বৈদেশিক খাতে বিপর্যয় : রফতানি-রেমিট্যান্সে স্থবিরতা

মাসুম খলিলী | Jun 04, 2020 10:07 pm
বৈদেশিক খাতে বিপর্যয়

বৈদেশিক খাতে বিপর্যয় - সংগৃহীত

 

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী হওয়ার কারণে, বিশেষত বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা এর প্রধান শিকার হওয়ার ফলে রফতানি চাহিদা সেসব দেশে বিশেষভাবে কমে গেছে। এ কারণে এবার বাংলাদেশের রফতানি আয়ে বড় ধরনের ‘নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে রফতানি আয়ে পৌনে ১২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অর্থবছর শেষে এটি ২০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। রফতানি খাতের দুরবস্থার প্রভাব আমদানিপণ্যের চাহিদা এবং কর্মসংস্থান, দুটোর ওপরই পড়ছে। আট মাসে ৪ শতাংশের কাছাকাছি আমদানি কমে গেছে আগের বছরের তুলনায়। বছর শেষে আমদানির এই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে।

অর্থবছরের শুরু থেকে অর্থনীতির নানা দিকে দুরবস্থার মধ্যেও প্রবাস আয়ে কিছুটা আশার আলো দেখা গিয়েছিল। করোনা মহামারী সেই আলো নিভিয়ে দিয়েছে। মার্চ থেকে প্রতি মাসে বড় হারের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির কারণে অর্থবছর শেষে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ থেকে কমে শূন্যের কোটায় নেমে আসতে পারে। এপ্রিলে ২৪ শতাংশ এবং মে মাসে ১৪ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে রেমিট্যান্সে। প্রবাস আয় করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিদেশ কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র হলো মধ্যপ্রাচ্য। সেখানে করোনা সংক্রমণ এবং জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এর ফলে বেশির ভাগ দেশই বিদেশী শ্রমিক ও জনবলকে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের এক কোটির বেশি প্রবাসীর একটি অংশ এর মধ্যে দেশে চলে এসেছে। আরেকটি বড় অংশকে ফিরে আসতে হতে পারে। ফলে রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বড় রকমের চাপে পড়তে হতে পারে। রফতানি ও রেমিট্যান্স হ্রাসের প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ভারসাম্যে।

ঋণনির্ভরতা ও জীবনযাত্রার ব্যয় স্ফীতি
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা এবং সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার কারণে করোনাজনিত প্রণোদনা এবং সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের বেতন-ভাতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ তথা নতুন টাকা ছাপানোর প্রবণতা বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সরকার ইতোমধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাপিয়েছে। আর গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, ৭৩ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রণোদনা প্যাকেজের সমপরিমাণ নতুন নোট ছাপার কথা ভাবা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে টাকার বিনিময় হারের ওপর।

করোনা পরিস্থিতিতে সরকার কতটা বিদেশী সাহায্য আকর্ষণ করতে পারে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে বাজেট ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎসের পুরোটাই ব্যাংকনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। আগের অর্থবছরে যেখানে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল, এবার তা সাত মাসে নেমে এসেছে মাত্র সাড়ে সাত হাজার ৬৭৩ কোটি টাকায়। অন্য দিকে, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণে বাজেটের মূল লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এভাবে ব্যাংক ব্যবস্থার তহবিল সরকারের ঋণ গ্রহণে চলে গেলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্তি সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। এর প্রভাব পড়বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর। আর মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি, তথা টাকার অঙ্কে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।

সামাজিক নিরাপত্তা জাল ও মৃত্যু ঠেকানোর চেষ্টা
করোনাভাইরাসের বড় চ্যালেঞ্জ হলো মহামারীর মৃত্যু ঠেকানো এবং ক্ষুধা ও অনাহার থেকে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা। সরকার এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে। এর পাশাপাশি, রমজানে দেশের অবস্থাপন্ন মানুষের জাকাত ও আন্যান্য দান অনুদানে দরিদ্রদের দুঃখ-দুর্দশা কিছুটা লাঘব হয়েছে। সামনে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে সম্পদের প্রবাহে ঘাটতি দেখা দিলে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সরকারের অনুসৃত নীতির ত্রুটি ও অসংলগ্নতা দূর করা। দেশে করোনার বিস্তার যখন উচ্চ হারে ঘটছে তখনই লকডাউন খুলে দেয়া হয়েছে। এর ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত আর মৃত্যু সংখ্যা। অন্য দিকে, জনগণের কাছে ত্রাণ সাহায্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও চুরির ঘটনা বেড়েই চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ত্রাণ বিতরণ যেখানে প্রশ্নের ঊর্র্ধ্বে দেখা যাচ্ছে, সেখানে সরকারি দল ও জনপ্রতিনিধিদের ত্রাণ বিতরণে পক্ষপাতিত্ব ও চুরির খবর আসছে অব্যাহতভাবে। এ বিষয়টি প্রতিরোধ করতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হতে পারে।

