সংসার-জীবন মূল উপাদান। এখান থেকে উৎপাদিত হয় সন্তান, সম্পদ, সম্মান, সম্প্রীতি, স্বাস্তি ও শান্তি। তাই সভ্যতার এই ক্ষুদ্র উপাদানটির গঠন ও ভূমিকা সঠিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। কোনো সামষ্টিক কাজে সবার ভূমিকা এক হয় না। অনেকগুলো যন্ত্রাংশ মিলে একটি যান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি হয়। একটি যন্ত্রাংশ ভুল জায়গায় স্থাপন করলে যন্ত্রটি অচল হয়ে যাবে। জগতের মতো জীবনও প্রাকৃতিক নিয়মে চলে। সেখানে নিয়মের সামান্য ব্যত্যয় ঘটাও ক্ষতিকর। ভালোবাসার বিজ্ঞান আছে, প্রেমেরও রসায়ন আছে। তাই এখানে যুগের সাথে তাল মিলাবার কিছু নাই। প্রাকৃতিক নিয়ম যুগের সাথে বদলে যায় না। জীবনের গতি-প্রকৃতিতে ভৌত বিজ্ঞানের রসায়ন আক্ষরিক অর্থেই কাজ করে।

প্রাকৃতিক নিয়মের জায়গায় অতি যান্ত্রিকতা সমাজ জীবনে দুর্বার গতির সঞ্চার করলেও মানুষের মতি গঠনে দারুণ ক্ষতির কারণ হচ্ছে। অবক্ষয়, বিপর্যয় ক্রমেই দুর্জয় হয়ে উঠছে। হতাশা, নিরাশা, দুরাশা চিন্তার জগৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলছে। মানুষ মননশীলতার পরিবর্তে মরনশীলতা, অর্থাৎ আত্ম-বিধ্বংসী কার্যকলাপের দিকে অন্ধের মত এগিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ হলো, ব্যক্তি জীবনে চাহিদাকে কমিয়ে, আকাক্সক্ষাকে দমিয়ে স্থিতি ও নিবৃত্তি লাভের মাধ্যমে এবং প্রাকৃতিক নিয়ম চর্চার মধ্য দিয়ে জীবনে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যকে গতিশীল করা। সংসার জীবনে নারী-পুরুষ মিলে একটি বৃত্তীয় ধারা তৈরি করে সভ্যতা ও মানবতা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা। সমাজ জীবনে যুদ্ধাচারকে থামিয়ে দিয়ে, শুদ্ধাচারকে গতিশীল করে, মন্দ ও দ্বন্দ্ব বিমুখ মানসিকতা তৈরি করে এবং অপসংস্কৃতির দুর্গন্ধ বন্ধ করে ছন্দময় সমাজব্যবস্থা কায়েম করা।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us