অর্থনৈতিক উন্নয়ন- কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ও সুযোগের সমব্যবহার

আবদুল আউয়াল মিন্টু | Dec 31, 2019 04:54 pm
অর্থনৈতিক উন্নয়ন- কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ও সুযোগের সমব্যবহার

অর্থনৈতিক উন্নয়ন- কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ও সুযোগের সমব্যবহার - ছবি : অন্য দিগন্ত

 

অনেকটা বিনাদ্বিধায় বলা যায়, অর্থনীতির বিশ্বায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত ব্যবহার ও বিস্তার এবং বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতিতে আশু ভবিষ্যতে আয়, দারিদ্র্য ও বিত্তের ক্ষেত্রে অসমতা বিভিন্ন পর্যায় ও স্তরে, বিভিন্ন চেহারায় দেখা দেবে। কম উন্নত দেশগুলোর জন্য কঠিন সমস্যা হবে কম উন্নয়নের বৈশিষ্টাবলি কাটিয়ে ওঠা। বলা বাহুল্য, গরিব ও অনুন্নত দেশগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য হলো- ‘ওইসব দেশে ক্ষমতা গুটিকয়েকের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকা, যা উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির আদৌ অনুকূল নয়’। অতএব যতই কঠিন হোক না কেন, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে হলে প্রথম কাজটি হলো- কেন্দ্রায়িত ও পুঞ্জীভূত ক্ষমতাকে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিলিবণ্টন করে ওই ক্ষমতার ব্যবহারে একটা ভারসাম্যের বিধান করা। আগেই বলা হয়েছে- কুলীন ও অভিজাত মহলের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে সে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা অনৈতিকভাবে অতিরিক্ত স¤পদ করায়ত্ত করে। সেই কারণে অপেক্ষাকৃত গরিব জনগোষ্ঠী ও নতুন উদ্যোক্তারা, নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে তাঁদের দক্ষতা ও সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগাতে পারেন না। ফলে তাঁরা নিজের ক্ষমতা, মেধা ও দক্ষতানুযায়ী আয়-উপার্জন থেকে বঞ্চিত হন।

শাসক ও কর্তাব্যক্তিরা তাঁদের ক্ষমতার লাগাম শিথিল করতে সাধারণ নিয়মেই আগ্রহী নন। এক্ষেত্রে তাঁদের আশঙ্কা যে তাঁরা ক্ষমতার যথেষ্ট ব্যবহার ও অপব্যবহারের মাধ্যমে সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের আনন্দ উপভোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। অবশ্য একটা জনসমাজ যদি প্রাণবন্ত, সজীব, উন্মুক্ত ও সুশীল হয়- তাহলে তা সেই সমাজে শাসকদের হাতে থাকা অতিরিক্ত ক্ষমতার বিলিবণ্টন, তথা বিকেন্দ্রায়নের প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তুলতে সহায়তা করতে পারে। সাধারণ মানুষের সম্মিলিত শক্তি, সামর্থ্য ও সাফল্য এবং উদার রাজনীতি ও মুক্তবাজার অর্থনীতির অমিত শক্তি কাজে লাগিয়ে এটা করা সম্ভব। অন্যথায় একদিকে স¤পদ বিলিবণ্টনে বৈষম্য দিন দিন বাড়বে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও সহিংসতা বাড়বে। অস্থির সমাজে জনগণ কারণে-অকারণে একে অপরের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধে লিপ্ত হবে। উচ্ছৃঙ্খল মানুষের সমন্বয়ে গঠিত বিশৃঙ্খল সমাজ ধীরে ধীরে শাসনের অযোগ্য হয়ে পড়ে। তাতে একদিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যায়, অন্যদিকে ওইসব সমাজে সবাই সমান সুযোগ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। ক্ষমতার বিলিবণ্টনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ-সুবিধা অবারিত করে দিলে মানুষ তার মস্তিষ্কের অমিত শক্তি কাজে লাগিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধ করার সুযোগ পায়। তাতে অসমতা কমে আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

