তারে আমি চোখে দেখিনি

রহমান মৃধা | Jul 09, 2022 07:05 am
তারে আমি চোখে দেখিনি

তারে আমি চোখে দেখিনি - ছবি : সংগৃহীত

 

রোজার ঈদ চলে গেল বাড়ি যাওয়া হয়নি, এদিকে কোরবানির ঈদের আছে বাকি তিন দিন। কোরবানির ঈদেও যে বাড়ি যাবো মনে হয় না। এমন একটি টেক্সট করেছে সাইমুম।

আমি তাকে লিখলাম, বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না?
উত্তরে সে জানাল, করে! কিন্তু, ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে তাই ভাবছি সময় নষ্ট না করে বরং, প্রস্তুতির উপরই থাকি।

আমি বললাম, প্রতিযোগিতার যুগে টিকে থাকতে অনেক সময় অনেক কিছু কোরবানি করতে হয়। তবে, একই সাথে এটাও মনে রাখা দরকার যে এখনকার এ সময়গুলো জীবনে ফিরে আসবে না।

কথা শেষ করে টেলিফোন রেখে দিলাম। সন্ধ্যায় তাকে একটি লেখা পাঠিয়েছিলাম চেক করার জন্য, সে জানিয়েছে, বাইরে টিকিট কাটতে এসেছি, কাজ শেষে লেখাটি দেখব।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সে লিখার উপর ফিডব্যাক দিয়েছে। আমি একটু রসিকতা করে লেখলাম বাড়িতে নাকি ম্যাসে এখন?

সে উত্তরে লিখল, আসলে নাইট কোচয়ের টিকেট পাইনি। তাই বাইপাইলে এক ভাইয়ের বাসায় এসেছি। ভাই গার্মেন্টসে কাজ করেন। সবাই মিলে একটা বাস ভাড়া করে ঈদে বাড়ি যাবেন। এনাদের সাথে আমিও যেতে পারব ভাই বলেছেন। কী বলি স্যার? এনাদের জীবনের কথা। কী কষ্ট! কী কঠোর পরিশ্রম! অনেক কিছু শিখলাম এখানে এসেও। এলাকার অনেকেই এখানে খুব কষ্টের মধ্যে হলেই জীবিকার কারণে ঢাকা শহরের আশেপাশে আছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথে ২৪ ঘণ্টা, যেন একটা উপন্যাস। যা হোক চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা হলো, আগে নিজে কোথাও একটু দাঁড়াই। ইনশাআল্লাহ, পরে এসব বিষয়ের উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।

সাইমুম এইচএসসি জিপিএ গোল্ড পাওয়া ছাত্র। নিজেই ম্যাসে থেকে সংগ্রাম করছে যেন ভালো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে।
কোরবানির ঈদ সামনে। শুরু হয়েছে মানুষের ঘরে ফেরার পালা। তবে এ ফেরার যাত্রা সব সময় আনন্দের হয় না। কেননা, দুর্ঘটনার তো রয়েছেই। তারপর রাস্তার যানজট যাত্রাকে বিষিয়ে তোলে। এ থেকে মুক্তি দরকার। যাতায়াত সুবিধার জন্য সরকার নানা পদ্ধতি গ্রহণ করেছে বটে। কিন্তু তাতেও পুরোপুরি ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ঈদ ছাড়াও সব সময়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় রাস্তায় চলে যাচ্ছে মানুষের।

সমস্যা হচ্ছে আমরা অতি সহজেই ভুলে যায়, যত সমস্যায় হোক না কেন কিছু দিনের মধ্যেই তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে নতুন সমস্যা এসে হাজির হয় ফলে পুরনো সমস্যা বিলীন হলেও তা আবার সময় মত ফিরে আসে। যেমন ট্রাফিক সমস্যা, যানযট সমস্যা, ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়া এবং ছুটি শেষে কাজে ফিরে আসার সমস্যা উল্লেখযোগ্য।

ঈদে বাড়ি যাবার সুব্যবস্থা রাষ্ট্র আজ অবধি করতে পারেনি, অথচ আমরা দেশের অর্থ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বিদেশে চালান দিয়ে বেগম পাড়া শেখ পাড়াসহ কত কিছু করছি!

