কালাপানি : ভারত-নেপাল সম্পর্কে নতুন বিষফোঁড়া

অরুন বুধাথকি | Nov 13, 2019 09:23 am
কালাপানি : ভারত-নেপাল সম্পর্কে নতুন বিষফোঁড়া

কালাপানি : ভারত-নেপাল সম্পর্কে নতুন বিষফোঁড়া - ছবি : সংগৃহীত

 

কাশ্মিরের অভ্যন্তরীণ মর্যাদা পরিবর্তন করার মাধ্যমে আঞ্চলিক ও বিশ্বজুড়ে বিতর্ক উস্কে দেয়ার পর ভারতের নতুন সরকারি রাজনৈতিক মানচিত্রটি নেপালে সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। গত ২ নভেম্বর ভারতের হালনাগাদ করে প্রকাশ করা মানচিত্রটিতে কালাপানি নামে পরিচিত একটি এলাকাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নেপাল এই এলাকাকে নিজের বলে দাবি করে থাকে। মানচিত্রটি প্রকাশ করার চার দিন পর নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ভারতীয় মানচিত্রে কালাপানিকে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে আপত্তি জানায়।

প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নেপাল সরকার দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে কালাপানি হলো নেপালের অংশ। কালাপানিকে দখল করার ভারতের একতরফা ও অবৈধ পদক্ষেপটি ১৮১৬ সালে নেপাল ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যকার সুগইলি চুক্তির পরিপন্থী।
কালাপানি ৩৫ বর্গমিটার জায়গা। এটি নেপালের পিথোরাগার জেলায় ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ভারতীয় রাজ্য উত্তরাখন্ডের সাথে নেপালের ৮০.৫ কিলোমিটার যাতায়াতপূর্ণ সীমান্ত ও চীনের সাথে ৩৪৪ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।

কালাপানি থেকে উৎপত্তি হয়েছে কালি নদীর। ভারত এখন নদীটিকে তার মানচিত্রে অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছে। অথচ আগের মানচিত্রগুলোতে এটির অস্তিত্ব ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নেপালের মধ্যে সই হওয়া ১৮১৬ সালের সুগুইলি চুক্তি (অনুচ্ছেদ ৫) অনুযায়ী কালি নদী বিবেচিত হওয়ার কথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নেপালের মধ্যকার সীমান্ত হিসেবে। ১৯৬২ সালে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর নেপালের অনুমতি ছাড়াই ভারতীয় সৈন্যরা অবৈধভাবে কালাপানিতে প্রবেশ করে সেখানে সৈন্য মোতায়েন করে। নেপালের ভূমি জরিপকারীদের মতে, ভারত-চীন যুদ্ধের আগে ১৯৬১ সালে নেপাল কালাপানিতে জনসংখ্যার জরিপ চালায়। আর ভারত তখন তাতে কোনো আপত্তি জানায়নি।

অবশ্য নেপালি ভূখণ্ড ভারতের সীমান্তের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার এই প্রবণতা নতুন কিছু নয়। ভারতের মানচিত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দি সার্ভে অব ইন্ডিয়া ১৯০৫ সাল থেকে নেপালের কালাপানি ও নবিদাঙ এলাকা অন্তর্ভুক্ত করে। আর তা করে নেপালের ভূখণ্ডগত সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানটি ১৮৫০, ১৮৫৬, ১৮৭৯ ও ১৯০৫ সালেও নেপালি ভূমি নিজের মধ্যে নিয়ে নিয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, ভারতের ১৮৫৬ সালের মানচিত্রে মহাকালির উৎপত্তি লিপুধারায় দেখানো হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার এসব মানচিত্র গ্রহণ করে নিয়েছিল এবং সেগুলো লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিসে সংরক্ষিত রয়েছে।