পরিবেশের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় সাড়া দিয়ে মানুষ নিজেকে বদলানোর অসাধারণ সামর্থ্যরে অধিকারী। মানুষের মস্তিষ্ক এক জটিল ও শক্তিশালী যন্ত্রবিশেষ। কেননা, এই যন্ত্রবিশেষ প্রাকৃতিক স্থিতিস্থাপক গুণে সমৃদ্ধ। মানব মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে বেশি করেই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার উপযোগী। সে কারণে মানব মস্তিষ্ক অন্য যেকোনো সৃষ্ট জীবের চেয়ে অনেক বেশি করে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও রহস্যের উদ্ঘাটন করতে পারে এবং ইতোমধ্যে উদ্ভাবিত বিষয়গুলোর আরো উন্নতি সাধন করতে পারে। অতএব সুযোগের দ্বার সবার জন্য অবারিত করে দিলে সবাই সুযোগের সমান ব্যবহার করার সুযোগ পায় বা নিজ মস্তিষ্ক ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা কমে যায়। মানুষের এই ‘প্রকৃতি’র (বৈশিষ্ট্য) সর্বোত্তম ব্যাখ্যামূলক আখ্যান হতে পারে ‘উত্তরাধিকারের প্রভাব বা জন্মসূত্রে পাওয়া লক্ষণাদি’। অনেক কারণের মাঝে এর আংশিক কারণ হলো- মানুষের একটা এজমালি উত্তরাধিকার আছে যার বিবর্তন ঘটেছে বা ঘটে চলেছে প্রাকৃতিক নিয়মে বা নৈসর্গিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।

প্রকৃতিগত বা জন্মগত সমতা-অসমতা
পুঁজিবাদ ও শিল্পসমাজ বিকাশের আলোকে সমাজ ও সমাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল পরিবর্তন ঘটেছে, ঘটে চলেছে। সমাজ স¤পর্কিত সমস্ত ধারণার খোলনলচে আগাগোড়া বদলে গেছে। নতুন সমাজ একবারেই নতুন ধ্যান-ধারণার আদলে গড়ে উঠেছে। নতুন সমাজে সদস্যরা হলো- ‘মৌলিক, মুখ্য ও ব্যক্তি হিসেবে স্বাধীন’ যাকে আমরা বলতে পারি এক ধরনের স্বায়ত্তশাসিত ‘সমাজ-অণু’। এই ব্যক্তিসমাজে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যখন ইচ্ছা তখন যেতে পারে। এক ভূমিকা থেকে আরেক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। সমাজকে এখন আর ব্যক্তি-বৈশিষ্ট্যাবলির কারণ হিসেবে নয়, বরং সমাজে বসবাসকারী সব ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যাবলির পরিণামফল হিসেবে মনে করা হয়। নতুন এই ধারণার মূলে হলো- ‘ব্যক্তিবিশেষ দিয়ে গড়ে ওঠে সমাজ’।

