বিগব্যাং তত্ত্বের ব্যাখ্যা

ডা: মো: তৌহিদ হোসাইন | Sep 08, 2022 04:37 pm
বিগব্যাং তত্ত্বের ব্যাখ্যা

বিগব্যাং তত্ত্বের ব্যাখ্যা - ছবি : সংগ্রহ

 

মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কিত মতবাদগুলোর মধ্যে অন্যতম মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব বা বিগব্যাং তত্ত্ব। মহাবিশ্ব দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য বস্তুর সমন্বয়ে গঠিত। মহাবিশ্ব সৃষ্টি তত্ত্ব বা কসমোলজি বিজ্ঞানের একটি বড় শাখা।

মহাবিশ্ব কী দিয়ে তৈরি
এই মহাবিশ্ব মূলত মৌলিক বস্তু কণা ও মৌলিক বল কণার ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় তৈরি।
মূলত এ মহাবিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা এবং বল কণার ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফল হিসেবে। এ জন্য মহাবিশ্বের সব কণাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। একটিকে বলে ‘ফার্মিয়ন’ যা মূলত মৌলিক বস্তু কণা, অন্যটিকে বলে ‘বোসন’ যা বস্তু কণার ভিতরের মৌলিক বল কণা এবং যা বস্তু কণার ভেতরে শক্তির আদান প্রদান করে। কণা-প্রতিকণা ক্রিয়াশীল হলে নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে শক্তিতে রূপান্তর হয়। শক্তি রূপান্তরিত হয়ে নতুন-প্রতিকণা তৈরি করে। জানা মতে, মৌলিক কণার কোনো অভ্যন্তরীণ গঠন নেই। এরা পরম আদি বা অবিভাজ্য কণা।

মৌলিক বল কণা
বোসন মৌলিক বল কণাও দুই রকম : গেজ বোসন ও হিগস বোসন। গেজ বোসন আবার ছয় রকম : ফোটন, ডব্লিও প্লাস-মাইনাস বোসন, জেড বোসন, গ্লুউন, গ্রাভিটন। এর মধ্যে ফোটন কোয়ার্ক ও ইলেক্ট্রনের মধ্যে, ডব্লিও প্লাস-মাইনাস এবং জেড বোসন দুর্বল নিউক্লীয় বল হিসেবে, গ্লুউন কোয়ার্কের মধ্যকার বল হিসেবে এবং ‘গ্রাভিটন’ মহাকর্ষণ বলের মধ্যে কার্যকর। এই যে মৌলিক বস্তু কণা এবং মৌলিক বল কণা থেকে সৌরজগৎ, নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির উৎপত্তি তা কিন্তু এক দিনে হয়নি। এক সময়ে মহাবিশ্বের অস্তিত্ব ছিল না। হয়তো ছিল অন্য কিছু। কিন্তু মহাবিশ্বের এই পর্যায়ে আসতে লেগে গেছে ১৩৮০ কোটি বছর।


মহাবিশ্ব প্রথমাবস্থায় এক বিন্দুতে ছিল
চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারায় ভরা আজকের সুবিন্যস্ত মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা ঠিক কেমন ছিল? স্টিফেন হকিং, এডুইন হাব্ল প্রমুখ বিজ্ঞানীর গবেষণায় এই সৃষ্টিরহস্যের একটা সর্বজন স্বীকৃত কাঠামো আবিষ্কৃত হয়েছে। মহাবিশ্ব সৃষ্টির মূলে রয়েছে মহাবিস্ফোরণ বা বিগব্যাং। এই অসীম বিপুল বিস্তৃত মহাবিশ্বের জন্ম কিন্তু একটি বিন্দু থেকে। তবে মহাশূন্যের ভেতরে সিঙ্গুলারিটি নয়, সিঙ্গুলারিটির ভিতরেই মহাশূন্যের অবস্থান।

অভ্যন্তরীণ চাপ ও তাপের প্রভাবে ডিম্বাকার বিশ্বের মহাবিস্ফোরণ ঘটে যার নাম বিগব্যাং। এখান থেকেই স্থান, সময়, শক্তি, বস্তু ও বলের উৎপত্তি বলে ধারণা করা হয়।


