প্রসূতির মৃত্যু, রূঢ় বাস্তবতা

অন্য দিগন্ত ডেস্ক | Mar 01, 2020 01:33 pm
প্রসূতির মৃত্যু, রূঢ় বাস্তবতা

প্রসূতির মৃত্যু, রূঢ় বাস্তবতা - ছবি : সংগ্রহ

 

মৃত্যু মানেই কষ্ট, দুঃখজনক ঘটনা। প্রসূতি মায়েদের মৃত্যু বিশেষভাবে দুঃখজনক, এবং তা শিশুমৃত্যুর মতোই। দুর্ভাগ্যবশত, যা কিছু অনভিপ্রেত বা দুঃখজনক, তেমন সবকিছুকে এক শ' ভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। প্রাণপণে তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেও, সেসব রূঢ় বাস্তব আমাদের আক্রমণ করে। প্রসূতি ও শিশুর মৃত্যু তেমনই মর্মবিদারক বাস্তব।

কোনো ঘটনার অভিঘাত আমাদের মনের ওপর কত তীব্র হবে, তা অনেকাংশে নির্ভর করে আমাদের মানসিক প্রস্তুতির ওপর। অতি বৃদ্ধ বা দীর্ঘ অসুস্থতায় দীর্ণ একজন মানুষ মারা গেলে আমরা যতটা সহজে মেনে নিতে পারি, অল্পবয়সী স্বাস্থ্যবান মানুষের আকস্মিক মৃত্যু তেমনভাবে মেনে নিতে পারি না। ক্যান্সার, স্ট্রোক, এনকেফালাইটিস বা কিডনি, লিভার, হার্টের জটিল অসুখের চিকিৎসা করানোর সময় আমাদের মানসিক অবস্থা থাকে প্রধানত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। প্রতি মুহূর্তেই আমরা আশায় বুক বাঁধতে চাই, কিন্তু মনের গভীরে ভয় থাকে যে খারাপ কিছু হতে পারে। সেই খারাপকে আটকে, রোগ বা মৃত্যুকে পরাস্ত করে রোগীকে বাঁচিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে পারলে আমরা খুশি হই।

অপরপক্ষে, সন্তানের জন্ম দেয়ার জন্য আসন্নপ্রসবা গর্ভবতীকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময় মেজাজটা থাকে সাধারণত উৎসবের। বাচ্চা হবে, দারুণ আনন্দের ব্যাপার। এই হাসপাতালে ভর্তি করে দিলাম, ডাক্তার সময়মত বাচ্চাটাকে বের করে দেবে আর সবাই মিলে হাসিমুখে বাড়ি চলে যাব। সহজ ব্যাপার। চারদিকে কোটি কোটি বাচ্চা হচ্ছে, আমাদেরটাও হবে। এ নিয়ে ভাবার কী আছে?

আসলে গর্ভাবস্থাকে আমরা অসুখ বলে ভাবি না। বাস্তবে অসুখ তো নয়, একটা শারীরবৃত্তীয় অবস্থা, যার কারণে মায়ের শরীরের উপর বিপুল ধকল যায়। এই ধকলটার কথা আমরা বিশেষ চিন্তা করি না। গর্ভাবস্থা নিজে রোগ না হলেও এই সময়ে বা প্রসবের আগে-পরে বহু রোগ হতে পারে। এসব রোগের কথাও আমরা ভুলে থাকি। প্রসবকালীন যে চিকিৎসার জন্য গর্ভবতী মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তাকেও আমরা চিকিৎসা মনে করি না, বদলে এক অন্য ধরণের পরিষেবা মনে করি… শাড়ি গয়না বা ম্যাসাজ-স্পায়ের পরিচর্যার মতো, যা নিজের পছন্দমতো প্যাকেজে চাইলেই পাওয়া যায়, অর্থমূল্যে কেনা যায়, এবং অনর্থের কোনো আশঙ্কাই থাকে না।

আমাদের এই নিশ্চিন্ত মনোভাবের পিছনে পিতৃতন্ত্রের অবদান কম নয়। মেয়েদের সবকিছুকেই লঘু করে দেখতে আমরা অভ্যস্ত। নইলে আমরা মনে রাখতাম যে গর্ভ ও প্রসবের কাল, মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়গুলোর অন্যতম, এবং সবকিছু ভালোমতো হয়ে গেলেও গর্ভ ও প্রসব একজন মাকে শারীরিকভাবে পুরোপুরি ধ্বস্ত করে।

মাত্র দুই বা এক প্রজন্ম আগের কথাও যদি আমরা মনে রাখতাম বা বাড়ির বয়স্কাদের পরামর্শ না নিলেও তাদের স্মৃতিচারণ যদি শুনতাম সন্তান প্রসবের ব্যাপারে, তাহলে জানতে পারতাম ঐতিহাসিকভাবে কী ভয়ানক বিপজ্জনক ছিল এই “সাধারণ” ব্যাপারটাই। গর্ভ ও প্রসবজনিত সমস্যায় মৃত্যু হতো অগণিত নারীর।