আমরা যদি একদিকে প্রকৃতি (প্রাকৃতিক) ও অন্যদিকে ব্যক্তিবিশেষ কর্তৃক গঠিত সামাজিক পরিবেশের ক্রিয়াপার¤পর্য বা পরস্পরের ওপরে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াগুলো বিবেচনায় নেই এবং একই সাথে এও বিশ্বাস করি যে ‘আল্লাহ সৃষ্ট সব মানুষ সমান’- তাহলে ভাবতে হবে- সমাজে বিত্ত, বুদ্ধি, সুযোগ-সুবিধা, ব্যক্তিবিশেষের ক্ষমতা, বিভিন্ন জনসমাজে নারী-পুরুষ ও নরগোষ্ঠীর মধ্যে তারতম্য ও যে অসমতা সেই আদিকাল থেকে বিরাজমান, সেই অসমতাকে কিভাবে ও কেমন করে যৌক্তিকতা দেয়া যাবে। সমাজে অনেকেই একদিকে সমাজকে সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বলে দাবি করে, অন্যদিকে এটাও সত্যি যে, সমাজের মানুষ এক বিরাট, বিপুল বহুমাত্রিক অসমতার সম্মুখীন। বলতে গেলে সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই অসমতা বিদ্যমান। তা ছাড়া সমাজের মানুষে মানুষে অসমতা বহুমাত্রিক; যেমন ক্ষমতার অসমতা, আয়ের অসমতা, ভোগ করার অসমতা, শারীরিক শক্তির অসমতা, বিচারবুদ্ধি ও জ্ঞানের অসমতা, সম্পদ অর্জন ও বণ্টনে অসমতা, সম্পদ অর্জনে সুযোগের অসমতা। অতএব অসমতার গতি-প্রকৃতি বহুমাত্রিক ও এ সমস্যার সমাধানের পথও বহুমুখী। তারপরও আদিকাল থেকে অসমতার ঐতিহাসিক কারণগুলোকে একত্রে ধর্তব্যে এনে বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে বলা যায় যেকোনো সমাধানই সমাজের সব অসমতাকে কোনোভাবেই দূর করতে পারবে না। এটা সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার যে, অসমতা আমাদের জীবনধারারই অঙ্গ। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে আজকাল সমাজবিজ্ঞানীরা অসমতার একটি নতুন ধারণা ও ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তাঁদের ধারণানুযায়ী, ‘সমতা বলতে ফল বা পরিমাণের সমতা নয়’, বরং সমতা বলতে বোঝায় ‘সুযোগের সমতা’। সমতার এ নতুন ধারণা অনুযায়ী, জীবন হলো ‘সূচনাবিন্দু থেকে একটা দৌড়বিশেষ’। আগেকার দিনে কেউ কেউ (কুলীন ও অভিজাত শ্রেণী-গুটিকয়েক) দৌড় শুরু করার সুযোগ ছিল শেষ লাইন থেকে। আর বেশির ভাগ জনগণকে দৌড় শুরু করতে হতো সূচনাবিন্দু থেকে। অর্থাৎ তখনকার দিনে সমাজের কুলীন ও অভিজাত শ্রেণী জীবন শুরু করতে পারতেন দৌড়ের সীমারেখার ‘শেষ লাইন’ থেকে। যার ফলে তাঁরা বিন্দু থেকেই সার্থক জীবন শুরু করার সুযোগ পেতেন। অন্যদিকে যারা গরিব ও বিত্তহীন, তাঁদের দৌড় শুরু করতে হতো অনেক পেছন থেকে। সে কারণেই অভিজাত বংশের মানুষ সর্বদাই সম্পদ অর্জনের দৌড়ে জয়ী হয়েছে। তবে আগেই বলা হয়েছে, বর্তমানে সমাজের খোলনলচে আগাগোড়া বদলে গেছে।

নতুন আদলে গড়ে ওঠা বর্তমান সমাজে দৌড় প্রতিযোগিতায় সূচনার বিষয়টি অনেকখানি ন্যায়সঙ্গত হয়ে উঠেছে। সবাই এখন একই সূচনারেখা থেকে সুযোগের দৌড় শুরু করার সুযোগ পায়। অতএব সবাইকে যদি বিন্দু থেকে দৌড় শুরু করতে হয়, তাহলে সবার জন্যই সমাপ্তি লাইন অতিক্রম করে দৌড়ে প্রথম হওয়ার সমান সুযোগ থাকে। অবশ্য আমাদের এও ভুলে গেলে চলবে না যে, সমাজে অনেক অসমতা আছে; যেগুলো প্রাকৃতিক। যেমন- কোনো কোনো প্রতিযোগীর (সমাজসদস্য) শারীরিক গঠন অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম। যারা লম্বা ও শারীরিক গঠনে ভালো, তাদের দৌড়ের গতি হবে অন্যদের তুলনায় দ্রুততর। অতএব কেউ পুরস্কার পাবে, কেউ পাবে না। এখানেই আসে ‘প্রকৃতি প্রসঙ্গ’। অর্থাৎ প্রাকৃতিক নিয়মেই কোনো কোনো অসমতা আমাদের সমাজ ও জীবনের অঙ্গ হিসেবে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত। এ ধরনের প্রাকৃতিক (প্রকৃতিসৃষ্ট) অসমতা কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে ‘জন্মগত সূত্র থেকেই বিভিন্ন ব্যক্তির সামর্থ্যরে স্তর বিভিন্ন হয়’। অতএব সমাজে সবার সামর্থ্য কখনো সমান ছিল না, ভবিষ্যতে হবে না। মানুষের মাঝে সামর্থ্যরে তারতম্য থাকবেই।

