বিপর্যয়ের দিকে অর্থনীতি!

আশরাফুল ইসলাম | Mar 07, 2020 07:27 am
বিপর্যয়ের দিকে অর্থনীতি!

বিপর্যয়ের দিকে অর্থনীতি! - সংগৃহীত

 

ভেঙে পড়ছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য। এক দিকে আমদানি ব্যয় বাড়ছে, অন্য দিকে কমে যাচ্ছে রফতানি আয়। এতে সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। এ দিকে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কমে যাচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। চাহিদা ও জোগান ভারসাম্যহীন হওয়ায় ডলারের বিপরীতে অবমূল্যায়িত হয়ে যাচ্ছে টাকা। যে হারে বিনিময় হার দেখানো হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি দামে লেনদেন হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।

পাশাপাশি কয়েক বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। যে পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে, অর্জন হচ্ছে তার চেয়ে অনেক কম। গত ডিসেম্বর শেষে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশের নিচে অর্থাৎ ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ; যা এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে কম। অপর দিকে বেড়ে যাচ্ছে সরকারি ঋণ। সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বেশি হারে ঋণ নেয়ায় বেসরকারি ঋণের ওপর চাপ বেড়ে গেছে। বেসরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় কাক্সিক্ষত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। এ দিকে ডিসেম্বর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। লক্ষ্যমাত্রা যেখানে ছিল সাড়ে ৫ শতাংশ, সেখানে ডিসেম্বর শেষে হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ, যদিও মূল্যস্ফীতির এ হার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

নি¤œমুখী বেসরকারি বিনিয়োগ : বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রা ও মুদ্রার বিনিময় হারের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘ দিন যাবৎ মুদ্রানীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না। কয়েক বছর ধরেই মুদ্রানীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, অর্জন হয় তার চেয়ে অনেক কম। যেমন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু ওই সময়ে অর্জন হয়েছিল মাত্র ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। একইভাবে সমাপ্ত বছর শেষে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়েছে ১০ শতাংশের কম। অর্থাৎ ডিসেম্বর শেষে বাস্তবায়ন হয়েছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য মুদ্রানীতিতে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

বেড়ে যাচ্ছে সরকারি ঋণ : মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বেসরকারি বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হলেও সরকারি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। যেমন, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৫ দশমিক ২ শতাংশ, সেখানে ডিসেম্বর শেষে সরকারের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৬০ শতাংশ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বের শেষে সরকারের এ ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ব্যাংক বিশ্লেøষকরা জানিয়েছেন, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের অস্বাভাবিক হারে ঋণ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ, কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। অপর দিকে সঞ্চয়পত্র থেকে অস্বাভাবিক হারে ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। এতে সরকারের ব্যয় ঠিক রাখতে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নিতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের স্থিতি ছিল যেখানে ৯৮ হাজার কোটি টাকা, সমাপ্ত বছরের ডিসেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে সরকারের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা, যেখানে পুরো অর্থবছরের ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা।

ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার অতিমাত্রায় ঋণ নেয়ায় বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ দানের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। কিছু কিছু ব্যাংকে ইতোমধ্যেই টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে ধার নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোর এক থেকে দু’দিন মেয়াদি ধার এখন গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে চলে গেছে। এটা ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনায় মোটেও সন্তোষজনক নয় বলে ওই সূত্র মনে করছে।

আমদানি ব্যয় বাড়ছে, কমছে রফতানি আয় : এ দিকে আমদানি দায় বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাড়ছে না রফতানি আয়। বরং গত কয়েক মাস ধরে একটানা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী আমদানি ব্যয় আগের ত্রৈমাসিকের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) চেয়ে গত ত্রৈমাসিকে প্রায় সাড়ে ৪ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৩৮১ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। যদিও মূলধনী যন্ত্রপাতিতে ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়েনি। এ দিকে আমদানি দায় বাড়লেও রফতানি আয় বাড়েনি, বরং কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) রফতানি আয় আগের বছরের একই ত্রৈমাসিকের চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ কমে ৯৩৬ কোটি ডলারে নেমেছে।

বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি : আমদানি ব্যয় যে হারে বাড়ছে সে হারে রফতানি আয় না হওয়ায় পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। ডিসেম্বর-ভিত্তিক আমদানি রফতানির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ডিসেম্বর শেষে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৪ শ’ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। আগের বছরের একই প্রান্তিকে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৩৯৪ কোটি ডলার।

সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্য নেতিবাচক হওয়ার আশঙ্কা : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বাজেটে ঘাটতি অর্থায়নে কাক্সিক্ষত হারে বৈদেশিক ঋণ অবমুক্ত হচ্ছে না। অপর দিকে বাড়ছে না রফতানি আয়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার দায় বেড়ে চলেছে। চলতি হিসাবসহ সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্য কোনো মতে ইতিবাচক রাখতে সহায়তা করছে রেমিট্যান্সপ্রবাহ। রেমিট্যান্স আহরণের ওপর দুই শতাংশ নগদ সহায়তার ঘোষণা দেয়ায় রেমিট্যান্সপ্রবাহের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কিন্তু বিদেশ থেকে যে হারে শ্রমিক ফিরে আসছে, ওই হারে যাচ্ছে না। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এর ফলে সামনে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যেতে পারে। এতে চলতি হিসাবসহ সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়ে পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

অবমূল্যায়িত হচ্ছে স্থানীয় মুদ্রা : এক দিকে বৈদেশিক দায় বাড়ছে, অপর দিকে সরবরাহ পরিস্থিতি না বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যাচ্ছে। কাক্সিক্ষত হারে সরবরাহ পরিস্থিতি না বাড়ায় ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবেই ডিসেম্বর শেষে প্রতি ডলার পেতে ব্যয় হচ্ছে ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। কিন্তু ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া এ হার কেউ কার্যকর করছে না। করপোরেট ডিলিংসহ নানা রকম আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া বিনিময় হারের চেয়ে বেশি মূল্যে ডলার লেনদেন হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নমিনাল বিনিময় হার ৮৪ টাকা ৯০ পয়সা হলেও ডলারের প্রকৃত কার্যকর বিনিময় হার ১০৯ টাকা ৮৯ পয়সা।

বাড়ছে মূল্যস্ফীতি : বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যে নি¤œমুখী প্রবণতা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও খাদ্য-মূল্যস্ফীতিতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে চলতি অর্থবছরে সাধারণ মূল্যস্ফীতিতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। গড় বার্ষিক ভোক্তা মূল্যস্ফীতি চলতি অর্থবছরে সাড়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ হলেও ডিসেম্বের শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছৈ ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। যদিও এ মূল্যস্ফীতি নিয়ে সাধারণের প্রশ্ন রয়েছে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, চলমান পরিস্থিতি উন্নতির জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষ করে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে খেলাপি ঋণ কমানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনেও খেলাপি ঋণের মাত্রা প্রতিবেশী ও তুলনীয় দেশের তুলনায় বেশি বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় সামগ্রিক পরিস্থিতির উন্নয়নে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে সামষ্টিক অর্থনীতি পুনর্গঠন করা সম্ভব হবে না।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us