কলকাতায় হিন্দির দাপট প্রতিরোধ করতে পারবে বাংলা?

প্রবীর প্রমানিক | Mar 03, 2020 08:47 pm
কলকাতায় হিন্দির দাপট প্রতিরোধ করতে পারবে বাংলা?

কলকাতায় হিন্দির দাপট প্রতিরোধ করতে পারবে বাংলা? - সংগৃহীত

 

প্রায়ই দেখি, আমার ভাইজি, কলকাতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি স্কুলের ছাত্রী, তার সমমনা গ্রুপের, তাদের বেশির ভাগই বাঙালি, সাথে অনর্গল হিন্দিতে কথা বলে।

গ্রুপটি একসাথে নগরীর অভিজাত মলগুলোতে ঘুরে আর বলিউডের সর্বশেষ মুভিটির প্রথম শো দেখে বেড়ায়। তারা বলিউড অভিনেতাদের আচার-আচরণ নকল করে, জনপ্রিয় হিন্দি গানের সাথে তাল মিলিয়ে নাচে।
তাদের মা-বাবারা পুরোদস্তর বাঙালি। কিন্তু তাদের এই সত্য হজম করতে কষ্ট হয় যে তাদের মেয়েদেরে বাংলায় কথা বলতে বা বাংলা সাহিত্য পড়ার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। তারা উৎকণ্ঠিতভাবে দেখে যে তাদের একমাত্র সন্তান বাংলা সাহিত্যের সোনালি সম্পদরাজির প্রতি নজরই দিচ্ছে না।

তবে এর জন্য কেবল মেয়েটিকেই পুরোপুরি দায়ী করা চলে না। কথাটি ভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ ও বাংলা সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞদের। তার বাংলার প্রতি অরুচি দেখে মা-বাবা তাকে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন।
কলকাতার রামমোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. অনুস্কার রায় চৌধুরী বলেন, লোকজন, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে প্রকাশ্য স্থান, মল, রাস্তার হকার এমনকি অ্যাপভিত্তিক ক্যাবচালক, রেস্তোরাঁ, মাল্টিপ্লেক্স, ব্যাংক, বিমানবন্দর এবং এমনকি ই-কমার্স পোর্টালগুলোতে হিন্দিতে কথা বলার প্রবণতা দেখা যায়।
এর কারণ হলো হিন্দু বা বাংলায় কথা বলার সময় হিন্দি শব্দ ব্যবহার করা হয়। আগের আমলে বাংলা ভাষা নিয়ে লোকজনের মধ্যে যে গর্ব ও অহংকার ছিল, বর্তমানে তা নেই।

তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্মের পড়ার প্রতি আগ্রহ খুবই সামান্য, তারা সবসময় ওয়েব ব্রাউজিং, সেলফি তোলা, ভিডিও গেমস খেলা বা বলিউড ফিল্ম দেখতে ব্যস্ত থাকে। তরুণরা অশোভন বাংলা বলে। অনেক এফএম রেডিও স্টেশনে রেডিও জকিদের মধ্যে এই বেশি দেখা যায়।
কলকাতায় বাংলা হয়তো রুগ্ন হয়ে পড়েছে, কিন্তু প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় ভাষাটি এখনো খুবই প্রাণবন্ত। এই বক্তব্য ভারত সরকারের সাবেক সংস্কৃতি সচিব ও বাংলা ভাষার ইতিহাসবিদ জওহার সরকারের।

সরকার সাউথ এশিয়ান মনিটরকে বলেন, বাঙালিয়ানা বা বাঙালিত্ব কখনো হারিয়ে যাবে না।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাঙালিরাই একমাত্র জাতি, যারা বিয়ে ও অন্যাণ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে। মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা প্রাণবন্তই থাকবে।
বলিউড ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির নকল করার ফলে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গে কিছু অংশে, প্রতিবেশী আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকা, ত্রিপুরার (এখানে বেশির ভাগ লোক বাংলায় কথা বলে) বাঙালি সাংস্কৃতিক প্রতিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

সরকার জোর দিয়ে বলেন যে বাঙালিরা গর্বিত জাতি, তারা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমালোচনাকে হালকাভাবে নেয় না। তারা তাদের বাঙালিয়ানা নিয়ে খুবই স্পর্শকাতর।
তবে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহারের বিষয়টি এলে ওই অনুভূতি দুর্বল হয়ে পড়ে। কোনো বাঙালি যখন কলকাতার কোনো বিলাসবহুল শপিং মলে যায়, তখন দোকানির সাথে সে বাংলায় কথা বলে না। ইংরেজি বা হিন্দিই গুরুত্ব পায়। বাঙালিরা হিন্দি শেখার জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম করে। তারা এমনকি বিবাহ অনুষ্ঠানের আগে সঙ্গীতও শিখে নেয়।
পাশ্চাত্যভাবাপন্ন বাঙালি পরিবারগুলো নিয়মিত ইংরেজিতে কথা বলে। অবশ্য এটি নতুন নয়, বিশ শতক থেকেই এমনটি চলে আসছে। এর প্রধান কারণ ব্রিটিশ শিক্ষা। আবার বাংলা ও ইংরেজির মিশেলে বাংলিশও আছে।
তবে সরকার জানান, বেশির ভাগ বাঙালি পরিবারে বন্ধুদের সাথে কথা বলার সময় হিন্দি নয়, বরং বাংলাতেই কথা হয়।