এক বিন্দু তত্ত্বের (সিংগুলারিটি) ইতিহাস
১৯২৭ সালে বেলজিয়ামের পদার্থবিজ্ঞানী জর্জ লেমাইটর প্রথম বিগব্যাং তত্ত¡ প্রকাশ করেন। এই তত্ত্ব অনুসারে প্রায় ১৫০০ কোটি বছর আগে, মহাবিশ্বের সব বস্তু আন্তঃআকর্ষণে একটি বৃহৎ পরমাণুতে পরিণত হয়। জর্জ লেমাইটর এই পরমাণুটির নাম দিয়েছিলেন আদিম পরমাণু। তিনি ফ্রিডম্যানের সমীকরণ থেকে দেখান যে মহাবিশ্বের যেহেতু সম্প্রসারণ ঘটছে তাই সুদূর অতীতে সব কিছু এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল।

এই পরমাণুটি পরে বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে এডুইন পাওয়েল হাবল এই মতবাদ সমর্থন ও ব্যাখ্যা করেন। তবে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জর্জ গ্যামো।


১৯৪৯ সালের ২৮ মার্চ বিবিসি-র ‘থার্ড প্রোগ্রাম’ নামের একটি অনুষ্ঠানে শ্লেষের সাথে বিজ্ঞানী হয়েল জর্জ লেমাইটারের তত্ত¡কে ‘বিগব্যাং’ আখ্যা দেন। মহাবিস্ফোরণ তত্ত¡ অনুসারে আজ থেকে প্রায় ১৩৮০ কোটি বছর আগে বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে একটি অসীম ঘনত্বের একক বিন্দু থেকে যেখানে সময় ছিল সসীম এবং সেখান থেকেই ক্রমপ্রসারণ শুরু হয় মহাবিশ্বের। অসীম ঘনত্বের এই মহাপরমাণুর ভেতরে বস্তুপুঞ্জের ঘন সন্নিবেশের ফলে এর তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছিল- ১০(৩২) কেলভিন।

বিগব্যাংয়ের পরের ১ সেকেন্ডে যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল, বিজ্ঞানীরা তা কালানুক্রমে কয়েকটি অন্তঃযুগে ভাগ করেছেন। ভাগগুলো হলো-
০ থেকে ১০-৪৩ সেকেন্ড : বিগব্যাংয়ের ০ সেকেন্ড থেকে ১০-৪৩ সেকেন্ড সময়কে প্লাঙ্ক-অন্তঃযুগ বলা হয়। এই সময় প্রাকৃতিক সব বল একীভূত ছিল।


১০-৪৩ থেকে ১০-৩৬ সেকেন্ড : এই সময়ের নাম বৃহৎ একীকরণ অন্তঃযুগ। এই সময় উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ ছিল ১০১৫ গিগা ভোল্ট। আর তাপমাত্রা ছিল ১০ (২৭) কেলভিন। এই সময় অতি বৃহৎ বলের অন্তর্গত সবল নিউক্লিয়ার বল, দুর্বল নিউক্লীয় বল, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল মিলিত হয়ে ইলেক্ট্রো-নিউক্লিয়ার বল সৃষ্টি করেছিল। আর পৃথক বল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল মহাকর্ষীয় বল। এই বলের প্রভাবে মহাবিশ্ব সর্বোচ্চ সঙ্কোচন মাত্রায় পৌঁছেছিল।

১০-৩৬ থেকে ১০-৩২ সেকেন্ড : বিগব্যাংয়ের পরবর্তী সময়কে বলা হয় প্রসারণ অন্তঃযুগ। এই সময়ের মধ্যে তাপমাত্রা নেমে আসে ১০(২৭) থেকে ১০(২২) কেলভিনে। এই সময় মহাবিশ্ব দ্রুত সম্প্রসারিত হতে থাকে।

১০-৩২ থেকে ১০-১২ সেকেন্ড : বিগব্যাংয়ের পরবর্তী এই সময়কে বলা হয় বিদ্যুৎচুম্বকীয়-দুর্বল অন্তঃযুগ। আমরা জানি, প্রকৃতিতে চারটি বল কার্যকর রয়েছে। এগুলো হলো, শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল, ইলেট্রোম্যাগনেটিক বল ও মহাকর্ষণ বল। এই সময় দুর্বল নিউক্লীয় বল ও বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল একত্র হয়ে বিদ্যুৎচুম্বকীয়-দুর্বল বল নামে একটি ইউনিফাইড বল তৈরি হয়েছিল। ফলে সবল নিউক্লিয়ার বল স্বতন্ত্র বল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
১০(-১০) সেকেন্ড পর বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় বল ও দুর্বল বল পৃথক হয়ে যায়।

১০(-১০) থেকে ১০(-৬) কালকে কোয়ার্ক কাল বলে। এই সময়ে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা কয়েক বিলিয়ন কেলভিন নিচে নেমে আসে। চারটি মৌলিক বল যেমন, শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল, ইলেট্রোম্যাগনেটিক বল ও মহাকর্ষণ বল বর্তমান রূপে ফিরে আসে।


