দ্রব্যমূল্য : ইবনে খালদুনের অন্তর্দৃষ্টি

নাসিম ইমরান | Sep 04, 2022 02:49 pm
ইবনে খালদুনে

ইবনে খালদুনে - ছবি : সংগ্রহ

 

প্রতিটি বাজারই মানুষের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর যোগান দিয়ে থাকে। ইবনে খালদুন দ্রব্যসামগ্রীকে দুই ভাগে ভাগ করেছে।, ক. মৌলিক প্রয়োজনীয় আহার্য্যসামগ্রী খ. বিলাসসামগ্রী। তিনি মৌলিক প্রয়োজনের অধীন রেখেছেন আহার্যের উপাদান গম, যব, শাকসব্জি ও তাদের মসলা হিসাবে পেঁয়াজ, রসুন প্রভৃতি। তার দৃষ্টিতে তৎকালীন সমাজে বিলাসসামগ্রী ছিল পরিপূর্ণতা বিধায়ক প্রয়োজনের সৃষ্ট মসলা, ফলমূল, পরিচ্ছদ, দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী, যানবাহন এবং যাবতীয় শিল্পকর্ম ও স্থাপত্য।

ইবনে খালদুন দ্রব্যমূল্য বিষয়ক তত্ত্ব প্রণয়ন করেন : 'যখন নগরের পরিধি বিস্তারলাভ করে এবং তার অধিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, তখন মৌলিক প্রয়োজনের আহার্য্যসামগ্রী ও তার অনুরূপ দ্রব্যাদির মূল্য সুলভ হয়। অন্যদিকে বিলাসসামগ্রী ও অনুরূপ অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য মহার্ঘ হয়ে থাকে। আবার নগরের জনসংখ্যা কমে গিয়ে তার দুরবস্থা দেখা দিলে এ মূল্যানুপাত বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়।'

তিনি তৎকালীন নগরের সুব্যবস্থা ও দুরবস্থাকে জনসংখ্যার আধিক্য ও কমতির সাথে সম্পর্কিত করেন। এবং বলেন সুব্যবস্থার কারণে দুর্যোগের আশঙ্কা থাকে না। তাই মানুষের মাঝে নিজের ও তার পরিবার-পরিজনের আহার্য্যসামগ্রী মাস বা বছরের জন্য গুদামজাত করার প্রবণতা না থাকায় বাজারে মৌলিক প্রয়োজনের আহার্য্যসামগ্রীর যোগান পর্যাপ্ত থাকে। ফলে তা সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। আর দুরবস্থায় দুর্যোগের আশঙ্কায় আহার্য্যসামগ্রী মাস বা বছরের জন্য গুদামজাত করায়, যোগানের থেকে চাহিদা বেড়ে যায় ফলে মূল্যবৃদ্ধি হয়। ইবনে খালদুন বলেন, 'যদি এরূপ দুর্যোগের আশঙ্কা করে মানুষ খাদ্যসামগ্রী সঞ্চয় করে না রাখত, তা হলে জনবসতির প্রাচুর্যের জন্য খাদ্যদ্রব্যের এত প্রতুলতা হতো যে তা কোনোপ্রকার বিনিময় ও মূল্য ব্যতীতই মানুষকে বিলিয়ে দিতে হতো।'

পক্ষান্তরে নগরের সুব্যবস্থায় বিলাসসামগ্রীর সুযোগ-সুবিধা লাভের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থা অনুসারে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এর ফলে এ সকল সামগ্রীর মজুদ প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে সম্পূর্ণ অপারগ হয়ে পড়ে। অথচ বহু ব্যক্তিই এগুলো লাভের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ইচ্ছুক ব্যক্তিদের এ ক্ষেত্রে ভিড় জমে যায় এবং স্বচ্ছল ও বিলাসী লোকেরা অন্যদের অপেক্ষা বহুগুণ বেশি মূল্য দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী দুর্মূল্যে সংগ্রহ করতে অপব্যয়ের দ্বারস্থ হয়। আর দুরবস্থায় দৃষ্টি থাকে শুধু মৌলিক প্রয়োজনীয় আহার্য্যসামগ্রীতে।

ইবনে খালদুন শিল্পকর্ম ও শ্রমকে বিলাসিতার সাথে সম্পর্কিত করে জনবসতিপূর্ণ নগরগুলোতে এর মূল্যও বৃদ্ধি হওয়ার কথা বলেন। এবং এর তিনটি কারণ দেখান : প্রথমত জনবসতি অধিক হওয়ায় বিলাসব্যসনের চাহিদা প্রচুর হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয়ত নগরের আহার্য সামগ্রীর প্রাচুর্য কর্মীদের জীবনে সাধারণ সচ্ছলতার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য তারা পরিশ্রম ও কর্মতৎপরতাকে অত্যধিক মূল্যবান মনে করে। তৃতীয়ত আরামপ্রিয় লোকের সংখ্যা অধিক হওয়ায় তারা প্রয়োজনীয় কর্মের জন্য অন্যদেরকে নিয়োগ করতে বাধ্য হয় এবং শিল্পীদের উপর নিজের কর্তব্য ন্যস্ত করতে গর্ববোধ করে। সুতরাং তারা পরস্পর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে শ্রমের যথার্থ মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্য দিয়ে কর্মে নিয়োজিত করে। এর ফলে কর্মী, শিল্পী ও পেশাধারী ব্যক্তিরা নিজেদেরকে মূল্যবান মনে করতে থাকে এবং সেই অনুপাতে তাদের শ্রমের মূল্যও বেড়ে যায়। কাজেই এ সকল ব্যাপারে নগরবাসীদের ব্যয়বাহুল্য ঘটে। অন্যদিকে স্বল্প জনসংখ্যাবিশিষ্ট ক্ষুদ্র শহরে দুরবস্থার দরুণ বিলাসসামগ্রীর মতো শিল্পকর্ম ও শ্রমেরও মূল্য সুলভ হয়ে ওঠে।

