‘নৈতিকতায় আমরা কেন পিছিয়ে’

আবু সাঈদ | Jul 02, 2022 05:53 pm
‘নৈতিকতায় আমরা কেন পিছিয়ে’

‘নৈতিকতায় আমরা কেন পিছিয়ে’ - ছবি : সংগ্রহ

 

সুশিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। দেশের প্রতিটি নাগরিকের অনিবার্য অধিকার। এর নিশ্চয়তা দিতে হয় দেশের কর্তাশ্রেণীকে। এর জন্য নিতে হয় সৃজনশীল উদ্যোগ। দিতে হয় পরম দায়িত্বশীলতার। গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগকে সর্বদা গভীর নজরদারির মধ্যে রাখতে হয়। যেন সুশিক্ষার কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি না হয়। অনৈতিকতা যেন ছাত্রদের স্পর্শ করতে না পারে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগের দুর্বলতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই জনমনে তৈরি হচ্ছে নানা প্রশ্ন। সচেতন অভিভাবকদের চাপা উৎকণ্ঠা, আমাদের সন্তানদের সুশিক্ষা দেয়া হচ্ছে তো! সমাজে ভেসে বেড়াচ্ছে- নৈতিকতায় কেন আমরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি!

এসব প্রশ্ন বা উৎকণ্ঠা নানা সময় দেখা দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া সাভারের মর্মান্তিক ঘটনাটি নতুনভাবে তাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত করেছে। প্রেমিকার সাথে খুনসুটিতে বাধা দেয়ায় জিতু নামের এক ছাত্র শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করেছে। পুরো দেশ তাতে স্তব্দ হয়ে গেছে। একই সময়ে আরো কিছু ন্যাক্কারজনক ঘটনার পুনারাবৃত্তি ঘটেছে আরো কয়েকটি অঞ্চলে। খবরের কাগজে যা ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। সবাই গভীর উদ্বেগের সাথে প্রত্যক্ষ করেছে, শিক্ষাগুরুর প্রতি সমীহ ভাব এখন সম্পূর্ণরূপে বিদায় হতে চলেছে। শঙ্কা দেখা দিয়েছে সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়েও। যেখানে শিক্ষাগুরুর নিরাপত্তা নেই, সেখানে সতীর্থদের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে। ফলে নৈতিকতার পাঠে নতুন করে মনোযোগ দেওয়া সময়ের অন্যতম দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু অভিবাভক মহল অত্যন্ত আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করল, আগামীর পাঠ্যক্রম থেকে নৈতিকতার পাঠ সম্পূর্ণরূপে বিদায় দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষ সকল আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছে। আরো বিস্ময়াভূত করেছে, দেশের কর্তাশ্রেণীরাও তাতে কোনো আপত্তি জানায়নি। সম্প্রতি দাবি করা হয়েছে যে নৈতিকতা চর্চার যেসব পাঠ বাদ দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- ক্লাস-২ : ‘সবাই মিলে করি কাজ’ - শিরোনামে মুসলমানদের শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। ক্লাস-৩ : ‘খলিফা হযরত আবু বকর’ শিরোনামে একটি সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। ক্লাস-৪ : খলিফা হযরত ওমর এর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। ক্লাস-৫ : ‘বিদায় হজ্জ’ নামক শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। ক্লাস-৫ : কাজী কাদের নেওয়াজের লিখিত ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ নামক একটি কবিতা। যা বাদশাহ আলমগীর মহত্ব বর্ণনা উঠে এসেছে। এবং শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে আদব কেমন হওয়া উচিত তা বর্ণনা করা হয়েছিল। ক্লাস-৫ : শহীদ তিতুমীর নামক একটি জীবন চরিত। এ প্রবন্ধটিতে শহীদ তিতুমীরের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘটনা উল্লেখ ছিলো। ক্লাস-৬ : ড. মুহম্মদ শহীদু্ল্লাহ লিখিত ‘সততার পুরস্কার’ নামক একটি ধর্মীয় শিক্ষণীয় ঘটনা। ক্লাস-৬ : মুসলিম দেশ ভ্রমণ কাহিনী- ‘নীলনদ আর পিরামিডের দেশ’। ক্লাস-৬ : মুসলিম সাহিত্যিক কায়কোবাদের লেখা ‘প্রার্থনা’ নামক কবিতাটি। ক্লাস-৭ : বাদ দেয়া হয়েছে মরু ভাষ্কর নামক শেষ নবীর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত। ক্লাস-৮ : বাদ দেয়া হয়েছে ‘বাবুরের মহত্ত্ব’ নামক কবিতাটি। ক্লাস ৯-১০ : সর্ব প্রথম বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের বাংলা কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের লেখা ‘বন্দনা’ নামক ধর্মভিত্তিক কবিতাটি। ক্লাস ৯-১০ : এরপর বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম কবি ‘আলাওল’-এর ধর্মভিত্তিক ‘হামদ’ নামক কবিতাটি। ক্লাস ৯-১০ : বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম কবি আব্দুল হাকিমের লেখা বঙ্গবাণী কবিতাটি। ক্লাস ৯-১০ : গোলাম মোস্তাফার লেখা জীবন বিনিময় কবিতাটি। কবিতাটিতে মোগল বাদশাহ বাবর ও তার পুত্র হুমায়ুনকে নিয়ে লেখা। ক্লাস ৯-১০ : কাজী নজরুল ইসলামের লেখা বিখ্যাত ‘উমর ফারুক’ কবিতা।

