নায়াগ্রা ফলসে

শাহীন চৌধুরী ডলি | Oct 26, 2019 04:27 pm
নায়াগ্রা ফলসে

নায়াগ্রা ফলসে - নায়াগ্রা ফলসে

 

বেড়াতে যাওয়ার নেশা থেকেই গত বছরের অক্টোবরে কানাডা যাওয়ার ভ্রমণ ভিসা নিয়েছিলাম। অনেকের কাছেই কানাডা স্বপ্নের দেশ, আমার কাছেও।
চলতি বছরের ২২ জুলাই পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কানাডা গিয়ে হাজির হলাম। কানাডার কথা এলেই সবার আগে নায়াগ্রা ফলসের কথাই মনে আসে।

জীবনের অনেক বড় বড় ফলস বা জলপ্রপাত দেখার সুযোগ হয়েছে। মনে ইচ্ছে ছিল যদি কোনো দিন সুযোগ আসে নায়াগ্রা ও ভিক্টোরিয়া ফলস দেখতে যাবো। ২৭ মে পরিবারের সদস্যদের সাথে নায়াগ্রা ফলস বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ এসে গেল। শাহানা আপু, রুমা, রুমার বর সাদ এবং আমি টরেন্টোর বাসা থেকে নায়াগ্রার উদ্দেশে সাদের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাদ নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিল। বাই রোডে টরেন্টো শহর থেকে নায়াগ্রা ফলসে যেতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় লাগে।

নর্থ ইয়র্কের ইমপ্রেস এভিনিউ থেকে যখন আমরা রওয়ানা হলাম ঘড়িতে তখন স্থানীয় সময় সকাল ১০টা বাজে। পুরো কানাডা দেশটাই ছবির মতন সাজানো এবং সবুজে সবুজময়। যেতে যেতে যতই দেখি মুগ্ধতা ততই বাড়তে থাকে। মহাসড়ক ধরে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি নায়াগ্রার দিকে। মিসিসাগা পার হয়ে বার্মিংটন, তারপর হ্যামিল্টন শহরে এসে মহাসড়কের পাশে একটা কফি শপে সাদ গাড়ি পার্ক করল। আমরা সবাই বিখ্যাত টিম হরটনের কফি এবং কিছু স্ন্যাকস খেয়ে আরো চাঙ্গা হয়ে নিলাম। কুইন এলিজাবেথ হাইওয়ে ধরে গাড়ি আবার ছুটছে টরেন্টো শহর থেকে ১২৮ কিলোমিটার দূরের নায়াগ্রাতে। পথিমধ্যে কিছু সুন্দর সুন্দর ট্যুরিস্ট স্পট আমরা এই সুযোগে দেখে নিলাম।

নায়াগ্রা ফলস যত কাছে এগিয়ে আসছে আমি তত আনন্দে উত্তেজিত হয়ে উঠছি। দূর থেকে নায়াগ্রা নদীর অপর পাড়ে আমেরিকার নিউ ইয়র্কের সুউচ্চ দালানগুলো দেখে আফসোসে পুড়তে লাগলাম, কেন আসার আগে আমেরিকার ভিসা নিয়ে এলাম না। মাত্র কয়েক মিনিটেই নায়াগ্রা থেকে আমেরিকায় চলে যেতে পারতাম। কত বন্ধু, আত্মীয় পরিজন আছে আমেরিকায় যাদের সাথে দীর্ঘ দিন দেখা হয় না। নিউ ইয়র্কে তো অনেক অনেক কাছের মানুষ আছে। আফসোস করে লাভ নেই। সাদ ও রুমার কাছ থেকে নায়াগ্রা ফলসের দুই পাড় কানাডা এবং আমেরিকার স্থাপনাগুলোর নাম শুনতে শুনতে গাড়ির পার্কিং এরিয়ায় চলে এলাম। ফি দিয়ে গাড়ি পার্কিং করে আমরা একটা বিশাল ওক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছি। এখান থেকে ছোট ছোট কিছু গাড়িতে চড়ে বিনা ভাড়ায় নায়াগ্রা ফলসের খুব কাছে আসা যায়। হেঁটে হেঁটে অপূর্ব সুন্দর সব দৃশ্য দেখতে দেখতে আসায় স্বাগত জানালো মধ্য দুপুরের দৃপ্ত রোদ। জুলাই মাস কানাডায় গ্রীষ্মকাল। চারদিক আলো করে আছে আকাশের সীমানায় আসীন সূর্য মামা। রোদের তাপ যেমন আছে, ছায়া দেয়ার জন্য আছে প্রচুর ছোট-বড় গাছ, উদ্যান, উদ্যানে পেতে রাখা বিশ্রামের জন্য চেয়ার।