মানুষের মস্তিষ্ক অসাধারণ উন্নত ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও তার জন্মগত সহজাত শক্তির কারণে মানুষের নিজেকে বদলানোর সত্যিকার সামর্থ্য ও ধারণক্ষমতার নির্দিষ্ট সীমারখা আছে। এ কারণে প্রতিটি ব্যক্তিকে তাদের নিজ নিজ বংশানুগতির নিয়ন্ত্রণ উপাদান ও গুণাবলির (জিনগত) সামর্থ্যকে বিকশিত করার সমান সুযোগ অবারিত করে দিলেও সামর্থ্য ও কার্যসম্পাদনের গুণগত মানের দিক থেকে মানুষে মানুষে একটা বড় রকমের পার্থক্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে গড়ে উঠবে। সেটা ন্যায়সঙ্গত কি না বলা মুশকিল এবং এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না সহজে। তবে আমরা বিনাদ্বিধায় বলতে পারি, এই তারতম্য হলো- ‘প্রাকৃতিক কারণে জন্মগত ও স্বাভাবিক পার্থক্য বা তারতম্য’। এ ধরনের পার্থক্যের মধ্যে একটা বোধগম্য, বলিষ্ঠ যুক্তির আভাস অবশ্যই আছে। তবে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, পরিবেশের তারতম্য অনুকূল হলেও অবারিত সুযোগ পাওয়া গেলে যেকোনো মানুষ তার সামর্থ্যকে বহুভাবে, বহুগুণে ও বিশালভাবে বদলে দিতে পারে। তা ছাড়া নতুন প্রযুক্তি ও যান্ত্রিক উদ্ভাবনায় বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যেকার সামর্থ্যরে প্রাকৃতিক তারতম্য বহুলাংশে লোপ পায়। এমনকি কোনো কোনো সময় বিলুপ্ত হয়ে যায়। যেমন ধরা যাক, একটি ছেলে বা মেয়ে জন্মগতভাবে অংকে একেবারেই ভালো নয়। অন্য একজন খুবই ভালো। পরীক্ষার সময় যদি দু’জনকেই ক্যালকুলেটর দেয়া হয়, এবং দু’জনই যদি ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে পারে, তাহলে দু’জনই সমান নম্বর পাবে। এখানে জন্মগতসূত্র থেকে পাওয়া তারতম্য তেমন কোনো অসমতা সৃষ্টি করে না। তবে মূল বিষয় হলো- দু’জনকেই ক্যালকুলেটর দিতে হবে। আগেকার দিনে অভিজাত শ্রেণী ক্যালকুলেটর পেত, আর বাকি সবাই বসে বসে যোগ-বিয়োগ কষতে হতো। তাতে একদিকে যেমন সময় কম, অন্যদিকে অংক কষতে গিয়ে ভুল হতো বেশি- এসব মিলে ফেল করাটা ছিল স্বাভাবিক।

স্বাধীনতা, সমতা ও আত্মমর্যাদা
জড় বা অজড় বস্তু, মানুষের নিজের যা নেই, সেসব বস্তু চাওয়া ও পাওয়ার জন্য তার আত্মার (ঝড়ঁষ) ভেতর লুকায়িত কামনা-বাসনা-অভিলাষ প্রচণ্ড প্ররোচনা যোগায়। এগুলোর প্রথম সারিতে আছে অর্থলাভের প্রবল আকাক্সক্ষা ও ক্ষমতার অভিলাষ। দ্বিতীয় সারিতে আছে সমাজে নিজ মর্যাদার স্বীকৃতিলাভের বাসনা। অন্য দিকে, এগুলোর সাথে আবেগ-অনুভূতি, ক্রোধ, লজ্জা ও গর্বের মতো পার্থিব বিষয়গুলো জড়িত। এসব বিষয়া মানব ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ। তাই এগুলো মানুষের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। দার্শনিক হেগেলের মতেÑ ‘আত্মমর্যাদার স্বীকৃতিলাভের সাথে জড়িত মানুষের কামনা-বাসনা ও আবেগ-অনুভূতির মতো বিষয়গুলো উদার রাজনীতি বা প্রজাতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিচালনা শক্তি।’

