হ্যালোইনের স্মৃতিচারণ

রহমান মৃধা | Oct 22, 2022 03:01 pm
হ্যালোইনের স্মৃতিচারণ

হ্যালোইনের স্মৃতিচারণ - ছবি : সংগ্রহ

 

মরতে তো একদিন হবেই। এই চিরন্তন সত্যকথন সবাই জানে। মৃত্যুতে কি মজা, না কি সাজা? তা শুধু সেই জেনেছে যে মরেছে। তবে সহজ ও সরল ভাষাতে কাগজের পাতায় লিখে গেছেন শরৎচন্দ্র তার শ্রীকান্ত উপন্যাসে- ‘মরতে তো একদিন হবেই’। এ এক চিরন্তন সত্য কথা এবং যা ঘটতে পারে যেকোনো সময়। তার পরও থেমে নেই জীবন। জীবন চলমান, ভালো মন্দের এক মিশ্র প্রতিক্রিয়াই চলছে মানবজীবন। জন্ম-মৃত্যুর মাঝখানে রয়েছে সময়। এই সময়ের মধ্যে চলছে সংগ্রাম, বেঁচে থাকার সংগ্রাম। এই সময়ে আপন হচ্ছে পর, পর হচ্ছে আপন, ধনী হচ্ছে গরিব, গরিব হচ্ছে বড়লোক। রাত হচ্ছে দিন, দিন হচ্ছে রাত।

মরার পর কী হচ্ছে? তা জানি না, তবে ধর্মীয় মতে নানা ধর্মে নানা বিশ্লেষণ রয়েছে। আজ কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করব, আমার জীবনে ঘটে যাওয়া সময়ের উপর। এমন একটি সময় অক্টোবরের শেষের দিন এবং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের উইকেন্ডে, এখানকার বেশির ভাগ কাজকর্ম বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে। তাই প্রায় সবাই ডর্মিটরি ছেড়ে কেউ বাড়িতে, কেউ ছুটিতে। বন্ধু-বান্ধবীরা বলেছে, কেন এই ছুটি এবং কিসের জন্য ছুটি? অক্টোবরের শেষের দিন এবং নভেম্বরের প্রথম উইকেন্ড ধর্মীয়ভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই উইকেন্ডে এরা সেজেগুজে ফুলের তোড়া সাথে মোমবাতি নিয়ে ‘সির্কগোর্ডেন’ বা কবরস্থানে যেয়ে মৃত ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া- প্রার্থনা করে থাকে। এটা এই সময়ের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান যা এদের ভাষাতে বলা হয় ‘আল হেলগোন’ বাংলায় বলা যেতে পারে সপ্তাহের বা উইকেন্ডের পবিত্রদিন। একই সাথে অ্যামেরিকাতে এবং আরো কিছু দেশে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে, যাকে বলা হয় ‘হ্যালোইন উইকেন্ড’।

হ্যালোইন উৎসব পালণ সর্বপ্রথম আয়ারল্যান্ড থেকে শুরু হয়, পরে ১৮০০ সালে আইরিশ জাতি জীবনের সুখের সন্ধানে পাড়ি জমাতে শুরু করে আমেরিকাতে। আইরিশদের আমেরিকা আগমনে এরা নিয়ে আসে এদের ঐতিহ্য- যাকে বলা হয় ‘হ্যালোইন’। হ্যালোইন বড় আকারে এবং ট্রাডিশনালি পালন হয়ে আসছে আমেরিকাতে তখন থেকে।
তখনকার সময়ে আইরিশদের ধারণা ছিল, মৃত ব্যক্তিরা পৃথিবীতে ফিরে আসে এই উইকেন্ডে, এক বিস্ময়কর ও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, যার কারণে হ্যালোইনের পোশাক -আশাকেরও এক ভিন্ন রূপ- যা আমাদের ভাষাতে অনেকটা ভূত-প্রেত্নির রুপে সেজে দিব্বি এক ভয়ানক দৃশ্যের সৃষ্টি করে নিজেদেরকে, যা দেখলে ভয় না পাবার কোনো কারণ নেই, যদি কেউ বিষয়টি সম্পর্কে না জানে। একই সময় এবং একই ধর্মে বিশ্বাসী মানবজাতি এই ধর্মীয় উৎসবকে ভিন্নভাবে পালন করে চলেছে, শুধু পার্থক্য এদের বসবাস ভিন্নদেশে। বহু বছর হতে চলছে দেখা যাচ্ছে যে সুইডেনেও এই আমেরিকান হ্যালোইন একই উইকেন্ডে পালন হচ্ছে। সাধারণত শুক্রবার রাতে হ্যালোইন উৎসব পালন করা হয় এবং শনিবারে আল হেলগোন পালন করা হয়ে থাকে। ছোট বাচ্চারা ভূত-প্রেত্নির রূপে সেজে বেশ আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে এই উইকেন্ড পালন করে। মিষ্টি কুমড়া নানাভাবে ডেকোরেট করা হয় এবং এই মিষ্টি কুমড়ার ওপর খাবারের বিশেষ আইটেম তৈরি করা হয় এই দিনে। মৃত ব্যক্তিকে স্মরণ করা হয় ঠিকই, তবে ধরণ এবং কারণটি কিছুটা ভিন্ন। এই উইকেন্ডের একই উদ্দেশ্য তবে পালন করা হয় ভিন্ন রকমে।

