বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে

আবু সাঈদ | Jul 23, 2022 01:42 pm
বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে

বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছে - ছবি : সংগ্রহ

 

অনেক উন্নত দেশকে পেছনে ফেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ১৯৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৪৫তম। এটা অনেক কষ্টের মাঝেও আমাদের জন্য একটি সুখের সংবাদ। আমাদের বর্তমান রিজার্ভ আছে ৪০ বিলিয়নের চেয়ে কিছু কম। তাতে অন্তত পাঁচ-ছয় মাস দেশের প্রয়োজন মেটানো যাবে। সংশ্লিষ্ট বোদ্ধামহল মনে করেন, চার মাসের রিজার্ভ সংগ্রহে থাকলে একটি দেশ দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তবে আত্মতৃপ্তিতে ভুগলে চলবে না। রিজার্ভ প্রবাহ বৃদ্ধির প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে।

গত বছরও আমাদের দেশে রিজার্ভ সংগ্রহ ছিল ৪৭ বিলিয়ন ডলারের মতো। করোনার কারণে তা নেমে এসেছে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে। করোনা সব দেশেরই অর্থনৈতিক পাটাতন দুর্বল করে ছেড়েছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, করোনার তুলনায় দুর্নীতিই আমাদের অর্থনীতিতে অধিক ধ্বস নামিয়েছে। খেলাপি ঋণীদের অনাচারে ব্যাংকগুলো চরম সঙ্কটে পড়েছে। উপর মহলের নৈতিকতার অভাবে তা আরো প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেভাবেই হোক, গত বছরের তুলনায় এ বছর আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা অনেক কমে গেছে।

রিজার্ভ সংগ্রহের দিকে তাকালে আপাতত দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকা যায়। তবুও কেন দেশ শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে যাচ্ছে ভেবে আমরা আঁতকে ওঠি? তার মূলে আছে ভিন্ন কারণ। বাংলাদেশে বড় প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ছে, যার প্রায় সব কয়টিই অবকাঠামো প্রকল্প। এসব ঋণের মধ্যে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট বা জোগানদারদের ঋণও আছে। এদের সুদহার বেশি। ঋণ সরবরাহকারীরাই প্রকল্প তৈরি করে দিচ্ছে। এ ধরনের ঋণে বাস্তবায়িত প্রকল্পের মান নিয়ে প্রশ্ন থাকে। অর্থ খরচের জবাবদিহিতাও এখানে কম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সময় মতো প্রকল্পের কাজ শেষ হয় না। বর্তমানে যে ১০টি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, তার একটির কাজও সময় মতো শেষ হয়নি। সময় বেড়েছে, ব্যয়ও বেড়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পগুলো থেকে বিনিয়োগ কতটা সময়ে ফেরত আসবে, সেটিও এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বড় প্রকল্পের কারণে এখন বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের দায় আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সূত্র ধরে পত্রিকাগুলো বলছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হয়েছিল ৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯১ কোটি ডলার। অন্যদিকে সবারই ধারণা, রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বড় প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ হলে এই ঋণ পরিশোধের দায় অনেক বেড়ে যাবে।

স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে গেলে কম সুদে আর ঋণ পাবে না বাংলাদেশ। মিলবে না বাণিজ্যে বিশেষ অগ্রাধিকার সুবিধা। নিতে হবে বেশি সুদের ঋণ। এতে দায় পরিশোধও বাড়বে। বাংলাদেশেও এখন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। আমদানি ব্যয় আরও বাড়লে রিজার্ভে আরো টান পড়বে। এতে রিজার্ভের অর্থ অবকাঠামো প্রকল্পে খরচ করার সুযোগও কমে আসবে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির ওপর তখন বিরাট চাপ বাড়বে। সেজন্য বিপুল পরিমাণ রিজার্ভ মজুদ রাখা প্রয়োজন।

এখন আমাদের যে রিজার্ভ আছে, এটাকে মধ্যবিত্তের আয়ের সাথে তুলনা করা যায়। অর্থাৎ এখন তো দিন যাচ্ছে। কিন্তু যদি কোনো বিপদে আসবে, উত্তরোণের উপায় থাকবে না। অথচ বিপদ আমাদের অত্যাসন্ন। বাংলাদেশে ২০টি মেগা প্রকল্প চলমান। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ৭০ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশী ঋণই ৪৩ বিলিয়ন ডলার। ঋণের সবচেয়ে বড় অংশ যাবে রাশিয়ার কাছে- ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ। দ্বিতীয়ত যাবে জাপানের কাছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। তৃতীয়ত যাবে চীনের কাছে প্রায় ২১ শতাংশের ওপরে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সব থেকে বেশি ঋণী রাশিয়া, চীন ও জাপানের কাছে। তাদের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাচ্ছে। সব থেকে বড় বড় অংকের দেনা ২০২৪ ও ২০২৬ সালে পরিশোধ করতে হবে। ঋণের এই মহাবোঝা মাথায় নিয়ে আমরা কিভাবে নির্লিপ্ত থাকতে পারি?