দার্শনিক হেগেলের মতানুযায়ী, মানুষের প্রকৃতিদত্ত (প্রাকৃতিক) চরিত্রের বৈশিষ্ট্য অন্যান্য জীবজন্তুর মতোই। প্রাকৃতিক নিয়মেই তাদের কিছু জড়-অজড় বস্তুর প্রয়োজন থাকে যেগুলো তাদের হাতে বা আয়ত্তে নেই। যেমন খাদ্য, আশ্রয়স্থল, সামাজিক মর্যাদার মতো আরো অনেক জড়-অজড় বস্তু। উদারনৈতিক অর্থনীতি ‘অভিপ্রায় ও অভিলাষ’ পূরণের পক্ষে যথেষ্ট ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হলেও উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দুই যমজ নীতি ‘স্বাধীনতা ও সমতার’ পুরোপুরি ব্যাখ্যা দিতে এখনো অসমর্থ। তবে ফুকুইয়ামা এ ব্যাপারে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সেটা হলো- শিল্পায়নে অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে সমাজও বদলে যায়। বিশেষ করে সমাজে সর্বজনীন শিক্ষা মানুষের আত্মার তৃতীয় গবাক্ষকে খুলে দেয় বলে ধারণা করা যায়। হয়তো বা আগেকার দিনে প্রভুত্বভিত্তিক শাসন ব্যবস্থায় দাসশ্রেণী, অশিক্ষিত ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত গরিব জনগোষ্ঠীর মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের স্বীকৃতি পাবার তেমন কোনো অভিলাষ বা আকাক্সক্ষা ছিল না। তবে জ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে উন্নত থেকে উন্নততর শিক্ষার মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষ বিশ্বজনীন চরিত্রের হয়ে ওঠে। তখন তাদের অভিলাষ বা চাহিদা কেবল ধন-সম্পদে সীমিত থাকে না। তারা সামাজিক মর্যাদা, পদ-পদবি, সমাজে সুবিধাজনক অবস্থান ও নিজ দৃষ্টিভঙ্গির স্বীকৃতি চায়।’

ওপরের ব্যাখ্যা সত্যি বলে ধরে নেয়া যায়। কেননা, মানুষের আত্মা যদি কেবলমাত্র ‘অভিলাষ ও যুক্তি’ দিয়েই তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে শিল্পবিপ্লব বা নবচেতনার সাথে তাল মিলিয়ে পৃথিবীতে ফরাসি বিপ্লব, গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ, ইত্যাদির কোনো কারণ থাকত না। আর আধুনিক যুগে, ফ্র্যাঙ্কোর স্পেন, আইয়ুব খানের পাকিস্তান, পার্ক চুং হির কোরিয়া, পেরোনের আর্জেন্টিনা, শাহ পাহলভির ইরান, সুহার্তোর ইন্দোনেশিয়া, মার্কোসের ফিলিপাইন বা মোবারকের মিসরের জনগণ প্রভুভক্ত একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ও বাজারমুখী সরকারেই তুষ্ট থাকার কথা ছিল। একনায়ক ও রাজা-বাদশাহরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে বহুভাবে বহু দেশে অনুন্নত সমাজকে উন্নত সমাজে পরিণত করতে অবদান রেখেছেন। তারপরও জনগণ ব্যক্তি-স্বাধীনতা, সমতা ও সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে দেশে আন্দোলন সংগ্রাম করে উল্লিখিত একনায়কদের একে একে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করেছেন।

এতে বোঝা যায়, মানুষের আত্মার মধ্যে একটি মৌলিক চেতনা বা গর্ববোধ আছে, যে চেতনা ও গর্ব জীবনমানের সাথে সংহতি রেখে স্বাধীনতা ও নিজ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এই উদ্দীপনার মূল বস্তু হলো- ‘নিজ মূল্য, আত্মসম্মান, চরিত্রের উৎকর্ষ ও আত্মমর্যাদাবোধ’। এগুলোই মানুষকে ‘স্বাধীনতা ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচণ্ডভাবে প্ররোচিত করে ও প্রেরণা জোগায়। পক্ষান্তরে এই প্রেরণার মূল উৎস ‘গণতান্ত্রিক সরকার বা প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা’। এর কারণ হলো- মানুষ ধারণা করেণ যে, একমাত্র প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা (কোনো না কোনোভাবে গণতান্ত্রিক শাসন) তাদেরকে অবুঝ বালকের মতো নয় বরং একজন বিকশিত মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করবে। তাদেরকে একজন স্বাধীন সার্বভৌম ব্যক্তিসত্তার অধিকারী মানুষ হিসেবে মেনে নেবে। দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করবে। অতএব গণতন্ত্র একদিকে ‘স্বাধীনতা ও সমতা’, অন্যদিকে মানুষের ‘আত্মমর্যাদার’ অভিলাষ পূরণ করতে পারে। তবে উদার গণতন্ত্র বা প্রজাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সাথে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলছে।