প্রশ্ন— তাহলে কি মৃত্যুর পর ভালো কর্মের ফলে কেউ হবে এঞ্জেল, খারাপ কর্মে কেউ হবে ভূত-প্রেত্নী, তাই কি এমনটি করে পালন করা? যাই হোক না কেন, এত বছর ধরে বিষয়টি লক্ষণীয় সত্ত্বেও এমনটি করে ভেবে দেখিনি এর আগে যা আজ লিখতে বসেছি। কারণ একটাই। ১৯৮৫ সালের ৩১ অক্টোবর মাস ভীষণ ঠান্ডা বাইরে। খুব অন্ধকার। আশে পাশে তেমন কেউ নেই, বেশ একাকী। আবহাওয়া খুবই জঘন্য বলতে হয়, ঠান্ডা বাতাস, তুষার বৃষ্টি আকারে পড়ছে, সব মিলে যাকে বলে ন্যাস্টি ওয়েদার, বিশেষ করে সুইডেনে। অন্ধকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মিটরিতে আমি একা। বন্ধু-বান্ধবী কেউ সেখানে নেই। উইকেন্ড, তাই সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেছে। ডর্মিটরিতে শুধু আমি একা।
হঠাৎ দরজার বেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই সামনে তাকিয়ে দেখি দুই প্রেত্নির চেহারা। প্রেত্নী কি? শুধু কল্পনাতে বাংলাদেশে থাকতে শুনেছি- অনেকের থেকে যে চেহারাই এক কুৎসিত ভয়ংকর রূপ। চোখে দেখিনি শুধু শুনেছি। ভূত দেখতে কেমন তাও তো জানিনে? মানুষের আকৃতির এক কুৎসিত চেহারার সমন্বয়। হঠাৎ এই অন্ধকার রাতে আমার রুমের সামনে কেনো বা কিসের জন্য দুই প্রেত্নির চেহারাযুক্ত জীবের আবির্ভাব? গা অবশ হয়ে গেছে দেখা মাত্রই। সুইডেনে ভূত? বাংলাদেশে এর নাম শুনেছি, চোখে দেখিনি। আজ সরাসরি ভূতের দেখা, তাও দরজার সামনে? দরজা খুলতেই নিচে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। কিছুক্ষণের জন্য মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণও করেছি মনে হচ্ছে, তবে কিছুই মনে নেই। আমি তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি, মরে গেছি। হঠাৎ হুঁশ হতেই স্মৃতি চারণের সাথে সাথে উপলব্ধি করতে শুরু করছি, দুই সুন্দরী রমণী আমার বিছানাতে এবং আমার জ্ঞান ফেরাতে মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস দিতে চেষ্টা করছে।

ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বেশ এক মধুময় আবেগের সৃষ্টির সাথে আমি আমাকে ফিরে পেতেই চোখ মেলে দেখি দুই রমণী, সাথে চলছে রমণীদের চুম্বনের ঢেউ। জ্ঞান ফিরছে এবং ভালোই লাগছে। একই সাথে নড়াচড়া করতে ভয় হচ্ছে, ভূত-প্রেত্নির ব্যাপার কখন কি করে? হঠাৎ তাদের কথা শুনতে পারছি। পরিচিত নাম। আমারই ডর্মিটরির দুই বান্ধবী, ছারা আর সুজান, কী ব্যাপার? চোখের পাতা তুলতেই তো তারা মহাখুশি। এদিকে এ্যাম্বুলেন্স এসে পড়েছে। বান্ধবীরা আমাকে হ্যালোইনের পার্টিতে সারপ্রাইজ দিতে যে প্লান করেছিল তা পুরোপুরি সার্থক না হলেও আংশিক পূর্ণ হয়েছিল ঠিকই। তবে ভয় তারাও পেয়েছিল সেদিন, কারণ তারা মনে করেছিল আমি হার্টফেল করেছি। সেদিন সেই রাতের আদর-যত্ন ছিল ক্ষণিকের এক ব্যস্ত সময়। তাদের মুখে আর মুখোশ নেই, শরীরের কালো কাপড় ছেড়ে স্বাভাবিক পোশাকে আমার পাশে দুই সুন্দরী বান্ধবীর সব গল্প এবং ঘটনা শুনতে শুনতে কখন রাত যে সকালে পরিণত হয়েছিল জানিনে, তবে সেদিন প্রথম জেনেছিলাম হ্যালোইন দিনটির কথা। দিনের মূল উদ্যেশ্য নানা ভাবে সেজে-গুঁজে একে ওপরকে ভয় দিতে চেষ্টা করা।

ভালো ভয় পেয়েছিলাম সেদিন। ঘটনা ঘটেছিল সুইডেনের জীবনের শুরুতে, ডর্মিটরির দুই সুইডিস বান্ধবীর সমন্বয়ে। আজ মনে পড়ে গেলো সেদিনের সেই মেমোরি। সামনে সুইডেনে হ্যালোইন সাথে আল হেলগোনের দিন। এমন দিনে পৃথিবীর মানবজাতি এক ভালোবাসার সমন্বয়, অন্য, বস্ত্র, ভাষা, কালচার, ধর্ম, বর্ণ, ক্লাইমেট ও নেচারের পরিবর্তনের সত্বেও সুন্দর ভাবে একত্রে বসবাস করছি with mutual respect, understanding, tolerance and love - এর চেয়ে সুন্দর পরিবেশ আর কি হতে পারে।

লেখক : সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
rahman.mridha@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us