ফুলের বাগান, আপেল, নাশপাতি, চেরি ফল, পাম ফলের গাছ। অনেকেই পরিবারসমেত রান্নাবান্না করে, সাথে চাদর বা ফোল্ডিং করা চেয়ার-টেবিল নিয়ে এসে উদ্যানে গাছের ছায়ায় গল্পে এবং খাওয়া-দাওয়ায় মেতে আছে। শিশুরা মহানন্দে খেলছে। অনেকেই শনিবার ও রোববার কানাডার ছুটির দিনগুলোতে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের নিয়ে ভ্রমণে বের হন যা দেখতে খুব ভালো লাগে।

আমরা নায়াগ্রা ফলসের দিকে যখন এগিয়ে আসছি তখন ফলসের পানির ঝাপটা আমাদের যেন স্বাগত জানাল। আমরা প্রথমে ওয়েলকাম সেন্টারে ঢুকলাম। চারদিকে খাবারের দোকান কিন্তু মূল্য আকাশছোঁয়া। আবার টিম হরটনের কফির সাথে চিকেন বার্গার দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ সারলাম। ওয়েলকাম সেন্টারের গেট থেকে বের হতেই দেখতে পেলাম গর্জে ওঠা নায়াগ্রা ফলসের অ্যাডভেঞ্চারস সৌন্দর্য। জনমত আছে, নায়াগ্রা নদীটি প্রায় এক হাজার ২০০ বছরের পুরনো। আমরা একদম নায়াগ্রা ফলসের পাশ ঘেরা দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে জগতের অপার বিস্ময়কর সৌন্দর্য দেখছি। পৃথিবীতে যা কিছু দেখে আমাদের বিস্ময় জাগে নায়াগ্রা ফলস তার মধ্য অন্যতম মহাবিস্ময় নিঃসন্দেহে। বিশ্বাসই হতে চাইছে না বাংলাদেশ থেকে ২০ হাজার কিলোমিটার দূরে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নায়াগ্রা ফলস ইউএসএর নিউ ইয়র্ক এবং উত্তর আমেরিকার কানাডার অন্টারিও প্রদেশের মধ্যবর্তী আন্তর্জাতিক সীমানার ওপরে অবস্থিত। অনগুইয়াহরা শব্দ থেকে নায়াগ্রা শব্দটির উৎপত্তি। নায়াগ্রা শব্দের অর্থ জলরাশির বজ্রধ্বনি। অনুমান করা হয় আজ থেকে প্রায় ১০ হাজার ৯০০ বছর আগে এই ফলস প্রথম চিহ্নিত করা হয়েছিল।

নায়াগ্রা ফলসের তিন ভাগের এক ভাগ আমেরিকার এবং বাকি দুই ভাগ পড়েছে কানাডার অংশে। উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী এই জলপ্রপাতকে আমেরিকায় বলা হয় আমেরিকান ফলস এবং কানাডার অংশকে বলা হয় কানাডিয়ান ফলস। তিনটি জলপ্রপাতের সমষ্টিতে এই বৃহৎ জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে বড় ফলসটি হর্সগু ফলস বা কানাডা ফলস ১৬৭ ফুট উঁচু থেকে দুই হাজার ৬০০ ফুট প্রশস্ত পানির স্রোত নিয়ে নিচে আছড়ে পড়ে। নায়াগ্রা ফলসের ৭০ শতাংশ পানি এই ফলস দিয়ে পতিত হয়। বাকি ১০ শতাংশ পানি আমেরিকান ফলস দিয়ে পতিত হয় বলে জানা গেছে। আমেরিকান ফলস প্রায় ৭০ ফুট উঁচু এবং এক হাজার ৬০০ ফুট প্রশস্ত। তৃতীয় ফলসটির নাম ব্রাইডল ভেইল ফলস।