১০(-৬) থেকে ১ সেকেন্ড সময়কালকে হ্যাড্রনের কাল হিসেবে বিবেচনা করা হয় যখন তাপমাত্রা ১০(১১) কেলভিনের নিচে নেমে আসে। ফলে কোয়ার্কগুলো একত্র হয়ে হ্যাডরন গঠন করে। হ্যাডরন পর্বের চূড়ান্ত পর্যায়ে ইলেক্ট্রনগুলোর সাথে প্রোটনের সংঘর্ষ ঘটে, ফলে লিউট্রন কণা তৈরি হয়। সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিউট্রিনো নামে আরেকটি কণা নির্গত হয়। একটা সময় মনে করা হতো নিউট্রিনোর কোনো ভর নেই। কিন্তু জাপানি বিজ্ঞানী তাকাকি কাজিতা এবং কানাডীয় পদার্থবিদ আর্থার বি ম্যাকডোনাল্ড নিউট্রনের ভর আবিষ্কার করে যৌথভাবে ২০১৫ সালে নোবেল প্রাইজ লাভ করেন।

১০(-৩) সেকেন্ড সময় কালকে বলা হয় মৌলিক কণা কাল। এই সময়ে ম্যাটার-অ্যান্টিম্যাটার বিক্রিয়ায় পদার্থের বিনাশ হতে থাকে। কিন্তু এই নিউট্রিনোর ভর ইলেক্ট্রনের তুলনায় অতীব নগণ্য। তার পরেও বিজ্ঞানীদের অনুমান, মহাবিশ্বের সব নিউট্রিনোর সম্মিলিত ভর মহাবিশ্বের সব দৃশ্যমান গ্যালাক্সির ভরের সমান।

বিগব্যাংয়ের এক সেকেন্ড পরের ঘটনাগুলো
বিগব্যাংয়ের এক থেকে তিন মিনিট সময়কালকে ল্যাপটনের সময়কাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটা হল হ্যাডরনের কাল শেষে লেপটন যেমন ইলেক্ট্রন ও অ্যান্টিইলেক্ট্রন (যেমন পজিট্রন) মহাবিশ্বে বিস্তার লাভ করে। এবার ইলেক্ট্রন-প্রতি ইলেক্ট্রনের সংঘর্ষের ফলে পরস্পরকে বিনাশ করে তা ফোটন শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়।


বিগব্যাংয়ের তিন থেকে বিশ মিনিট সময়কালকে নিউক্লীয় সংশ্লেষণ কাল বলে। এই সময়ে নিউক্লীয় ফিউশন বিক্রিয়ার ফলে প্রোটন ও নিউট্রন মিলিত হয়ে প্রাথমিক মৌল যেমন হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও লিথিয়ামের নিউক্লিয়াস গঠন করে।

বিগব্যাংয়ের তিন থেকে ২,৪০,০০০ বছর কালকে বিকিরণের বা ফোটনের আধিপত্যের কাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সুদীর্ঘকালে মহাবিশ্ব পারমাণবিক নিউক্লিয়াস এবং ইলেট্রনের প্লাজমার এক গরম অস্বচ্ছ স্যুপে পূর্ণ হয়ে যায়।

২ লাখ ৪০ হজার বছর থেকে ৩০ লাখ বছর পর্যন্ত সময়কালকে পুনঃসংযোগ ও ডিক্যাপ্লিং-এর যুগ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এই সময়ে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমাণু ইলেক্ট্রনকে গ্রাস করে তড়িৎ নিরপেক্ষতা লাভ করে। এ কালের শেষে মহাবিশ্বে প্রায় ৭৫% হাইড্রোজেন, ২৫% হিলিয়ামের সাথে অতি সামান্য পরিমাণ লিথিয়ামের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

বিগব্যাংয়ের পর তিন লাখ বছর থেকে ১৫ কোটি বছর পর্যন্ত সময়কালকে অন্ধকার যুগ বা ডার্ক এজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এই সময় প্রচুর ফোটন কণা ভাসমান থাকলেও আলো দেয়ার মতো কোনো নক্ষত্র সৃষ্টি না হওয়ায় সে সময়টা মহাবিশ্ব অন্ধকারে ঢাকা ছিল। আর এই সময়েই রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার বা অদৃশ্য বস্তু মহাবিশ্বে আধিপত্য বিস্তার লাভ করছিল।