বাংলা ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, কলকাতায় বাংলা ঝিমিয়ে পড়ার কারণ হলো সাংস্কৃতিক প্রভাব। তিনি বলেন, অনেক দশক ধরেই আমরা পাঞ্জাবি ট্যাক্সি চালক বা হিন্দুভাষী রিক্সাচালকদের সাথে হিন্দিতে কথা বলে আসছি। আর নতুন প্রজন্ম প্রায়ই বলিউড মুভি দেখায় তাদের কাছে হিন্দু শেখা কঠিন নয়।
তিনি বলেন, অবশ্য ইউনেস্কোর বাংলাকে সবচেয়ে মধুর ভাষা হিসেবে অভিহিত করায় বাংলা বিলীন হওয়ার শঙ্কায় নেই। কলকাতায় এটি হয়তো জমি হারিয়ৈছে, কিন্তু ছোট শহরগুলো বা গ্রামীণ এলাকায় অবস্থা তেমন নয়।

তবে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে হিন্দির আধিপত্য মোকাবিলা করতে এখন ভাষা ও চেতনা সমিতি আমের একটি সংস্থার আবির্ভাব ঘটেছে। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দির প্রতি সমর্থন বাড়াতে কেন্দ্রীয় সরকার বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। হিন্দি শেখানোর জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের স্কুল, কলেজগুলোতে উদারভাবে অর্থ বরাদ্দ করছে। ফলে ছাত্ররা বাংলার বদলে হিন্দি নিতে আগ্রহী হয়।

তবে ভাষা ও চেতনা সমিতি বাংলার জন্য কাজ করছে। তারা বাংলার গর্ব ফিরিয়ে আনতে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
সরকার বলেন, নতুন প্রজন্ম তাদের মাতৃভাষা জানা সত্ত্বেও ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ, স্মাটফোনে ব্যস্ত থাকে। তারা সাহিত্য বা কবিতা পড়ে না, এমনকি বাসের কন্ডাকটর, ট্যাক্সি ও অটো-রিকশাচালকেরাও হিন্দিতে কথা বলে। প্রমাণ আকারের পোস্টার ও দোকানের সামনের সাইনবোর্ডগুলো এখন প্রায় সবাই হিন্দি ও ইংরেজিতে লেখা।

বাংলা সাহিত্য, মঞ্চ ও সিনেমার বাজার ছোট হয়ে আসছে। বাণিজ্যিক ও করপোরেট পরিমণআডলে বাংলার কোনো স্থান নেই, জানান জওহার সরকার। তিনি অবসর গ্রহণের আগে প্রসার ভারতী নামে ভারতের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সম্প্রচার সংস্থায় কর্মরত ছিলেন।

তিনি বলেন, বাঙালিরা বাংলার ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর। ফলে আমাদেরকে হিন্দি প্রভাব মোকাবিলা করতে হবে। জনগণের ভাবাবেগের কাছে আবেদন জানাতে হবে। ইংরেজি ও হিন্দি শিখতে পারো, তবে বাংলাকে ভোলা যাবে না বা অবহেলা করা যাবে না। বাংলা হলো বিশ্বের ৫ম ব্যবহৃত ভাষা।

সরকার বলেন, বাঙালিদের বেশির ভাগই তাদের ভাষাগত আত্মমর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। নতুন সহস্ত্রাব্দে জন্মগ্রহনকারীদের কাছে বাংলা বলা ‘ততটা আবেগহীন নয়।‘ তারা বাংলা ভাষাটি যথেষ্ট উচ্ছাকাঙ্ক্ষী নয় বলে এই ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পায়।
তবে বাংলা ভাষা মরবে না, যত দিন বিশ্বজুড়ে থাকা ২০ কোটি বাঙালি থাকবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কারণে বর্তমান বাংলা সবচেয়ে বেশি কথা বলা ভাষার দিক থেকে চতুর্থ। ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, আন্দামান ও নিকোবরেও এই ভাষায় লোকজন কথা বলে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাজ্যেও বাংলা ভাষায় অনেক লোক কথা বলে।

তিনি বলেন, সর্বোপরি কারো মাতৃভাষা হলো তার পরিচিতির মৌলিক অংশ।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us