মার্কিন সমীকরণ : ভারত আউট, পাকিস্তান ইন!
মার্কিন সমীকরণ : ভারত আউট, পাকিস্তান ইন! - ছবি : সংগৃহীত
দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ করে পাকিস্তানের ব্যাপারে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর যে কয়েকটি দেশ পাকিস্তানকে প্রথমে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তার অন্যতম ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রে বড় সমর্থক এবং ১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তান যুদ্ধসহ এই অঞ্চলে আমেরিকান স্বার্থ সুরক্ষিত রেখেছিল। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে হামলার পর ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ পাকিস্তান ছিল ঘনিষ্ঠ মিত্রও।
যদিও পাকিস্তান প্রয়োজনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেও কোনো ব্যাপারে পাকিস্তানের সমর্থন আর দরকার না হলে সবসময়ই পিছু হটেছে, সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। পাকিস্তান ইতিহাসে কঠোরতম ও কঠিনতম মার্কিন অবরোধের মুখে পড়েছে।
যদিও পাকিস্তানের স্বার্থের মূল্যায়ন করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র এবং অব্যাহত দাবি জানিয়ে আসছে, কিন্তু তবুও দুই দেশ তাদের অভিন্ন লক্ষ্য ও স্বার্থে সবসময় একে অপরকে সহযোগিতা করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘আরো কিছু করো’- ছিল পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন নেতৃত্বের বার্তা। অথচ তারা ওইসব দাবি পূরণে পাকিস্তানের সামর্থ্য ও স্বার্থ বুঝতে চেষ্টা করেনি। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে ‘লেনদেন’ হিসেবে বিবেচনা করেছে। অথচ পাকিস্তান দীর্ঘ মেয়াদের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আন্তরিকতা সম্পর্ক কামনা করেছে। গত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানের প্রতি দোষারোপ ও হুমকি দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। নিঃসন্দেহে, উভয় পক্ষের মধ্যেই কিছু উদ্বেগের অস্তিত্ব রয়েছে, এগুলের কিছু কিছু যথার্থ। তবে কিছু কিছু ভুল বুঝাবুঝি থেকে বা অতিরিক্ত প্রত্যাশা থেকে সৃষ্টি।
যুক্তরাষ্ট্র যতক্ষণ পাকিস্তানের সাথে সহযোগিতা করেছে, ততক্ষণ যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে তার কৌশলগত লক্ষ্য হাসিল করেছে। পাকিস্তান ছোট দেশ হলেও এটি কৌশলগত স্থানে অবস্থিত এবং ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ২২ কোটি জনসংখ্যার দেশ পাকিস্তান মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পরমাণু শক্তির দেশ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংযোগস্থলে অবস্থিত পাকিস্তান। আরব সাগরকে ইউরেশিয়ার সাথেও যুক্ত করেছে পাকিস্তান।
প্রাকৃতি সৌন্দর্যেও ধন্য পাকিস্তান। তাছাড়া বিপুল খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ। এর জনসংখ্যার ৭০ ভাগের বয়স ৪০-এর নিচে। বৈচিত্র্যপূর্ণ জলবায়ু পাকিস্তানকে অন্যতম সেরা কৃষি দেশে পরিণত করেছে। পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের সার্বিক ইতিহাসে চড়াই-উৎড়াই রয়েছে। তবে গত দশক ছিল সম্পর্কের সবচেয়ে খারাপ অধ্যায়। পাকিস্তানের কাছ থেকে সরে গিযে ভারতকে সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারতকে সহযোগিতা করেছ, চীনকে মোকাবিলায় ভারতকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছ। পাকিস্তানের বদলে ভারতকে আফগানিস্তানে ভূমিকা পালন করতে বলেছে। ফলে ইসরাইলের পর মার্কিন সহায়তার দিক থেকে ভারত হয়েছে সবচেয়ে লাভবান দেশ।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা পূরনের মতো সামর্থ্য নেই ভারতের। এই অঞ্চলে পাকিস্তানের সহায়তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না। একটার পর একটা ব্যর্থতার ফলে যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষ করে এর সামরিক নেতৃত্ব পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছে।
সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যালিস ওয়েলেস সম্প্রতি চায়না-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) নিয়ে কথা বলেছেন, এর দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব নিয়ে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এটা কি তার আন্তরিক পরামর্শ না চীনকে সংযত করতে কিংবা চীনকে প্রতিরোধ করার প্রয়াস, তা নিয়ে চিন্তা করা উচিত। সম্ভাব্য সব ফ্রন্টে চীনের বিরোধিতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনকে সংযত করার মার্কিন প্রত্যাশা পূরণ করতে ভারত ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রথমবারের মতো মার্কিন সিনিয়র কর্মকর্তারা সরাসরি সিপিইসি নিয়ে বক্তব্য দিলেন। ফলে এটি নিয়ে ভালোমতো চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। তবে ভালো খবর হলো এই যে যুক্তরাষ্ট্র আগামী বছর পাকিস্তানে ১৫টি বাণিজ্য প্রতিনিধিদল পাঠানোর পরিকল্পনা করছে পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্য সম্প্রসারণের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে। এ নিয়ে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
আবার সদ্য সম্প্রসারিত ডেভ-লপমেন্ট ফিন্যান্স করপোরেশন (ডিএফসি) কাজ শুরু করলে পাকিস্তান ব্যাপকভাবে লাভবান হবে। ওভারসিস প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন (ওপিআইসি) বেড়ে হবে ২৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ৬০ বিলিয়ন ডলার। ওপিআইসি হলো একটি মার্কিন সরকারি সংস্থা। তারা বিদেশে বেসরকারি পুঁজি জড়ো করে। এই তহবিলের মাধ্যমে দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ মানের আর্থিকভাবে লাভজনক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। পাকিস্তানকে এই সম্প্রসারিত সম্পদ থেকে লাভবান হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ওয়েলেস গত সপ্তাহ পাকিস্তানকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সত্যিকারের টেকসই উন্নয়ন আসলে ম্যারাথন, এটি স্প্রিন্ট নয়। পাকিস্তানি নীতিনির্ধারকদের এখন এসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
জুলাইয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের যুক্তরাষ্ট্র সফরের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ওয়েলেস বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক বাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে উচ্ছ্বসিত। দুই সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।
সব দেশের পাকিস্তানে বিনিয়োগ করুক, এটা ইসলামাবাদও চায়। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সুরক্ষা দিতে প্রস্তুত পাকিস্তান। সিপিইসি সব দেশের জন্য উন্মুক্ত। সম্প্রতি সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফ্রান্স, তুরস্ক সিপিইসি-প্রকল্পতেও বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। পাকিস্তান একটি বিশাল দেশ, আর সিপিইসির অভ্যন্তরে ও বাইরে অপরিমিত সুযোগ সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানও পারস্পরিক কল্যাণের ভিত্তিতে যেকোনো দেশের সাথে যেকোনো সময় অর্থপূর্ণভাবে সম্পৃক্ত হতে আগ্রহী। আমরা এই ঘটনায় আশাবাদী ও উষ্ণভাবে একে স্বাগত জানাই।
মডার্ন ডিপ্লোমেসি