বিগব্যাংয়ের ১৫ কোটি বছর থেকে ১০০ কোটি বছর পর্যন্ত সময়কালকে পুনঃআয়নায়নের যুগ বলা হয়। এই সময়ে প্রথম কোয়াসার বা আধা নক্ষত্র তৈরি হয়। এই সময়ে থেকে মহাবিশ্বের অধিকাংশ নিরপেক্ষতা হারিয়ে আয়নিক প্লাজমা দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়।

বিগব্যাংয়ের ৩০-৫০ কোটি বছরের মধ্যেই মহাকর্ষ বলের প্রভাবে মহাজাগতিক গ্যাস মহাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দানা বাঁধতে শুরু করে। প্রত্যকের মহাকর্ষ বলের প্রভাব তীব্র থেকে তীব্র হতে থাকে। ফলে সঙ্কুচিত হয়ে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যে নিউক্লীয় ফিউশন বিক্রিয়া শুরু হয়। এই ফিউশন বিক্রিয়ার ফলে নক্ষত্রগুলো আলোকোজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

ধারণা করা হয়, আমাদের এই সৌরজগতের উৎপত্তি বিগব্যাং সঙ্ঘটিত হওয়ার ৮৫০ থেকে ৯০০ কোটি বছর পর এবং এখন থেকে ৪৫০-৫০০ কোটি বছর আগে।


মহাবিস্ফোরণের শুরুতে একীভূত ও উত্তপ্ত থাকলেও প্রাথমিক প্রসারণের পরে তা আস্তে আস্তে শীতল হতে থাকে। এই তত্ত¡ অনুসারে মহাবিশ্ব যথেষ্ট শীতল হয় যাতে পরা-পারমাণবিক কণা এবং পরবর্তীকালে সাধারণ পরমাণু তৈরি হতে পারে। এসব প্রাথমিক উপাদানের বিরাটাকায় মেঘ মাধ্যাকর্ষণের মাধ্যমে নক্ষত্র ও ছায়াপথ তৈরি করেছে।

বিগব্যাংয়ের প্রায় তিন লাখ ৭৯ হাজার বছর পরে নিউক্লিয়াসের সাথে ইলেকট্রনগুলো যুক্ত হয়ে পরমাণু গঠিত হয়। এর পরবর্তী কয়েক কোটি বছর ধরে মহাবিশ্বে ছায়াপথ, নক্ষত্র ইত্যাদি সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু এই সময়পর্বেই আধুনিক মহাবিশ্বের কাঠামো তৈরি শুরু হয়েছিল, তাই এই সময়পর্বকে বলা হয় ‘কাঠামো যুগ’। এই পর্যায়ে এসে নক্ষত্র কিংবা গ্রহ থেকে শুরু করে ছায়াপথ, ছায়াপথ ক্লাস্টার, সুপার ক্লাস্টার ইত্যাদি সৃষ্টি হয়।

মহাবিস্ফোরণের প্রমাণ
বিগব্যাং তত্ত¡ প্রকাশের পর বিজ্ঞানীদের চাওয়া ছিল যদি এক বিন্দু থেকে মহাবিস্ফোরণেই এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে নিম্নোক্ত প্রশ্নের কী সমাধান হবে।

প্রথমত, যেকোনো বিস্ফোরণের পর যে স্বাভাবিক সম্প্রসারণ এবং বস্তু পরস্পর দূরে সরে যাওয়ার কথা তার প্রমাণ আছে কিনা।

দ্বিতীয়ত, বিস্ফোরণের পর আলোর যে বিকিরণ হয়েছিল যা কোটি কোটি বছর ধরে ক্রমাগতভাবে চলতে থাকার কথা যাকে বলা হয় ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন, মহাবিশ্বে তার কোনো প্রমাণ আছে কি না।

তৃতীয়ত, বিস্ফোরণের পর ম্যাটার-অ্যান্টিম্যাটারের ক্রিয়া বিক্রিয়ায় এক পর্যায়ে মহাবিশ্ব নিঃশ্বেষ হয়ে যাওয়ার কথা, তা হলো না কেন?