কাঠমান্ডু তার দাবির পক্ষে প্রমাণ পেশ করে গেলেও ভারত সরকার অব্যাহতভাবে নেপালের দাবি অগ্রাহ্য করে আসছে। ভারত কেবল কালাপানি দখল করেছে, তাই নয়। বুধি নারায়ন শ্রেষ্ঠা তার গ্রন্থ বর্ডার ম্যানেজমেন্ট অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে বলেছেন যে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর চেক পোস্টগুলোর সামরিক সদস্যরা ১৯৫২ সালের ৯ জুন নেপালের উত্তর সীমান্তে প্রবেশ করে। তবে নেপাল সরকার তাদেরকে ১৯৬৯ সালের ২০ এপ্রিল ভারতে ফেরত পাঠায়। আর এপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতীয় সৈন্যদের ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে প্রত্যাহার করা হয়।

তাছাড়া ১৯৬০ সালের ২০ মার্চের নেপাল-চীন চুক্তিও নেপালের দাবি সমর্থন করে। এতে বলা হয়, নেপাল-চীন সীমানারেখার সূচনা হয়েছে কালি নদী ও তিনকার নদীর সঙ্গমস্থল থেকে।

মজার ব্যাপার হলো, ওই চীন-নেপাল সীমান্তের অস্তিত্ব কিন্তু এখন আর নেই। কারণ ভারত প্রকাশ্যেই কালাপানি দখল করায় দেশটি এখন নিজেকে চীনা হুমকির সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। ভারত একের পর এক ভুল করেই চলেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে নেপালের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের অর্থনৈতিক অবরোধ। এটিও নেপাল ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছে।

উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট রিসার্চ বিভাগের অধ্যাপক অশোক সোয়াইন বলেন, প্রতিবেশীদের মধ্যে ভারতে বেশিসংখ্যক বন্ধু নেই, বিশেষ করে ২০১৫ সালে নেপালের ওপর অনানুষ্ঠানিক অবরোধ আরোপের পর থেকে। অথচ নেপালকে কাছে পাওয়ার জন্য চীন সবকিছুই করছে।

অবশ্য সীমানা গ্রাস করার কাজটি একমাত্র ভারতই করে না। চীনের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে নেপালের। কালাপানির কাছে থাকা লিপু লেখ পাসও নেপালের অংশ। নেপালের অনুমতি ছাড়াই একে ভারত ও চীনের মধ্যকার তেমাথা বাণিজ্য রুটে পরিণত করা হয়েছে। এতেও চীনা উদ্দেশ্য নিয়ে নেপালিদের মধ্যে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

কালাপানি ও লিপু লেখের ঘটনা ভূবেষ্ঠিত ও ছোট দেশ নেপাল বৃহৎ দুই প্রতিবেশীর দখলের শিকার হতে থাকবে কিনা সে প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।

সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ বিপিন অধিকারি দি ডিপ্লোম্যাটকে বলেন, কে বলে কালাপানি, লিপু লেখ, লিম্ফুয়াধারা ‘বিরোধপূর্ণ এলাকা?’ এগুলো নেপালের অংশ এবং সেভাবেই থাকবে। চীন-ভারত যুদ্ধের সময় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে চলে গিয়েছিল, সেভাবেই তাদের যেতে হবে। অনেক হয়েছে, আর নয়। দখলদারিত্বের যুগের অবসান হতেই হবে।

মাওবাদী বিদ্রোহীরা আগে সুইগুলি চুক্তির সমালোচক ছিল। তারা এই চুক্তি বাতিল করতে বলত। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি মনে হচ্ছে এ ব্যাপার কূটনীতির আশ্রয় নিয়েছে।

নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রদীপ গিয়ালি কালাপানি ভারতের দখল করার ব্যাপারে নেপাল সরকারের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। আবার ভারতও বিবৃতি দিয়ে ঐতিহাসিক তথ্য ও প্রমাণ উড়িয়ে দিযে বলেছে যে নেপালের সাথে তাদের কোনো সীমান্ত বিরোধ নেই।

দি ডিপ্লোম্যাট


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us