রোদ-চটা চুলা আর জিন্সে প্রতিবাদী মুখ

অন্য দিগন্ত ডেস্ক | Jan 21, 2020 01:54 pm
কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান ধর্মঘট

কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান ধর্মঘট - ছবি : সংগ্রহ

 

মেয়েটির রোদ-চটা চুলা আর পরনে ছাল তোলা জিন্স। শান্ত ছোট্ট চেহারাটাকে সে পোস্টার বানিয়ে তুলেছে : এক গালে লাল কালিতে লেখা ‘নো সিএএ, অন্য গালে লেখা ‘নো এনআরসি’। ভারতের নতুন সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট আর ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন্স বাতিলের দাবি জানাচ্ছে সে। দাবিকে জোরালো করার জন্য কপালে আবার ক্রস আঁকা। ও যখন দেখলো যে আমি ছবি তুলছি, হাতের কাগজের পোস্টারটা তখন আরেকটু ভালো করে উঁচু করে ধরলো। হাসি বা কোনো পোজ দিলো না, কিন্তু নিশ্চিত করার চেষ্টা করলো যাতে হিন্দিতে লেখা তার কথাগুলো ভালোভাবে দেখতে পারি আমি। সেখানে ভারতীয় হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার দাবি করেছে সে।

মেয়েটি কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানের কাছে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল। এখানে বড় একটা মসজিদ ঘিরে থাকা চত্বরে অব্যাহতভাবে অবস্থান কর্মসূচি চলছে বেশ কিছুদিন ধরে, যেখানে মূলত মুসলিম নারীরা অংশ নিচ্ছে, ঠিক যেমনটা হচ্ছে দিল্লীর শাহিন বাগে। এই উভয় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ভারতের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আর নারীবাদী ইতিহাসের একটা অভাবনীয় পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করছে: সেটা হলো মুসলিম নারী – যারা সাধারণত রক্ষণশীল, তারাও নাগরিক হিসেবে প্রকাশ্যে বেরিয়ে এসেছে – তারা দৃঢ়চেতা, শান্তিপূর্ণ এবং সংখ্যায় বহু হাজার। কিন্তু এটা কোন ইসলামি আন্দোলন নয়। এটা একটা প্রকাণ্ড, অনানুষ্ঠানিকভাবে গড়ে ওঠা সকল ধর্মের মানুষদের বিক্ষোভ, যেটা এখন পুরো ভারতের বৃহত্তম ক্ষোভের একটা অংশ। এই জানুয়ারির একটি দিনে সংবাদপত্রগুলো জানিয়েছে যে, সকল ধর্মের প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন মানুষ বিভক্তি সৃষ্টিকারী নতুন আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেমেছে, যে আইনটি ভারতের সেক্যুলার সংবিধানকে বদলে দিয়েছে।

মসজিদের বিপরীত দিকে সড়কের এপারে দাঁড়িয়ে বিশাল গোল চত্বরের চারপাশে নজর বুলালে দেখা যাবে, এই চত্বরে সাতটি রোড এসে মিশেছে, চোখে পড়বে, ইসলামিয়া হাসপাতাল, বিরিয়ানি হাউজ, কাবাব ঘর, ছোট মসজিদ ইত্যাদি। এখানে সড়কগুলোর নামের মধ্যে রয়েছে সোহরাওয়ার্দী – যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে একজন, রয়েছে সাইয়েদ আমির আলী, যিনি ছিলেন মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। এখানকার মানুষদের মধ্যে মুসলিম বেশি, যদিও এখানে বহু বিশ্বাসের মানুষ রয়েছে এবং এই এলাকাতে দুটো প্রসিদ্ধ চার্চ এবং ডন বোসকো স্কুল রয়েছে। এটা কলকাতার কেন্দ্রস্থল। পার্ক সার্কাস থেকে জ্বলজ্বল করছে পুরনো উত্তরের ঠাকুরের প্রাচীন বাড়ি – জোরাসাঁকো। বিমানবন্দরের দিকে যেতে কাঁচে ঘেরা নতুন উন্নয়ন চোখে পড়ে। কাছেই দক্ষিণ কলকাতায় আধুনিক ক্যাফে, গ্যালারি, মল, যেখানে বহু অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে মুসলিমরা ভাড়া নিতে পারে না বা কিনতে পারে না।

আমি শুনেছিলাম মসজিদের অবস্থান কর্মসূচির নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা। যখন আমি অনেকগুলো গেটের একটি দিয়ে ঢুকলাম, প্রথমে কোন নারীই দেখতে পেলাম না, শুধুই পুরুষ – শত শত পুরুষ আসরের নামাজের জন্য জড়ো হচ্ছে। চত্বরের অন্য দিক থেকের প্রতিবাদ স্থল থেকে লাউডস্পিকারে এক পুরুষের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল, যার কণ্ঠস্বর আবেগে ভারি হয়ে আছে। উত্তর ভারতে বহু দশক ধরে বাস করেছি – যেটি নারীদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক অঞ্চল – সেখানকার অভিজ্ঞতা আমার মধ্যে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য একটা সতর্কতা জাগিয়ে দিলো, যেটা আমি অধিকাংশ নারী বন্ধুর সাথেই শেয়ার করে থাকি। শুধুমাত্র পুরুষদের ভিড়ে আমরা কিছুটা ভীতচকিত থাকি। কিন্তু এখানে পূর্ব ভারতে পুরুষের ভিড়ের মধ্যে একজন একাকী নারী শুধুই কৌতুহলের বিষয় মাত্র। এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলাম নারীদের প্রতিবাদ কোথায় হচ্ছে, তিনি আমাকে জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন।