আমেরিকা থেকে ফলসটি পিছন দিক দিয়ে দেখতে হয়, কানাডাতে সম্পূর্ণভাবে সামনে থেকে দেখা যায় বলে সমগ্র ফলসটি খুব ভালোভাবে দেখা যায়। আমরা ফলসের পানির ধারায় তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম আমাদের চোখের সামনে খুব স্বল্প দূরত্বে ফলসের স্রোতধারায় রঙধনু এসে নিজেই আবির্ভূত হয়েছে। আমি ঝটপট কিছু ছবি তুলে রাখলাম। আকাশের রঙধনু এসে পানিতে ধরা দেয়ায় চারদিকে এর আবেশ ছড়িয়ে গেল। অন্যান্য পর্যটকও ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে গেল। গ্রীষ্মকালের এই পানির ধারা শীতকালে অনেক সময় আংশিকভাবে হিমায়িত হয়ে পড়ে। ২০১৪ সালে নায়াগ্রা ফলসটি আংশিকভাবে হিমায়িত হয়ে পড়েছিল। তখন ফলসটি নিথর হয়ে পড়েছিল। শীতকালে ফলসে অনুষ্ঠিত অন্টারিও পাওয়ার জেনারেশন ফেস্টিভ্যাল এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। প্রতি বছর এই প্রাঙ্গণে রাতের বেলা আতশবাজি পোড়ানোর আয়োজন করা হয়। ১৯৪৮ সালে নায়াগ্রা নদীর উৎস লেক ইরি যখন বরফের ভারী চাঁই দ্বারা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সে সময় নায়াগ্রা ফলস শুষ্ক হয়ে পড়েছিল।

আমরা বারবার জায়গা বদল করে নায়াগ্রা ফলসের রূপ দেখছিলাম। এখানে পানির স্রোত এত তীব্র যে অন্য কোনো শব্দ স্রোতের শব্দের কারণে কানে পৌঁছায় না। বহু দূর থেকেও বাতাস ভেদ করে পানির স্রোতের সুতীব্র শব্দ কানে ভাসে। মনে হয় যেন পানি কলকল শব্দে গান জুড়েছে। আমার মনে হলো যেন বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি। আসলে নায়াগ্রা ফলসের তীব্র স্রোতের কারণে জলকণার ফোঁটা এসে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল। পরে ওখান থেকে ফিরে যখন আমরা রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম তখনো জলের ছাঁট আমাদের চোখ মুখ ও গায়ে এসে পড়ছিল। কি চমৎকার অনুভূতি বলে বুঝানো যাবে না। নায়াগ্রা ফলসের দিকে তাকালে একদিকে ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে মনে হয় একবার পানিতে পড়ে গেলে এমনভাবে ভেসে যাবো, আমার অস্তিত্বের খোঁজ আর কেউ পাবে না।

কিন্তু নায়াগ্রার তীব্র মোহময় আকর্ষণ অ্যাডভেঞ্চারারদের বারবার তার কাছে টেনে নেয়। নায়াগ্রাকে ছুঁয়ে দেখার অদম্য আগ্রহে ১৯২৮ সালে স্যামপেচ নামের এক অভিযাত্রী ফলসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় অনেকেই টিকিট কিনে মেইড অফ দ্য মিস্ট ক্রুজে চড়ে নায়াগ্রা ফলসে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সুন্দর ও অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা লাভের জন্য ক্রুজটি জলপ্রপাতের কেন্দ্রে নিয়ে যায়। এখান থেকে ফলসের তীব্র গর্জন উপভোগ করা যায়। পানির তীব্র ঝাপটা থেকে বাঁচতে এবং পানিতে পড়ে গেলে নিরাপত্তার জন্য বিশেষ জ্যাকেট পরে ক্রুজে চড়াই নিয়ম। নায়াগ্রা ফলসের বিশুদ্ধ ঠাণ্ডা বাতাসে শরীর ও মন জুড়িয়ে যায়। গ্রীষ্ম ও বসন্তকালে নায়াগ্রা ফলস অসাধারণ দৃশ্য নিবেদন করে। গরমের দিনেও শীত শীত অনুভূতি জড়িয়ে ধরে। নায়াগ্রা ফলস সিগাল পাখির যেন অভয়ারণ্য। এরা মানুষকে পাত্তা দেবে দূরের কথা, মোটেও ভয় পায় না।

