জেলেনেস্কি কি দাবার ঘুঁটি?

টি এন নাইনান | Sep 25, 2022 07:41 am
জেলেনেস্কি কি দাবার ঘুঁটি?

জেলেনেস্কি কি দাবার ঘুঁটি? - ছবি : সংগ্রহ

 

আমেরিকায় ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির বিষয়ে অনুসন্ধানরত দুই সাংবাদিককে ‘ডিপ থ্রোট’ হিসেবে পরিচিত সূত্র (যত দূর জানা যায়, ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই-এর তৎকালীন অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর মার্ক ফেল্ট ওই ছদ্মনামের পেছনে কাজ করছিলেন) পরামর্শ দিয়েছিলেন, ‘টাকার উৎসকে অনুসন্ধান করো।’ এই মুহূর্তে ইউক্রেনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বুঝতে চাইলেও ওই পরামর্শটির কথাই মনে পড়ছে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের পর থেকে ইতিহাসে বিভিন্ন পতন-অভ্যুদয়ের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বসলেও ‘ডিপ থ্রোট’-এর পরামর্শই বার বার কানে বাজছে। কারণ, যদি কোনও দেশ যদি কিছু গোষ্ঠীপতির (আদতে কয়েকজন ব্যবসায়ী যারা রাজনীতি ও প্রশাসনিক নীতিনির্ধারণের দুই ক্ষেত্রকেই নিয়ন্ত্রণ করেন) হাতে গিয়ে পড়ে, তবে ওই দেশটি স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় ভুগতে শুরু করে বা সোজাভাবে বললে, তার মধ্যে বিভ্রান্তি, বিক্ষিপ্ত ও পরস্পরবিরোধী ভাবনার বহিঃপ্রকাশ দেখা দেয়। জাতিগতভাবে ইউক্রেনীয়দের মধ্যে এবং অংশত রাশিয়াতেও এই অবস্থা দেখা দিয়েছিল। আর তা থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে এক টানাপড়েনও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

কাহিনির সূত্রপাত সম্ভবত ২০০৬ সালের একটি বৈঠকে, যেখানে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইউশেঙ্কো তার প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য কয়েকজন মন্ত্রী এবং ডিমিত্রি ফিরটাশ নামে এক গোষ্ঠীপতির সাথে মিলিত হন। ফিরটাশ ওই সময় দেশের চেম্বার অব কমার্সের প্রধান ছিলেন। সম্প্রতি ফিরটাশ ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’-কে জানিয়েছেন, ওই বৈঠকে পশ্চিমপন্থী ইউশেঙ্কো বলেছিলেন, রাশিয়ার ক্ষমতাশালী হয়ে উঠে বাধা দেয়ার আগেই ইউক্রেনের তরফে ‘ন্যাটো’-তে যোগ দেয়া একান্ত প্রয়োজন। ওদিকে আবার রাশিয়াপন্থী প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ভিন্ন মত ব্যক্ত করে তর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং ক্রুদ্ধ হয়ে বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে যান।

তুর্কমেনিস্তান থেকে ইউক্রেনে গ্যাস নিয়ে এসে বিক্রি করাই ছিল ফিরটাশের প্রধান ব্যবসা। এই কাজে তিনি রাশিয়ার অন্যতম প্রধান শক্তি সরবরাহকারী সংস্থা ‘গ্যাজপ্রোম’-এর পাইপলাইন ব্যবহার করতেন। গ্যাজপ্রোম বহুজাতিক সংস্থা হলেও তার মালিকানার সিংহভাগ ছিল রুশ সরকারের হাতে। ইয়ানুকোভিচের পরে প্রধানমন্ত্রিত্ব ইউলিয়া টিমোশেঙ্কোর হাতে যাওয়ার পর তিনি ফিরটাশের গ্যাস ব্যবসার ইতি ঘটিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন এবং গ্যাজপ্রোম-এর সঙ্গে এক প্রত্যক্ষ বন্দোবস্তে আসেন। এর ফল দাঁড়ায় ভয়াবহ। ইউক্রেনে জ্বালানি গ্যাসের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করে।