সিটিজেনশিপ অ্যামেন্টমেন্ট অ্যাক্ট যদিও আইন হয়েছে, মসজিদ চত্বরে আবেগ আর দৃঢ়তা আছে, কিন্তু কোনো হতাশার অনুভূতি নেই। যে আইনের মাধ্যমে মুসলিমদের নিরব করে দেয়ার চেষ্টা ছিল, সেটাই এখন তাদের কণ্ঠ দিয়েছে। শীতের বাতাস ছিল ধোঁয়াটে আর রোদেলা, নারীরা যেখানে চটের উপরে বসে ছিল সেখানে ধুলোর মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। ইয়াসমিনের পাশে বেশ কিছুক্ষণ বসে ছিলাম আমি। মুক্তোর মতো সাদা বুরকা পড়া ইয়াসমিনের মুখে সবসময় হাসি। শহরের অন্য প্রান্তে তার ঘর এবং সাধারণত এ সময় ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকে সে। কিন্তু ঘরের সব কাজ সরিয়ে রেখে এসেছে সে, কারণ এই প্রতিবাদে অংশ নেয়াটা তার কাজে জরুরি মনে হয়েছে: বাস্তবায়নের পথেই যদি এই আইনকে থামানো না যায়, তাহলে তার ব্যস্ত থাকার মতো কোন ঘরই হয়তো থাকবে না। সে ছবি তুলছে, যে বিস্কুট আর ফল দেয়া হয়েছে, সেগুলো খাচ্ছে, তাকে দেখাচ্ছে কৌতুহলী আর প্রাণবন্তু।

কেউ একজন আমাকে ব্রেড রোল আর পানির বোতল দিলো, অনেকেই আসলো কথা বলতে। কাছাকাছিই দেখলাম চিক বুরকা পরা তিন তরুণী। তাদের পকেটে মোবাইল ফোন আর ওয়ালেট রাখার মতো যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক মেয়েটি বিহার থেকে মনোবিদ্যায় ডিগ্রি নিয়েছে সম্প্রতি। ইয়াসমিনের চেয়ে একটু কম আশাবাদী সে। সে বললো, “অবশ্যই, আমরা লড়াই চালিয়ে যাবো, কিন্তু এটা হলো কেন্দ্রের আইন, রাজ্য এখানে কতটুকুই বা বিরোধ তৈরি করতে পারবে?” বাইরে মাইক্রোফোনে আওড়ানো শ্লোগান শোনার জন্য একটু বিরতি দিলো সে। যে কেউ মাইক্রোফোনে গিয়ে শ্লোগান দিতে পারে, আর নারীরা এটা নির্ভয়েই করছে। শ্লোগান আওড়ানোর মাঝখানে কলেজ পরীক্ষার জন্য ক্লাসের নোট বিনিময় করলো দুই টিনএজার। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে সমর্থন দিচ্ছেন, সেখানে এটা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক বিক্ষোভ আর রোববারের পিকনিকের মিশ্রণ।

কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দু আর মুসলিমদের দুই মেরুতে ভাগ করে ফেলার আশা করেছিল, কিন্তু চরমভাবে তারা ব্যার্থ হয়েছে। আর আইনের বিরুদ্ধে বিরোধিতা প্রথমবারের মতো একটা অসহিষ্ণু সরকারের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদের ব্যাপারে ভয় কাটিয়ে দিয়েছে, যে সরকারটি কর অভিযান থেকে শুরু করে নির্বিচার গ্রেফতারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। নতুন আইনের বিরুদ্ধে বিরোধিতার ক্ষেত্রে এই মুসলিম নারীরা মোটেই একা নন: সাধারণ মানুষ – যাদের সংখ্যা বহু মিলিয়ন হয়ে গেছে – তারাও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় বিক্ষোভে যেমনটা হয়, তরুণরা এখানে নেতৃত্ব নিয়েছে, আর অবাক বিস্ময়ের ব্যাপারে হলো আমাদের মতো পিতৃতান্ত্রিক দেশে নারীরা এগিয়ে এসে নেতৃত্ব নিয়েছে, তাও আমার মুসলিম নারীরা।

প্রধানমন্ত্রী কলকাতা সফর করেছেন এবং আমার পার্ক সার্কাস সফরের আগের দিন তিনি চলে গেছেন। কলকাতার দিদি একজন হিন্দু নারী কিন্তু অভিন্ন ধর্ম হলেও এই আইনের তিনি ঘোরতর বিরোধী। বিক্ষোভের আশঙ্কায় নরেন্দ্র মোদিকে তার আসাম সফর বাতিল করতে হয়েছে। আর এখানে কলকাতায় শহরজুড়ে বিক্ষোভ এড়াতে আকাশপথে তাকে বিমানের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই বিদ্রোহী রাজ্য ছাড়ার সময় তার চেহারা যে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল, তাতেই সবকিছু বোঝা গেছে: প্রতাপশালী এই হিন্দু পুরুষ, যার বিরুদ্ধে মুসলিম নারীরা দৃশ্যমান প্রতিবাদ করেছে, আর একজন নারী মুখ্যমন্ত্রী যার বিরুদ্ধে – সব মিলিয়ে এমন অকল্পনীয় অপমানের মুখোমুখি তিনি আর হননি।
সূত্র : স্ক্রল.ইন


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us