ডিভোর্সি তাই শিখ পুরুষেরা আমাকে চায় না

মেহেদী হাসান | Jun 19, 2019 03:01 pm

-

 

পূর্ব লন্ডনের একটি শিখ মন্দিরে এক লোকের সাথে একদিন পরিচয় মিনরিত কাউরের। এরপর তার সাথে বিয়ে। মিনরিতের বয়স তখন ২৭। কিন্তু এ বিয়ে তার জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে। এক বছরের মধ্যে তাকে ফিরে আসতে হয় বাবার ঘরে। গত ১০ বছর ধরে তিনি চেষ্টা করেন আরেক পুরুষকে বিয়ে করতে। কিন্তু তিনি জীবনে যে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তা হলো- বেশির ভাগ শিখ পুরুষ কোনো ডিভোর্সিকে বিয়ে করতে চায় না।

ডিভোর্সের আগে স্বামী আমাকে প্রায়ই চেচিয়ে বলত- আমাকে ডির্ভোস দিলে তুমি আর বিয়ে করতে পারবে না। সে এটি আমাকে বলত আঘাত করতে। কিন্তু সে জানত আমি সত্যিই তাকে তালাক দিতে পারি এবং আমি তা-ই করেছি শেষ পর্যন্ত।
শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে তালাক একটি গ্লানিকর বিষয়। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে। শুরুতে আমি নিজেই লজ্জিত ছিলাম। আমি নিজেকে নোংরা আর ব্যবহৃত মনে করতাম। কেমন করে আমি আরেক পুরুষের দিকে তাকাতে পারি যখন আমি জানতাম যে, সে আমাকে ব্যবহৃত পণ্যের মতো মনে করবে?

অন্যরা এ ধরনের চিন্তাকে আরো প্রবল করেছে আমার মধ্যে। লন্ডনে আমার দাদি বলতেন, বিয়ে নিয়ে আমার চেষ্টা করা উচিত ছিল। যদিও তিনি জানতেন আমার অবস্থা। ভারতে আমার বাবার পরিবার বলত আমি ফিরে আসায় তারা হতাশ। আমি তাদের জন্য অশুভ। আমার মা-বাবা শতভাগ আমার পক্ষে, কিন্তু আমার মনে হতো আমি তাদের হেয় করেছি।

প্রায় পাঁচ বছর ধরে আমি বাইরে যেতাম না বলা চলে। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে আমি আরেক স্বামী খোঁজার চেষ্টা শুরু করলাম। যখন আমি লোকজনকে বলতাম আমার জন্য একজন উপযুক্ত বর দেখো, তখন তারা খুশি হয়ে বলত, আমাকে তারা সাহায্য করবে। এরপর তারা আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করত। আমার বয়স কত। আমি কোথায় থাকি। কোথায় কাজ করি। কিন্তু যখনই আমি বলতাম আমি ডিভোর্সি তখনই তাদের মুখের চেহারা অন্ধকার হয়ে যেত। সে চেহারা বলে দিত- আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারছি না। এরপর তারা বলত পরে তোমাকে জানাচ্ছি।

আমার বিয়ের আয়োজন প্রায় হয়ে গিয়েছিল। লোকজন বলতে থাকল আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। তারা বিয়ের জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। তাই সাউথহল মন্দিরে হাজির হয়ে আমি জানালাম আমাকে কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য।
তালাকের পর আমি যখন নতুন আরেকজন স্বামী খোঁজা শুরু করলাম, তখন আমি হাউন্সলো মন্দিরে গিয়েছিলাম তাদের বিয়ে সংক্রান্ত বইয়ে আমার নাম তালিকাভুক্ত করাতে। আমাকে জানানো হলো তারা আমাকে শুধু শিখদের সাথেই পরিচয় করিয়ে দেবে। যদিও আমার কাছে জাত খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু আসলে আমি যেটা জানতাম না তা হলো তারা আমাকে শুধু তালাকপ্রাপ্ত শিখ পুরুষদের সাথেই পরিচয় করিয়ে দেবে, যেহেতু আমি তালাকপ্রাপ্তা।

ফর্ম পূরণের সময় স্বেচ্ছাসেবক আমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর জানাল, এখানে দু’জন তালাকপ্রাপ্ত লোক আছে। আমি কেবল তাদেরই উপযুক্ত।
কিন্তু এই দুই মন্দিরে আমি দেখেছি, বিবাহিত পুরুষদের সাথে অনেক অবিবাহিত মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ডিভোর্সি মেয়েদের কেন অবিবাহিত পুরুষদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাবে না? মনে হচ্ছে তালাকের জন্য ছেলেরা কখনো দায়ী নয়, দায়ী শুধু মেয়েরা।