টিমোশেঙ্কো পশ্চিম ইউরোপে ২০০৪ সালে ইউক্রেনে সংঘটিত ‘অরেঞ্জ রেভোলিউশন’-এর ‘নায়িকা’ নামে পরিচিত ছিলেন। সেই ‘বিপ্লব’-এ রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাচ্যুত হন। ইউক্রেনের অভ্যন্তরে টিমোশেঙ্কো পরিচিত ছিলেন ‘গ্যাস প্রিন্সেস’ নামে। পুতিনের মতো এক ব্যক্তিত্বের সাথে তিনি বোঝাপড়ায় আসতে সমর্থ হয়েছিলেন, এটিই ছিল তার খ্যাতির প্রধান কারণ। দুই পরস্পর-বিরোধী শিবিরকে নিয়ে তিনি খেলতে জানতেন, খেলায় জয়ী হতেও জানতেন। কেবল ফিরটাশের সাথে তার সম্পর্ক ব্যাপক শত্রুতায় গিয়ে দাঁড়ায়।

২০১০ সালে ‘গ্যাস প্রিন্সেস’ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন। ফিরটাশ তার প্রতিপক্ষের দিকে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এই প্রতিপক্ষকে হারিয়েই এক সময়ে টিমোশেঙ্কো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে পরাজিত করেছিলেন। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’-কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ফেরটিশ জানান, ইয়ানুকোভিচের প্রতি তাঁর সমর্থনের পিছনে রাশিয়া-প্রীতি বা রাশিয়া-বিরোধিতা খুঁজতে চাওয়া ভুল হবে। টিমোশেঙ্কোর সাথে বোঝাপড়াই তার আসল উদ্দেশ্য ছিল। গ্যাস চুক্তির কারণে টিমোশেঙ্কোর কারাদণ্ড হয়। দেশের ভিতরে এবং দেশের বাইরে অনেকেই ঘটনাটিকে রাজনৈতিক আলোকে দেখেছিলেন। অনেকটা যেভাবে ভারতের ‘এজেন্সিগুলো’ নিলামদারি পরিচালনা করে, সে ভাবেই।

ইউক্রেনের অসংখ্য গোষ্ঠীপতির মধ্যে ফিরটিশ একটি উদাহরণ মাত্র। তার থেকে অনেক বড় মাপের খিলাড়ি হলেন রিন্যাট আখমেটভ। যিনি কার্যত দনবাসের শাসনভার পরিচালনা করেন। দনবাস ইউক্রেনের ভারী শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। পুতিনের নজর অনেক দিন ধরেই দনবাসের দিকে। এই দুই গোষ্ঠীপতি ইয়ানুকোভিচের দলের পার্লামেন্ট সদস্যদের অর্ধাংশকে এবং সেই সাথে মন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টিকেও নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন বলে শোনা যায়। এদের দু'জনেরই আর্থিক উন্নতি ঘটে উল্লেখযোগ্যভাবে। জার্মানির সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘স্পিগেল’ এদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে ‘যৌথ বাণিজ্যোদ্যোগ’ বলে বর্ণনা করে। ধুরন্ধর খিলাড়ি হওয়া সত্ত্বেও ২০১৪ সালের মাইডান বিপ্লবের (‘রেভোলিউশন অব ডিগনিটি’ হিসেবেও পরিচিত) প্রাক্কালে তারা তাদের রাজনৈতিক ঘুঁটি সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফিরটাশ ‘গ্যাস প্রিন্সেস’-এর ক্ষমতায় ফেরার ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিলেন। ঘটনার গতি বদলালে ইয়ানুকোভিচকে পালিয়ে গিয়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিতে হয়। ক্রুদ্ধ পুতিন ক্রিমিয়া দখল করেন এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের দনবাসে ফিরিয়ে আনেন।