গর্ভাবস্থায় শরীরে হরমোনের উথালপাথাল হয়, শরীরের ওজন বাড়ে, পানির পরিমাণের পরিবর্তন হয়। এই সময়ে রক্তাল্পতা হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের রোগ অনেকের জীবনে গর্ভাবস্থাতেই প্রথম শুরু হয়, অথবা আগে ও পরে এই রোগগুলোর অস্তিত্ব না থাকলেও শুধুমাত্র গর্ভকালে এইসব রোগ হতে পারে। প্রিএক্লাম্পসিয়া, এক্লাম্পসিয়া, হেল্প সিন্ড্রোমের মতো রোগ একমাত্র গর্ভবতীদেরই হয়, এবং তা প্রাণঘাতী হতে পারে। হেপাটাইটিস-ই অন্য মানুষের ক্ষেত্রে একটি নিরাময়যোগ্য ব্যাধি হলেও গর্ভবতীদের মধ্যে এই ভাইরাসের দ্বারা অ্যাকিউট লিভার ফেইলিওরে মৃত্যুর হার প্রায় কুড়ি শতাংশ।

গর্ভস্থ সন্তান যাতে মায়ের শরীরের অ্যান্টিবডির দ্বারা আক্রান্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতে মায়ের শরীরের ইমিউনিটিতে কিছু পরিবর্তন আসে এই সময়, যার ফলেও সমস্যা হতে পারে।

গর্ভাশয়ে প্ল্যাসেন্টা নিচের দিকে স্থিত হলে (প্ল্যাসেন্টা প্রিভিয়া) বা প্ল্যাসেন্টার মাঝের অংশ তাড়াতাড়ি গর্ভাশয়ের দেয়াল থেকে ছিঁড়ে গেলে (অ্যাব্রাপশিও প্ল্যাসেন্টি) শিশুর জন্মের আগেই মায়ের গর্ভাশয় থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে, যার ফলে শিশু ও মা, উভয়েই বিপদগ্রস্ত হয়। শিশুর জন্মের পরেও নানা কারণে মায়ের জননাঙ্গ থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে পারে, যাকে ‘পোস্ট-পার্টাম হেমারেজ’ বলে। স্বাভাবিক পদ্ধতিতে শিশুর জন্মের সময় গর্ভাশয়ের পেশীগুলো ভয়ানকভাবে সংকুচিত হতে থাকে বারবার। কিছু ক্ষেত্রে এরকম হওয়ার সময় গর্ভাশয় ফেটে যেতে পারে (ইউটেরাইন রাপচার)। প্রসবের আগে ও পরে জননাঙ্গ ও মূত্রনালীর বিভিন্ন ধরণের জীবাণুঘটিত রোগ হবার আশঙ্কা বহুগুণ বেড়ে যায়, এবং তা থেকে প্রাণঘাতী সেপ্টিসেমিয়া হবার আশঙ্কা প্রবল।

গর্ভস্থ শিশুকে ঘিরে থাকে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড নামক এক তরল। এ তরলটির খানিকটা রক্তে মিশে ফুসফসে চলে গেলে ক্ষতি হতে পারে। যদি হৃদপিণ্ডে একটি ছোট্ট জন্মগত ফুটো থেকে থাকে, যা এতদিন কোনো সমস্যাই করছিল না, তাহলে সেই পথ বেয়ে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড এম্বলিজমে মস্তিষ্কে স্ট্রোক হতে পারে। গর্ভাবস্থার শেষের দিকে পায়ের শিরাগুলোর মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। এই জমাট রক্তের টুকরো আচমকা খসে গেলেই সোজা ফুসফুসে। আগে যে মা একদম সুস্থ ছিলেন, হঠাৎ তার প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হবে, হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যাবে, ফুসফুসে রক্ত যাওয়ার ধমনীতে রক্তচাপ আচমকা বেড়ে গিয়ে হৃদপিণ্ডের ডানদিককে পর্যুদস্ত করবে। এর ফলে মৃত্যু হতে পারে।

এরকম অনেক রোগের কথা বলা যায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, গর্ভ ও প্রসবের সময় মৃত্যু ত্বরান্বিত হবার হাজারটা বন্দোবস্ত প্রকৃতি করে রেখেছে। এইসব মৃত্যু অবশ্যই মেনে নেয়ার মতো নয়। সারা পৃথিবীজুড়ে চেষ্টা চলছে প্রসূতি-মৃত্যু কমানোর, কিন্তু অজস্র প্রাকৃতিক ষড়যন্ত্র ভণ্ডুক করে দিয়ে তবেই মা ও শিশুকে বাঁচাতে হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ও স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতির ফলে কাজটাকে দূর থেকে সহজ মনে হয়, কিন্তু এভাবে দূর থেকে দেখার মধ্যে একটা আলস্য আছে। যাঁরা কাছ থেকে দেখেন, তারা জানেন যে কাজটা সহজ নয় এবং একদণ্ড নিশ্চিন্ত হওয়ার জো নেই।