হাউন্সলো মন্দিরের বিয়ে সংক্রান্ত দায়িত্বে থাকা গ্রিওয়ালকে আমি বিষয়টি জিজ্ঞাসা করায় তিনি আমাকে বললেন, এটি তার বিষয় নয়। এটি হলো যিনি বিয়ে করছেন তার এবং তাদের মা-বাবার বিষয়। তারা কেউ ই ডিভোর্সিদের পাত্রী হিসেবে পছন্দ করেন না।
তিনি আরো বললেন, ‘তারা ডিভোর্সিদের গ্রহণ করেন না, আমরা যদি শিখ ধর্মে বিশ্বাসী হই, তাহলে শিখদের মধ্যে এটি হওয়া উচিত নয়।’

কিন্তু অন্যরা যেমন তালাক দেয়, তেমনি শিখরাও মাঝে মধ্যে তালাক দেয়। ২০১৮ সালের বিট্রিশ শিখ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- শতকরা ৪টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে এবং শতকরা একজন আলাদা বসবাস করছে। যারা তালাকের কথা স্বীকার করেছে তারা হয়তো আবার বিয়ে করেছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত তাদের অনেকে ফরম পূরণের সময় ‘সিঙ্গেল; বা ‘অবিবাহিত’ বা ঘরে টিক চিহ্ন দেবে যদিও তারা তালাকপ্রাপ্তা। এটি এমনই এক নিষিদ্ধ বিষয়।

তালাক যেমন অহরহ ঘটছে তাই এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গিও খুব সম্ভবত বদলাবে। তরুণারা আমাকে বলেছে এটা আসলে বড় বিষয় নয় তাদের জন্য। কিন্তু আমার প্রজন্মের এমনকি যাদের নিজেদের ঘরেই তালাকপ্রাপ্তা বোন বা কন্যা রয়েছে তারাও বাইরের পরিবারের একজন তালাকপ্রাপ্তা নারী সম্পর্কে নানা ধরনের বাছবিচার করবে। যেমন আমাকে বলে সন্তান ধরনের জন্য তোমার বয়স অনেক বেশি হয়ে গেছে। এখন তোমার জন্য নতুন স্বামী পাওয়া কঠিন হবে। তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছ। তোমার এখন যে কোনো একজনকে বিয়ে করে ফেলা উচিত।
কিন্তু আমি মনে করি ৩৮ বছর বয়স সন্তান নেয়ার জন্য বেশি দেরি নয়। এটি আরেকটি পূর্ব ধারণা। অনেক সময় কেউ কেউ আমাকে বলেছেন : ‘মিন, লন্ডনে এখন তোমার বিয়ের জন্য কারো সাক্ষাৎ পাওয়া খুব কঠিন। ভালো হয় তুমি ভারতে গিয়ে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করো।’

আমার মা তার এক বন্ধুর ছেলেকে বলেছিল আমার জন্য পাত্র দেখতে। সে বলেছে, আমি হলাম একটি ‘খামছানো গাড়ি’।
আমি জানি আমি আমার জন্য বিষয়টি কঠিন করে ফেলেছি। কারণ আমি শুধু একজন শিখ পুরুষ খুঁজিনি বরং পাগড়ি পরিহিত শিখ খুঁজছিলাম। হাউন্সলোতে ২২ হাজার শিখ রয়েছে। তার মধ্যে ১১ হাজার পুরুষ। তার মধ্যে খুব কমসংখ্যক হবে উপযুক্ত বয়সের এবং অবিবাহিত। তাদের মধ্যে অনেকে পাগড়ি পড়ে না।

পাগড়ি আমার কাছে গুরুত্বপূণ। বিশ্বাস আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ-শিখ বিশ্বাস যেখানে বলা হয়েছে নারী-পুরুষ সমান এবং আমাদের একে অপরের বিচার করা উচিত নয়।
আমি এমন কারো সাথে দেখা করতে চাই না যারা শুধু মজা করার জন্য আসবে, কিন্তু কোনো ফায়সালায় আসবে না। আবার আমি এমন কারো সাথেও দেখা করতে চাই না যারা ঘরে একজন পাহারাদার চায় স্ত্রী নয়। প্রথম দেখাতেই প্রশ্ন করবে তুমি কি রান্না জানো? আমি একজন স্বাধীন মানুষ এবং বন্ধুত্বের জন্য একজন সঙ্গী চাই।
গত মাসে আমি আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে একজনের সাথে পরিচিত হই। এটি ছিল পরিচিত গল্প। সে জানাল সে ডিভোর্সিদের বিষয়ে আগ্রহী নয়। তার বয়স ৪০ কিন্তু সে আনকোড়া মেয়ে চায়।

গত ১০ বছরে প্রায় ৪০ জন বিভিন্ন পুরুষের সাথে বিয়ের জন্য দেখা সাক্ষাত হয়েছে। কিন্তু কেবল গত কয়েক মাস ধরে আমি ভাবতে শুরু করেছি আমাকে পাগড়ি পরিহিত শিখদের চিন্তা বাদ দিতে হবে। এমনকি শিখদের চিন্তাও বাদ দিতে হবে। আমার কয়েকজন বন্ধু ইতোমধ্যে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে।
বিবিসি অবলম্বনে

 

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us