এতো গেলো একদিক। এটাকে ঠিক মূল বলা যায় না। তবে অগুরুত্বপূর্ণও নয়। মূল ব্যাপারটা হলো, আমরা আমদানি নির্ভর দেশ। বাহির থেকে আমদানি করে বাঁচতে হয়। বাইরের পণ্য আমদানি করতে হয় ডলারে। ডলারে এখন স্মরণকালের মুদ্রাস্ফীতি চলছে। ডলারের মূল্যস্ফীতি শতকরা ৮ ভাগ ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যা গত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দেশটি সুদের হার ০.৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। একবারে এত সুদের হার বাড়ানো ছিল গত দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। আগে আমরা ৮৫ টাকায় যে পণ্যটি কিনতাম। এখন তা ৯২ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এতে আমাদের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় ঋণের ওপরও সুদও বেশি গুনতে হচ্ছে।

আমরা বিভিন্ন পণ্য রফতানি করি। আমাদের মৌলিক ক্লাইন্ট হলো ইউরোপের দেশগুলো। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তারা পড়েছে বিরাট সঙ্কটে। পেটে ভাত না থাকলে কি আয়েশ করতে মন চায়? সেজন্য তারা আয়েশি পণ্যদ্রব্যে কৃচ্ছতার পথ অবলম্বন করেছে। আমরা আর তাদের কাছে আয়েশি পণ্য বিক্রি করতে পারছি না। ফলে রফতানিও কমে গেছে।

এদিকে আমদানিতে টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। ওদিকে রফতানি আয়ও কমে গেছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখার আরেকটি অন্যতম মাধ্যম বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিটেন্স। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধারা রেমিটেন্স অর্জন করে। তা দেশে পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এখন বিদেশ থেকেও রেমিটেন্স আসার প্রবাহ কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যা ১৫.১২% মাইনাস হিসেবে উল্লেখ করেছে। ফলে অর্থনীতির চাকা একদম ধীরগামী হয়ে গেছে। চলতি হিসাবেও দেখা দিয়েছে স্মরণকালের ঘাটতি। স্বাধীনতার এই ৫০ বছরে এত ঘাটতি আর কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্রে তার পরিমাণ ১৭২৩.৩০ কোটি ডলার উল্লেখ করা হয়েছে।

আমাদের তো ‘দিন আনি দিন খাই’ অবস্থা। এই মুহূর্তে এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে বুকটা ধক করে ওঠবে না? অবশ্যই। ওদিকে বৈদেশিক ঋণের টেনশনও মাথা থেকে সরছে না। সেজন্য দেশের অর্থনীতির অঙ্গনে এতোটা হৈচৈ পড়েছে। যেখানে রিজার্ভ বাড়ানো দরকার, সেখানে আমরা রিজার্ভ বাড়াতে পারছি না। ওদিকে আমদানি আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সংগ্রহে থাকা রিজার্ভও ধরে রাখতে পারছি না। এভাবে চলতে থাকলে দেশ শ্রীলঙ্কা হতে আর কত দূর?

অর্থনীতির বিশ্বায়নের এই যুগে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে কোন দেশের বড় সম্পদ এবং অর্থনীতির বড় শক্তি। আমদানি ব্যয় মিটানো, স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন রোধ, মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল নীতি জোরদারকরণ, বাজারে আস্থা ধরে রাখাসহ বাজেট বাস্তবায়ন, বৃহৎ প্রকল্পে অর্থযোগান, বৈদেশিক দায় পরিশোধ নিশ্চিতে সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ বা বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ রাখে দেশগুলো।

এজন্য এই সঙ্কটকালে আমাদের শরিয়াহর পথে হাঁটতে হবে। ইসলাম অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য স্থির করেছে ‘হাজাহ নীতি’। সরকার দিন দিন সে পথেই হাঁটছে। তবে সরকারকে মনে রাখতে হবে, হাজাহ নীতির সুফল কেবল তখনই আসবে, যখন কর্তাশ্রেণী ও প্রজাশ্রেণী উভয়েই তা মেনে চলবে। অন্যথায় তার সুফল আসবে না। জনগণ কৃচ্ছ্র অবলম্বন করে যতটুকু বাঁচাবে, অন্যরা সুযোগ ভেবে বিলাসিতায় আরো অধিক গা ভাসিয়ে দিবে।
এজন্য আসুন, দেশকে শ্রীলঙ্কা হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা নিজ নিজ স্থান থেকে উদ্যোগী হই। মনে প্রাণে ইসলামমুখী হই। কারণ, আস্তিক হই আর নাস্তিক হই- দিনশেষে সঙ্কট নিরসনের জন্য ইসলামের দিকেই ফিরে আসতে হবে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us