বাবা কেন সব কিছুতে লাভ খোঁজেন

রহমান মৃধা | Apr 08, 2022 09:46 pm
বাবা কেন সব কিছুতে লাভ খোঁজেন

বাবা কেন সব কিছুতে লাভ খোঁজেন - ছবি : সংগৃহীত

 

আমি সেই ১৯৮৫ সালে দেশ ছেড়েছি। বিদেশে বসবাস করার পেছনে ভালো-মন্দের দুটি দিকই রয়েছে যেটা দেশেও ছিল। তবে বিদেশে মানিয়ে নেয়ার অভ্যাসগুলো গড়ে উঠে একটু বেশি। যেমন ধরুণ বাজারে গেলাম তরকারি কিনব। একটি বেগুন ওজন ২৫০ গ্রাম কখনো দাম ২০ ক্রোনার আবার কখনো ১৫ বা ১০ ক্রোনার। সস্তা হলে কিনি, নইলে অন্য তরকারি কিনি। এমন না যে বেগুন কিনতেই হবে বা পেয়াঁজ নেই- খাওয়া বন্ধ ইত্যাদি। মানিয়ে নিয়ে চলতে শিখেছি। এর মূল কারণ হয়তবা ভিন দেশ, বেগুন নেই তো কী হয়েছে আলু বা অন্য কিছু আছে তো, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এই ধরণের মনমানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে। তবে লাভ-ক্ষতির বিষয়টি কিন্তু মাথায় রেখেই প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে অভ্যস্ত যদিও সেটা আমার বাবার মতো কথায় কথায় প্রকাশ হয় না।

আমার বাবা মারা গেছেন ২০০৭ সালে, তার একটি কথা প্রায়ই মনে পড়ে। বাবা সুইডেনে এলে বলতাম, চলেন একটু রাজবাড়ি থেকে ঘুরে আসি বা সুইডেনের বাইরে যেমন লন্ডন, জার্মানি, অ্যামেরিকায় বেড়াতে যাই? বাবার প্রথম প্রশ্ন বেড়ায় বা ঘুরে লাভ কী? মা এ কথা বাবার মুখে শুনতেই রেগে গেলেন। সাথে সাথে আমাকে বলতে শুরু করলেন, 'তোর বাবার মুখে সারাজীবন একই কথা লাভ কী, লাভ কী? যদি কখনও বলি আমার বাবা-মার বাড়ি যাবো, চলো আমাকে নিয়ে কিছুদিনের জন্য, সে বলে লাভ কী সেখানে গিয়ে?'

মার কথা বলার সময় লক্ষ্য করলাম বেশ আবেগ এবং মনে কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বলছেন। আমি মাকে একটু সহজ করার চেষ্টা করতে আলোচনায় মন দিলাম। তো মাকে প্রশ্ন করলাম, 'আচ্ছা মা, বাবা যে সারাক্ষণ জিজ্ঞাসা করেন লাভ কি? তুমি কী কখনও এর উত্তর দিয়েছো?' মা উল্টা আমার উপর ক্ষেপে গেলেন। বললেন যেমন বাপ তেমন ছেলে। যাক বাঁচা গেল যে বাপের উপর যে রাগ ছিল সেটা এখন আমার উপর পড়েছে। তবে ঘটনাটি তদন্ত করা দরকার, কেন বাবা সব কিছুতে লাভ খোঁজেন!

আমি বাবাকে জিঙ্গেস করেছিলাম সেদিন, 'বাবা আমেরিকা যেতে বললাম অন্যকিছু না বলে শুধু বললেন লাভ কি? আপনার মেয়ে জলি থাকে সেখানে, তার একটি মেয়ে হয়েছে, তারপর নতুন একটি দেশ কতকিছু দেখার রয়েছে। এতো কিছু দেখা, অনুভব করা, আপনার যেমন ভালো লাগবে তেমনি জলির ভালো লাগবে, মার ভালো লাগবে, আমার ভালো লাগবে যে বাবা-মার সাথে বিশ্ব ভ্রমণ। কী এগুলো কী লাভ না? নাকি আপনি অর্থের দিকটার কথা চিন্তা করছেন?' বাবা বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার কথার উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন তার বাল্যজীবনে। অনেক কথা যা আগে শুনিনি সেসব ঘটনা তুলে ধরলেন, সে এক ইতিহাস। বাবার সব কিছু শোনা এবং জানা হলো সেদিন। কথা শেষে বাবা বলেছিলেন, 'পুরো জীবনটাই বাবা হিসাব নিকাশের যেখানে লাভ-ক্ষতি জড়িত। আমি কথার কথা হিসাবে লাভ কী এটাই ব্যবহার করি এই আর কী।'

এত বছর পর কথাটি মনে পড়ে গেল কারণ কিছু দিন ধরে গণমাধ্যমে দেখছি বেগুনির উপর ঝড় বয়ে চলছে। প্রধানমন্ত্রী হয়তো কথার কথা হিসেবে বলেছেন বেগুনের বেগুনি না খেয়ে কুমড়ার বেগুনি খেলেই তো হয়। মূলত তিনি 'বেগুনের দাম বেড়েছে সেটা না খেয়ে কুমড়া ভাজি খেলেই তো হয় সেটা খেতেও তো মজা।' এটাই মিন করেছেন আমার বিশ্বাস। তবে আজকাল একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেটা হচ্ছে সমস্যার সমাধান বাদ দিয়ে অন্য বিষয় নিয়ে টানা হেঁচড়া করা। যেমন : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি একটা সমস্যা এটা সমাধান না করে প্রধানমন্ত্রীর কথা নিয়ে পুরো গণমাধ্যমকে ব্যস্ত রাখা।আমরা বাঙালি জাতি সত্যি একটি পরিবার যার পরিচয় পরিবার থেকে রাষ্ট্রের পরিকাঠামো পর্যন্ত লতার মতো জড়িয়ে রয়েছে আমাদের সবার হৃদয়ে। কী চমৎকার সব কিছু তাই না?

তবে বাবার ব্যাখ্যাটি ভালো লেগেছিল যখন বলেছিলেন 'বেঁচে থাকার সার্থকতা লাভে বাবা। মরার সময় যদি দেখো লাভের চেয়ে ক্ষতির বোঝা ভারঅ তবে মরেও শান্তি পাবে না, তাই সব সময় লাভ খুঁজি।'
আজ বাবা-মা বেঁচে নেই তবে তাদের স্মৃতি রয়েছে মনে। রোজার মাসে আমার বাবা-মা ডাবের পানি দিয়ে ইফতারি শুরু করতেন গ্রামে, তারপর রোজার সময় বেগুনি না হলে চলে না। তাও একটু তৈরি করতেন। বাড়ির কর্তার (বাবা) পেটে সমস্যা, টক দই ছাড়া চলবে না তারও ব্যবস্থা হতো। ছোট বেলার সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়ে। সেই সাথে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানটি- 'ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ, ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি, আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।'

লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
rahman.mridha@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us