আলস্য ও নিশ্চিন্ততাকে ঝেড়ে ফেলেই চলছে প্রসূতি মৃত্যুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম। পরিসংখ্যান বলছে, দুনিয়াজুড়েই উন্নতিশীল দেশগুলো এই বিষয়ে উন্নতি করছে এবং এই ক্ষেত্রে আমাদের মতো দেশগুলোর প্রচেষ্টা তারিফযোগ্য। প্রতি এক লাখ জীবিত শিশুর জন্ম দিতে কতজন মা শুধুমাত্র গর্ভধারণ ও প্রসবজনিত সমস্যায় মারা যাচ্ছেন, তার গণনাকে বলে ‘ম্যাটারনাল মর্টালিটি রেশিও’ (MMR)। গর্ভ ও প্রসবের সঙ্গে সম্পর্কহীন অন্য রোগ হিসেব থেকে বাদ, যেমন ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডেঙ্গু বা অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যু এই হিসেবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে না।

একসময় ব্রিটেনের মতো দেশেও এই মৃত্যুর হার ছিল হাজারের বেশি। ব্রিটিশরা যখন ভারতের অধিপতি, ততদিনে তারা এই হার পাঁচশয় নামিয়ে এনেছে, কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের অবস্থা ছিল বেশ খারাপ। ‘ইণ্ডিয়ান জার্নাল অব পাব্লিক হেলথ’-এ প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয় প্রবন্ধে দেখা যাচ্ছে, ১৯৪০-এর দশকে ভারতবর্ষে MMR ছিল প্রায় দুই হাজার, যা ২০১৫-র মধ্যে কমে দাঁড়ায় ১৭৪-এ। এই পরিসংখ্যান দশকের গড় নিয়ে করা।

ভারতের এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১০-১২ তে MMR ছিল ১৭৮, যা ২০১৪-১৬ দ্বিবার্ষিক গণনায় কমে ১৩০-এ দাঁড়িয়েছে। ইউনিসেফের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০০ সালে সারা পৃথিবীর গড় MMR ছিল ৩৪২, যা ২০১৭ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ২১১, অর্থাৎ ৩৮ শতাংশ হ্রাস। দক্ষিণ এশিয়ায় এই উন্নতির হার সবচেয়ে বেশি (৫৯ শতাংশ), ২০০০ সালে এই গড় ছিল ৩৯৫ (বিশ্বের গড়ের চেয়ে বেশি) আর ২০১৭ সালে ১৬৩ (বিশ্বের গড়ের চেয়ে কম)। আফ্রিকার কিছু দেশে এখনো MMR সাড়ে আট শ’র বেশি।

এই উন্নতি আশাপ্রদ, কিন্তু এইসব সংখ্যা থেকে দু’একটা কথা বুঝে নেয়া প্রয়োজন। এখনো পৃথিবীতে যদি এক লাখ জীবিত শিশু জন্মায়, তবে সেই সময়ে শুধুমাত্র গর্ভ ও প্রসবজনিত কারণেই ২১১ জন মা মারা যাবেন। সেই মা আমাদের পরিচিত কেউ হতে পারেন। তখন আমরা দারুণ দুঃখ পাব, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে এই দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটে।

প্রসূতি মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েই, কিন্তু প্রযুক্তি বা শল্যচিকিৎসার অতিব্যবহারের দ্বারা সর্বদা আরো বেশি সুফল ফলবে, তা নয়। গর্ভকালে মাকে সঠিক পুষ্টির যোগান দেয়া, আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালশিয়াম ইত্যাদির সাধারণ বড়ি খাওয়ানো, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম দেওয়া, টিটেনাসের প্রতিষেধক দেওয়া, নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া, রক্তচাপ, রক্তের শর্করা, সঠিক সময়ে আল্ট্রাসাউন্ড সহ কিছু প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করানো, প্রসবের আগে সময় থাকতে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, ভালো করে হাত ধোয়া এবং পরিচ্ছন্ন সরঞ্জাম ব্যবহার করে প্রসব করানো, ইত্যাদি সাধারণ ব্যবস্থার মাধ্যমেই প্রসূতি এবং নবজাতকের জীবনরক্ষা অনেকাংশে সম্ভব। গুরুতর অসুবিধার ক্ষেত্রে বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সাহায্যে প্রসবকালে নানারকম পরীক্ষা করা যায়, নির্দিষ্ট জটিলতার নির্দিষ্ট চিকিৎসা করতে হয় এবং প্রয়োজনে অপারেশন।

আজকাল ‘সিজারিয়ান সেকশন’-এর যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে, কিন্তু অপারেশনটা অপারেশনই। এটা হাতের নখ কাটার মতো নয় যে সকলেরই প্রয়োজন হবে। আজকাল অনেকে প্রথমেই দাবি করেন যে সিজার করতে হবে (কিছু ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট তিথিতে বা উৎসবের দিনে)। শিশুর কোনো জটিলতা হলে অনেকেই পরবর্তী কালে আমাদের দেখাতে এসে বলেন, “প্রথমেই সিজার করে দেয়া উচিত ছিল। আমরা কত করে বললাম, তবু ওরা নর্মাল করতে গেল।” এই মনোভাব বিপজ্জনক। মায়ের পেট ইচ্ছেমতো কেটে ফেলার জায়গা নয়। এ বিষয়টি স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে।
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us