এ বিষয়টি প্রশ্নাতীতভাবে এখনো মীমাংসিত হয়নি।
বিত্ত, সম্পদের বিলিবণ্টন বা পুনর্বণ্টন তখনই সম্ভব, যখন সমাজে প্রচুর সম্পদ ও বিত্ত থাকে। সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও সম্পদ সৃষ্টির জন্য অনুকূল পরিবেশ, সহায়ক নীতি ও সুশাসন প্রয়োজন। সত্যিকারের বাজার অর্থনীতির পরিকাঠামো, সমাজে সম্পদ সৃষ্টি ত্বরান্বিত করে। একই সাথে সম্পদ সৃষ্টির প্রথম দিকে মুষ্টিমেয় উদ্যেক্তার হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হবেÑ এটা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে সম্পদ সৃষ্টিতে বাঁধা দেয়া মানে দেশকে মাঝারি আয়ের দেশে উত্তরণে বাধা দেয়া। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, মূলধন সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় প্রথমে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে (অবৈধ অর্থ উপার্জনকারী, সম্পদের অধিকারি বা লুণ্ঠনকারীদের বোঝানো হয়নি) সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এতে সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি হতে পারে। সম্পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়ায় যে সামাজিক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়, সেটা কমিয়ে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে প্রয়োজন রাজস্ব আহরণে রাষ্ট্রীয় সামর্থ্য ও সেই সম্পদের ন্যায়ভিত্তিক পুনর্বণ্টন। প্রবৃদ্ধি ও সম্পদ সৃষ্টির সাথে সৃষ্ট অতিরিক্ত সম্পদ থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণে রাষ্ট্রের সামর্থ্য থাকলে আয়ের অসমতা কমে আসে এবং সম্পদ ও প্রবৃদ্ধির ন্যায়ানুপাতিক বিলিবণ্টন সহজ হয়ে ওঠে।

আধুনিক পরিমাপমূলক সমীক্ষা ও জরিপের কল্যাণে আমরা সুনিশ্চিত জানি, অধিকতর উন্নত দেশগুলির তুলনায় কম উন্নত ও কম গণতান্ত্রিক সমাজে সম্পদ ও আয়ের বিলিবণ্টনে বৈষম্য অনেক বেশি। গণতান্ত্রিক সমাজে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে আয়ের বিলিবণ্টনের সমতা আসে। এশিয়া, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার হোক বা মধ্যযুগের ইউরোপের মতো আগেকার দিনের কোনো কম উন্নত দেশ হোক- এই সব দেশের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য অভিন্ন বলে লক্ষ করা যায়। অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্যের প্রধান কারণ হলোÑ শাসক ও শাসক দলের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতার কেন্দ্রায়ন। অতিরিক্ত ক্ষমতার অধিকারীরা রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করার সাথে সাথে অতিরিক্ত স¤পদও তাদের হাতে কুক্ষিগত করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। তাতে জনসাধারণ ও অর্থনীতিকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ সামর্থ্যে কাজ করতে দেয়া হয় না। কেন্দ্রিভূত ক্ষমতা সমাজে স¤পদ সৃষ্টি ও আয়ের সুষম বিলি বণ্টনের পথে পর্বতসমান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তাতে যা হওয়ার তা-ই হয়। পণ্য ও সেবাপণ্যের সর্বোত্তম উৎপাদন হতে পারে না। বাজার শক্তিগুলো তার আপন নিয়মে চলার জন্য যে সব বিধিবিধান দরকার, সেগুলো গড়ে ওঠে না বা অতিরিক্ত বিধিবিধানের জটাজুটে আটকে পড়ে বাজার তৎপরতার গতিরোধ ঘটে, সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার বিলিবণ্টন হয় না, সেই সুযোগে অপ্রতিহত গতিতে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বিস্তারলাভ করে। ক্ষমতা এক হাতে বা মুষ্ঠিমেয় গুটিকয় হাতে পুঞ্জীভূত হলে দুর্নীতি তার স্বাভাবিক নিয়মে ক্ষমতাবানদেরই লাভবান করে। কেননা, তাদের অবস্থান সুবিধাভোগীর অবস্থান। অতএব জবাবদিহিমূলক সরকার, সুশাসন প্রবর্তনের মাধ্যমে সমাজে অসমতা দূর করে সামাজিক সংহতি নিশ্চিত করতে পারে। এসবের জন্য প্রয়োজন হলো পুঞ্জীভূত ক্ষমতার বিলি-বণ্টন বা বিকেন্দ্রায়িত সরকার ব্যবস্থা, জনগণের ক্ষমতায়ন ও আইনের শাসন। এক কথায় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us