সৌন্দর্য ছাড়াও নায়াগ্রা ফলসের আরো অনেক অবদান আছে। নায়াগ্রার পানির স্রোত থেকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। প্রতি দিন প্রতি মিনিটে নায়াগ্রা ফলসে ৬০ লাখ ঘনফুটের বেশি পানি প্রবাহিত হয়। যার গড় পরিমাণ ৪০ লাখ ঘনফুট। নায়াগ্রা ফলস সমগ্র নিউ ইয়র্ক এবং অন্টারিও জলবিদ্যুৎ শক্তির অন্যতম প্রধান উৎস। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের স্রোত অন্যান্য জলপ্রপাতের স্রোতের চেয়ে অনেক গুণ বেশি তীব্র বলে এই স্রোতকে কাজে লাগিয়ে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।

নায়াগ্রা ফলসের মতন নায়াগ্রা উদ্যানও চোখ মন তনু জুড়িয়ে দেয়। দুই হাজারের বেশি বর্ণিল প্রজাপতির সমন্বয়ে নায়াগ্রা ফলস প্রজাপতি ভাণ্ডার একটি চমৎকার দর্শনীয় স্থান। নায়াগ্রা ফলসের উদ্দেশে বেড়াতে গেলেও প্রায় সবাই নায়াগ্রা একুরিয়াম, নায়াগ্রা সায়েন্স মিউজিয়াম, ওয়ার্লপুল স্টেট পার্ক, ডেভিলস হোল স্টেট পার্ক, রিসার্ভার স্টেট পার্ক, নায়াগ্রা অ্যাডভেঞ্চার থিয়েটার ও হাইড পার্ক পরিদর্শন করতে ভোলে না। আপনিও বেড়াতে গেলে এই স্থানগুলো অবশ্যই বেড়ানোর তালিকায় রাখবেন।

নায়াগ্রা ফলস সারা বছর ২৪ ঘণ্টাই উন্মুক্ত থাকে। তবে নায়াগ্রার অন্য দর্শনীয় স্থানগুলোর জন্য সময়ের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখানে আছে নামী দামি বড় বড় হোটেল। ক্যাসিনোর স্বর্গরাজ্য এখানে হাতের নাগালেই। রঙধনুর মতন দেখতে রেইনবো সেতু দেখে খুব আনন্দ পাবেন। এই সেতু নায়াগ্রা ফলসের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। নায়াগ্রার সর্বোচ্চ স্কাইলন টাওয়ার ১৬০ মিটার উঁচু। সেখান থেকে নায়াগ্রা ফলস দারুণভাবে দেখা যায়। ফলসের কাছে শহরে ট্যাকিভিল টাউন, চারদিকে শহরজুড়ে উজ্জ্বল আলোর সমাহার রাতের বেলাকে মোহময় করে তোলে। রাস্তার সব জায়গায় স্থাপন করা আছে সিনেমার তারকা এবং প্রাণীদের বিরাট বিরাট মূর্তি। শহরের কিছুটা ভেতরে গিয়ে চড়ে বসতে পারেন স্কাইহুইলে। স্কাইহুইলে বসে লাল, নীল, সবুজ আলোর ফোয়ারা দেখতে ভীষণ ভালো লাগবে এটা নিশ্চিত বলতে পারি। পুরো শহর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছবির মতন সাজানো গোছানো।

এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথে দেখে এলাম নায়াগ্রা অন দ্য লেক এবং ফ্লাওয়ার ক্লক পার্কসহ আরো কিছু নান্দনিক স্থান। সেগুলোর গল্প আরেক দিন হবে। নায়াগ্রা ফলস দেখার শখ পূরণ হয়েছে, অপেক্ষায় আছি জাম্বিয়ার আরেক অনন্য বিস্ময় ভিক্টোরিয়া ফলস দেখার।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us