যাক সে কথা এখন। আসি এখন কমপক্ষে ১৫ কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে জীবনের স্বপ্ন পূরণ করতে। ভালো থাকা এবং পরিবার, বাবা-মা, ভাইবোনদের ভালো রাখার আশায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা শুধু কাজ আর কাজ, হোক না সে কাজ রিক্সা চালানো, গাড়ি ঠেলা, সুইপারের কাজ করা, হকারের কাজ করা, ফেরিওয়ালা হয়ে কেনা-বেচা করা বা গার্মেন্টস এ কাজ করা। বস্তিতে থাকা, একটা টয়লেট যেখানে চব্বিশ ঘন্টা লাইন, গোসলের কথা না হয় নাই বলি। এ জীবন জানিনা গ্রামের চেয়ে মধুর কিনা তবে প্রতিমাসে হাতে কিছু টাকা পাওয়া এবং সেই টাকা দিয়ে পুরো পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘুরানো যে শক্তি এরা পায় তার কাছে বস্তির জীবনের চেয়ে স্বস্তি আর কি হতে পারে!

সাইমুম তার নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে এসেছে সুদূর রংপুর থেকে ঢাকাতে সেই জানুয়ারি মাসে। সংগ্রাম করে চলছে বাবা-মা এবং ছোট ভাইবোনসহ নিজের জীবনের পরিবর্তন আনতে। হতাশা তাকে মাঝে মধ্যে ঘিরে ধরছে। তারপরও সে সংগ্রাম করে চলছে। তবে কোরবানির ঈদে ঢাকা থেকে বাড়ি যাবার একটি বাসের টিকিট জোটেনি তার ভাগ্যে, ঠিক তেমন একটি হতাশা মনে নিয়ে ম্যাসে ফিরতে পথে দেখা মেলে গার্মেন্টসে কর্মরত তার এক ভাইয়ের সাথে। সেই ভাইয়ের সাথে এক মধুময় হৃদ্যতাভরা সময় এবং এ সময়ে সাইমুমের জীবনে যে ঘটনাগুলো দেখার সুযোগ এসেছে তা সে এমনটি করে ব্যক্ত করেছে আমাকে। — গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথে ২৪ ঘণ্টা, যেন একটা উপন্যাস। উপন্যাস কিনা জানি না তবে বাস্তবতার এক ঘটনা প্রবাহ বললে ভুল হবে না। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, তৈরি পোশাক কারখানা (গার্মেন্টস) বা এরকম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত বন্ধ করে দেয়ার সুযোগ কম। তাদের শেষ বেলা অবধি কাজ চলতে থাকে। মালিকানা পক্ষ থেকে ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই তাদের ধাপে ধাপে ছুটি দেয়া যেতে পারে বা কোম্পানিগুলো মিলে দূরের কর্মীদের বাড়ি পাঠাতে পারে।

হয়তো, সাইমুমের জীবনে এ ঘটনা দাগ হয়ে রবে আজীবন, হয়ত সাইমুম নতুন জীবন খুঁজে পাবে এ ঘটনার পর, হয়ত সাইমুম জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এই সমাজ, এই দেশ আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ এবং সে দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করবে যা আমরা পারিনি! — ওগো অভাগা দেশ, করিও ক্ষমা তোমাকে আমার মনের মতো করে গড়তে পারলাম না আজও, তার জন্য। তবে নতুন প্রজন্ম পারবে সে বিশ্বাস আমি করি। যাইহোক সাইমুমের জীবনে ঈদ বহুবার আসবে তবে স্মৃতির জানালা খুলে যখন জীবনের কোন এক সময় সে স্মৃতিচারণ করবে আমার বিশ্বাস, এবারের ঈদ হবে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ ঈদ উদযাপন যেখানে থাকবে দুঃখ, কষ্ট, হাসি-কান্না, স্নেহ এবং গার্মেন্টস শ্রমিক ভাইদের প্রাণ ভরা ভালোবাসা।
সাইমুমকে আমি চোখে দেখিনি তবে তার সঙ্গে কথা বলেছি। সে সত্যিই ভাগ্যবান কারণ যে জার্নী সে করার সুযোগ পেয়েছে সবার ভাগ্যে এমন সুযোগ আসে না। কোরবানির ঈদ এমন একটি স্মৃতিভরা হোক সবার জীবনে যে স্মৃতির মধ্যে থাকবে শুধু ভালোবাসা এবং প্রীতি। সবাইকে ঈদ মোবারক।

লেখক : সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us