কী করতে পারে সরকার
ত্রাণ বিতরণ : অনুদান ও প্রণোদনার অর্থ সঠিক স্থানে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে সরকারকে। জনগণের দুর্দশা লাঘবে রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর পরও যে সম্পদ সামাজিক নিরাপত্তা জাল এবং প্রণোদনা খাতে ব্যয় করা হচ্ছে তার সদ্ব্যবহার জরুরি। এ ক্ষেত্রে দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের অনুদানের অর্থ নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিতরণ করা যেতে পারে। প্রণোদনার অন্যান্য অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা বজায় রাখা প্রয়োজন।
আত্মকর্মসংস্থান : করোনাসৃষ্ট পরিস্থিতিতে সারা দেশে আত্মকর্মসংস্থানের প্রতি জোর দিতে হবে। এ জন্য সামাজিক পুঁজি গঠনে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। ব্যাংকগুলোকে গ্রামমুখী ক্ষুদ্র উদ্যোগে অর্র্থায়ন বা বিনিয়োগে উৎসাহিত করা যেতে পারে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতে রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ শিথিল করা প্রয়োজন।

রাজস্ব আদায়ে গুণগত সংস্কার : রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের গুণগত সংস্কার ছাড়া অর্থনীতিকে আয় স্থবিরতার খাদ থেকে উদ্ধার করা কঠিন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব বাড়াতে চারটি কৌশল গ্রহণ করেছে সরকার। এগুলো হলো- আয়কর প্রদানকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রণোদনা প্রদান এবং কাস্টমস ও বন্ডেড ওয়্যারহাউজের সব কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় আনা। এ ছাড়া ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের নিমিত্তে দ্রুত ও ব্যাপক ভিত্তিতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) যন্ত্র ক্রয়, স্থাপন ও কার্যকর করার কথা বলা হচ্ছে। সরকারের এসব কৌশল একেবারে গতানুগতিক।

রাজস্ব আদায়ে স্থবিরতা দূর করতে হলে উন্নয়ন ও সামাজিক অর্থব্যয়কে রাজস্ব আহরণের সাথে যুক্ত করা যেতে পারে। এ ধরনের ব্যয়কে রাজস্ব আহরণের সাথে সংযুক্ত করা গেলে এটি সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজস্ব আহরণ দুটোকেই চাঙ্গা করবে। বিষয়টা এ রকম হতে পারে। যেমন সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য এক হাজার কোটি টাকা প্রদান করে থাকে প্রতি বছর। অন্য দিকে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সরকারকে ৭০০ কোটি টাকা রাজস্ব দেয়। এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে বলা হলো, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার কোটি টাকার চাহিদা পূরণ করবে। আর এটাকে সরকারের তাদের রাজস্ব প্রাপ্তি হিসাবে গ্রহণ ও সমন্বয় করা হবে। সরকার এই আয় ও ব্যয়- দুটোকেই বাজেটে হিসাব করবে। কোনো সড়ক বা রাস্তার উন্নয়নকেও এভাবে রাজস্ব আদায়ের সাথে সংযুক্ত করা যেতে পারে। এতে করদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান জনগণ সরাসরি জানতে পারবে। আর বাড়তি কর দিতে করপোরেট বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহ বোধ করবে। যেমন- বসুন্ধরা গ্রুপকে যদি বলা হয়, তারা করের অর্র্থ দিয়ে ঢাকায় একটি ফ্লাইওভার তৈরি করে দেবে। এতে তারা স্বাভাবিক করের চেয়ে ৫০ ভাগ বেশি অর্থ খরচ করতে দ্বিধা করবে না। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর করের অর্থ সরাসরি এ ধরনের সামাজিক ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হলে তারা অধিক কর দিতে উৎসাহিত হবে। একই সাথে কার্যকর রাজস্ব আহরণ বাড়বে। এই ব্যবস্থা তৃণমূলের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য করা যেতে পারে।

প্রবাসে কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ : বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের দক্ষতা অনুসারে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ ও পুঁজির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একই সাথে করোনা-উত্তর সময়ে বিদেশের বাজারে চাহিদাকে সামনে রেখে যুবকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং তাদের বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের করোনাজনিত সঙ্কট কত দূর এবং কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সে সম্পর্কে অনুমান করা কঠিন। তবে এই সঙ্কট অর্র্থনীতির ওপর যতটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছিল, তার চেয়ে প্রভাব অনেক গভীর হবে। শুধু সরকার নয়, পুরো দেশের মানুষকে এর প্রভাব কাটাতে সক্রিয় করতে না পারলে এই সঙ্কট উত্তরণ কঠিন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদার ও সমন্বয়ের নীতি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us