এই সময় রঙ্গমঞ্চে তৃতীয় গোষ্ঠীপতির প্রবেশ ঘটে। ইগর কোলোমোইস্কি। ১৯৯০-এর দশকে হেনাডিই বোহোল্যুবভ নামের এক চতুর্থ গোষ্ঠীপতির সাথে তিনি গাঁটছড়া বেঁধে ব্যাংকিং ব্যবসায় নেমেছিলেন। তাদের ব্যাংকটিই পরে ইউক্রেনের বৃহত্তম ব্যাংকে পরিণত হয়। ঘটনা পরম্পরায় কোলোমোইস্কি নতুন প্রসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কোর বিষনজরে পড়ে যান। পোরোশেঙ্কো নিজেও একজন গোষ্ঠীপতি। তিনি আবার ‘চকোলেট কিং’ নামে পরিচিত ছিলেন। কোলোমোইস্কি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। অর্থ তছরুপের কারণে তার ব্যাংকের ২০১৬ সালে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ ঘটে।

কিন্তু ২০১৯ নাগাদ যখন নির্বাচনের সময় উপস্থিত, কোলোমোইস্কি ফিরে আসেন এবং আবার রাজনীতির খেলায় যোগ দেন। তার টেলিভিশন চ্যানেল পোরোশেঙ্কোর প্রতিদ্বন্দ্বী, পেশায় কৌতুকশিল্পী ভোলোদিমির জেলেনেস্কির হয়ে প্রচার শুরু করে। জেলেনেস্কি এই মুহূর্তে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সংবাদ শিরোনামে। দুর্নীতি দূরীকরণকে হাতিয়ার করে জেলেনেস্কি তার নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছিলেন এবং বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও ইউক্রেনের এই ইতিহাসের ধারায় এক লাগসই ব্যক্তিত্ব। প্রথমত, ২০২১-এ ‘প্যান্ডোরা পেপারস’ থেকে জানা গিয়েছিল প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর অন্তরঙ্গ সম্প্রদায় সাগরপারের বেশ কিছু বাণিজ্য সংস্থার নেটওয়ার্ক থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত। দ্বিতীয়ত, জেলেনেস্কি তার প্রাক্তন পৃষ্ঠপোষকের থেকে নেকনজর সরিয়ে নেন এবং দু’মাস আগে তার নাগরিকত্ব বাতিল করেন।

উপরের এই কাহিনি থেকে এ কথাই স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায় যে ইউক্রেন সেই সব দেশের কাছে এক গুরুতর ভয়ের উদাহরণ, যেখানে গোষ্ঠীপতিরা ক্ষমতা নিয়ে খেলে চলেছেন। কিভ-এ তারা বিপুল সম্পদ জমিয়েছেন, একই সাথে তারা তাদের গণমাধ্যম সাম্রাজ্যকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক পদপ্রার্থীদের কখনো তুলেছেন, কখনো ফেলেছেন। কার মনোনীত লোক মন্ত্রিত্ব পাবে, তারাই ঠিক করে দিয়েছেন, কারা কেমন দামে গ্যাস সরবরাহ করবে- তা-ও তারাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কোন রাজনৈতিক দল মাথা চাড়া দেবে এবং ক্ষমতা কায়েম করবে আর কোন দল পুতিনের থাবার নিচে বশংবদ হয়ে থাকবে, সেসবও তারাই ঠিক করে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে, যুদ্ধের আগে ইউক্রেনের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) তার ১৫ বছর আগেকার অবস্থান থেকে একচুলও নড়েনি। এসব গোষ্ঠীপতিরা যখন টানাপড়েনের খেলায় মত্ত থেকেছেন, তাদের দেশ ইউরোপের একদা-সোভিয়েত থেকে বেরিয়ে আসা রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দরিদ্রতম হয়ে থেকে গিয়েছে। এই মুহূর্তে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে শরণার্থী। ইউক্রেনের উপর এখন সীমাহীন অনিশ্চয়তার অন্ধকার, যেখানে যেকোনো মুহূর্তে ঝলসে উঠতে পারে পারমাণবিক অস্ত্রের বিধ্বংসী আলো।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us