ইবনে খালদুনের দ্রব্যমূল্য কমে যাওয়া বা বৃদ্ধি হওয়ার ব্যাখ্যায় চাহিদা-যোগান নীতিই পরিলক্ষিত হয়।

ইবনে খালদুন গ্রামাঞ্চল অপেক্ষা শহরে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য অধিক হওয়ার কারণ হিসেবে শসক কর্তৃক আরোপিত বিভিন্ন শুল্ক, কর, ইত্যাদিকে দায়ী করেন।

ইবনে খালদুন খাদ্যসামগ্রীর অধিক মূল্যবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে দেখান খ্রিস্টানদের আগ্রাসনকে। তিনি বলেন, 'খ্রিস্টানরা মুসলমানদিগকে সমুদ্র তীরবর্তী অনুর্বর, অনাবাদী ও উদ্ভিদের অনুপযোগী ভূমির দিকে ঠেলে দিয়ে তারা নিজেরা উর্বর ও আবাদী অঞ্চলের অধিকারী হয়ে বসায় মুসলমানরা বাধ্য হয়ে তাদের কৃষিকর্মে ভূমি সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করেছে। এ প্রচেষ্টায় তাদেরকে মূল্যবান শ্রম এবং সার ইত্যাদি প্রয়োগ করতে হয়েছে, যা একান্তই ব্যয়সাপেক্ষ। এ কারণে তাদের কৃষিব্যয় আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং তাকে কৃষিপণ্যের মধ্যে যোগ না করে তারা পারেনি। এভাবে যেদিন থেকে সমুদ্র তীরবর্তী মুসলিম অধ্যুষিত ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলগুলোতে খ্রিস্টানরা চাষীদেরকে বিতাড়িত করেছে, তখন থেকেই আন্দালুসের দুর্মূল্য দেখা দিয়েছে। মানুষ যখন ঐ সকল অঞ্চলের পণ্যাদির দুর্মূল্যের কথা শুনে, তারা ধারণা করে যে এর কারণ সেখানকার শস্য ও আহার্যদ্রব্যের স্বল্পতা। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তা নয়। বরং আমরা যত দূর জেনেছি, জনবসতির তুলনায় তাদের মধ্যে বেশির ভাগ লোকই স্থায়ীভাবে কৃষিকাজে নিয়োজিত। তাদের মধ্যে শাসক থেকে শুরু করে সাধারণ লোক পর্যন্ত প্রায় সকলেরই কৃষিভূমি, খামার ও শস্য উৎপাদনের ব্যবস্থা আছে। খুব অল্পসংখ্যক শিল্পকর্মী, শ্রমজীবী, যুদ্ধ ব্যবসায়ী ও ধর্মযোদ্ধারা ছাড়া সকলেই উক্ত কর্মে নিয়োজিত রয়েছে। অথচ তা সত্ত্বেও সুলতান তাদের বেতনাদি প্রদানের ক্ষেত্রে নির্ধারিত মূল্যে শস্য সরবরাহ করছেন। অর্থাৎ কৃষি পণ্য থেকে তাদের আহার্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিচ্ছেন। সুতরাং তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যের দুর্মূল্যের কারণ, আমরা যেমন বর্ণনা করেছি, তাই। অন্যদিকে বারবারদের ভূমি ব্যবস্থা যেহেতু তার সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে উর্বরতা ও উদ্ভিজ্জ উপযোগিতা বিশিষ্ট, সেজন্য তাদের কৃষি উৎপাদনে তার প্রাচুর্য ও সাধারণ সমৃদ্ধির জন্য ব্যয়ের মাত্রা বহুগুণে কম এবং এ কারণেই সেখানে আহার্যসামগ্রীর মূল্য একান্তই সুলভ।' আল্লাহ দিবা-রাত্রি নির্ধারণ করে থাকেন, তিনি একক ও পরাক্রমশালী। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো প্রতিপালক নেই।

গ্রন্থসূত্র
ইবনে খালদুন, আল-মুকাদ্দিমা, গোলাম সামদানী অনূদিত, দিব্যপ্রকাশ বাংলাবাজার ঢাকা, সপ্তম মুদ্রণ ২০২১।

লেখক - গবেষণা বিভাগ, সেন্টার ফর ইসলামীক থট এ্যান্ড এডুকেশন।
nasimuzzamanimran@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us