প্রথম প্রশ্নের উত্তর ছায়াপথগুলোর লাল অপসারণ বা রেড শিফটিং দেখে প্রমাণ হয়ে গেছে। ১৯২২ সালে রাশিয়ান মহাকাশবিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান বলেন, এই মহাবিশ্ব আসলে প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং তা প্রসারণশীল অবস্থায় রয়েছে।


১৯২৯ সালে হাবল পর্যবেক্ষণ দ্বারা প্রমাণ পান যে, মহাকাশের গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে ক্রমন্বয়ে নির্দিষ্ট গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু বিস্ফোরণের ফলে যে বিকিরণ সৃষ্টি হওয়ার কথা, তার অস্তিত্ব প্রথম দিকে প্রমাণ করা যায় নাই। ফলে, বিষয়টি নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তখন দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। হাবল আবিষ্কার করেন যে, পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান ছায়াপথগুলো থেকে নিঃসৃত আলোর রেড শিফটিং হচ্ছে এবং এই শিফটিং পৃথিবী থেকে তাদের দূরত্বের সমানুপাতিক। অর্থাৎ একটি ছায়াপথ পৃথিবী থেকে যত দূরে তা থেকে নিঃসৃত আলোর বর্ণালি ততই লাল তথা দীর্ঘ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে দিকে সরে যাচ্ছে। এ ঘটনাটি বর্তমানে হাবলের নীতি নামে পরিচিত।

হাবলের এই সূত্র দেয়ার দুই বছর আগে ১৯২৭ সালে একজন বেলজিয়ান কসমোলজিস্ট, ক্যাথলিক ধর্ম যাজক বিজ্ঞানী জর্জ ল্যামাইটার (১৮৯৪-১৯৬৬) সম্প্রসারণশীল বিশ্বসংক্রান্ত তত্ত্ব দেন যা হাবলের সূত্রের সাথে মিলে যায়। পরে ১৯৩১ সালে তিনি প্রস্তাব করেন যে, প্রসারণশীল বিশ্বকে যদি সময়ের সাথে পিছিয়ে নেয়া যায়, তাহলে আমরা একটা বিন্দুতে উপনীত হতে পারব যেখানে একসময় সব ভর এক বিন্দুতে পুঞ্জীভূত ছিল এবং যেখান থেকে স্থান ও কালের উদ্ভব। এই মিলন বিন্দুকেই বলা হয় সিংগুলারিটি যেখান থেকে বিগব্যাংয়ের সূচনা হয়েছিল।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর মিলেছে কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন আবিষ্কার করে।
বর্তমান মহাবিশ্বের অধিকাংশ স্থানজুড়ে একটি রহস্যময় ধরনের শক্তি বিরাজ করছে। মহাবিশ্বের বিপুল ভর ও শক্তির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী এই শক্তিকে অদৃশ্য শক্তি বলা হয়। বর্তমান মহাবিশ্বের মোট শক্তি ঘনত্বের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ জুড়েই রয়েছে এই অদৃশ্য শক্তি।

১৯৬৫ সালে আরনো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উড্রো উইলসন অনেকটা আকস্মিকভাবেই ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন আবিষ্কার করেন। তারা আমেরিকার নিউজার্সিতে নতুন মাইক্রোওয়েভ এন্টিনা দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন যে একটা অদ্ভুত তরঙ্গ চারদিক থেকে আসছে। তারা বুঝতে পারলেন, এই তরঙ্গ হলো মহাবিস্ফোরণের ফলে আলোর তরঙ্গের প্রবাহের ফলে ধীরে ধীরে লাল পেরিয়ে মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গে পরিণত হওয়ার ফল। এই আবিষ্কার মহাবিস্ফোরণ মতবাদের পক্ষে একটি যুক্তিই হয়ে দাঁড়ায় এবং পেনজিয়াস ও উইলসনকে এনে দেয় নোবেল পুরস্কার ১৯৭৮ সালে।

তৃতীয়ত, আলোক উপাদানগুলোর প্রাচুর্য মহাবিস্ফোরণের প্রমাণ বহন করে। এই প্রাচুর্য মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের পক্ষে একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ। কারণ মহাবিস্ফোরণ ছাড়া অন্য কোনো তত্ত্ব দ্বারা এই প্রাচুর্যের পরিমাণ ব্যাখ্যা করা যায় না।

মহাবিস্ফোরণ সঙ্ঘটিত হওয়ার প্রায় এক বিলিয়ন বছর পর প্রথম ছায়াপথ ও কুয়াশার সৃষ্টি হয়। ছায়াপথগুলোর বয়স ধীরে ধীরে বাড়ছে আর সেই সাথে তাদের মধ্যে ঘটছে নানা বিবর্তন। এ কারণে দূরবর্তী ছায়াপথগুলোকে অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী ছায়াপথের চেয়ে অন্য রকম মনে হয়।
চতুর্থত, ২০১১ সালে বিজ্ঞানীরা মহাশূন্যে আদিম মেঘের সন্ধান পান, যা বিগব্যাংয়ের কয়েক মিনিট পর সৃষ্টি হওয়া সর্বপ্রথম গ্যাস থেকে সৃষ্ট।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস্ অ্যান্ড ইউরোলজি


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us