দেখা যাচ্ছে, নৈতিকতার চর্চার যেসব পাঠ ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত, সেসবকে বেশ বাছাই করেই পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাই অভিবাভক মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে- তবে কি আমাদের সন্তানদের ধর্মহীন এক বিপদগামী প্রজন্মরূপে গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হচ্ছে! তাদেরকে আরো আতঙ্কিত করেছে নৈতিকতা পাঠের বিকল্প পাঠের সংযুক্তি দেখে। সেসব পাঠ একদিকে যেমন ছাত্রকে ধর্ম থেকে দূরে নিয়ে যাবে, তেমন বাঙালির শত বছরের লালিত ঐতিহ্য বিশ্বাস থেকেও বিচ্যুত করবে। দাবি করা হয়েছে যে নতুন যুক্ত করা পাঠের মধ্যে আছে- ক্লাস-৫ : স্বঘোষিত নাস্তিক হুমায়ুন আজাদ লিখিত ‘বই’ নামক একটি কবিতা, যা মূলত মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন বিরোধী কবিতা। ক্লাস-৬ : প্রবেশ করানো হয়েছে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ নামক একটি কবিতা। যেখানে রয়েছে হিন্দুদের দেবী দুর্গার প্রশংসা। ক্লাস-৬ : সংযুক্ত হয়েছে ‘লাল গরুটা’ নামক একটি ছোটগল্প। যা দিয়ে মুসলিম শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে গরু হচ্ছে মায়ের মতো, অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদ। ক্লাস-৬ : অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ভারতের হিন্দুদের তীর্থস্থান রাচি’র ভ্রমণ কাহিনী। ক্লাস-৭ : `লালু’ নামক গল্পে বাচ্চাদের শিক্ষা দেয়া হচ্ছে হিন্দুদের পাঠাবলীর নিয়ম কানুন। ক্লাস-৮ : পড়ানো হচ্ছে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ ‘রামায়ন’-এর সংক্ষিপ্তরূপ। ক্লাস ৯-১০ : প্রবেশে করেছে ‘আমার সন্তান’ নামক একটি কবিতা। কবিতাটি হিন্দুদের ধর্ম সম্পর্কিত ‘মঙ্গলকাব্যের অন্তর্ভুক্ত, যা দেবী অন্নপূর্ণার প্রশংসা ও তার কাছে প্রার্থনাসূচক কবিতা। ক্লাস ৯-১০ : অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ভারতের পর্যটন স্পট ‘পালমৌ’-এর ভ্রমণ কাহিনী। ক্লাস ৯-১০ : পড়ানো হচ্ছে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ শিরোনামে বাউলদের বিকৃত যৌনাচার। ক্লাস ৯-১০ : ‘সাকোটা দুলছে’ শিরোনামের কবিতা দিয়ে ৪৭-এর দেশভাগকে হেয় করা হচ্ছে, যা দিয়ে কৌশলে ‘দুই বাংলা এক করে দেয়া’ অর্থাৎ বাংলাদেশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। ক্লাস-৯-১০ : প্রবেশ করেছে ‘সুখের লাগিয়া’ নামক একটি কবিতা, যা হিন্দুদের রাধা-কৃষ্ণের লীলাকীর্তন।

পাঠ্য তালিকার এসব রচনা সচেতন অভিভাবক মহলকে বেশ চিন্তিত করছে। বিকল্প হিসেবে অনেকেই তার সন্তানের জন্য বেছে নিচ্ছেন মাদরাসার শিক্ষা। খবরের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ইতোমধ্যেই মাদরাসায় ছাত্রদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং কলেজ-ভার্সিটিতে ছাত্রদের সংখ্যা কমতে শুরু করছে। তবে তারা মনে করেন, এটা সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। একটি দেশের জন্য যেমন ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন জাগতিক শিক্ষাও। তবে উভয় শিক্ষার প্রতিই শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা কর্তব্য। সেজন্য কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই আন্তরিক উদ্যোগ নিতে হবে। এবং তা অতি নিকটবর্তী সময়েই। সচেতন অভিভাবক মহলের উদাত্ত আহবান- আগামীর পাঠ্যক্রমে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা যেন পুনর্বিবেচনা করা হয়। এবং নৈতিকতার পাঠকে প্রাধান্য দিয়ে নতুনভাবে শিক্ষাক্রমকে ঢেলে সাজানো হয়। সবার প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট পক্ষ বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us