দাম্পত্যে আত্মিক সম্পর্ক

উম্মু নুসায়ের | Jun 19, 2020 10:01 am
দাম্পত্যে আত্মিক সম্পর্ক

দাম্পত্যে আত্মিক সম্পর্ক - প্রতীকী ছবি

 

 

‘তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাকো এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি, দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ ( সূরা রুম : ২১) 

আমাদের ক’জনের দাম্পত্য জীবনে এমন মমতা আর ভালোবাসার চাদর খুঁজে পাওয়া যায়? এই যে আমাদের মাঝে এত বিবাহবিচ্ছেদ, দাম্পত্য কলহ এর পিছনে কারণ কী?

‘বিয়ে’ আত্মার সাথে আত্মার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের নাম। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর মাধ্যমে দুটি মুসলিম আত্মাকে জুড়ে দেন। নিখাদ ভালোবাসা আর আন্তরিক মায়া মমতা এর মূল চাবিকাঠি। যে দাম্পত্য সম্পর্কে এ গুণগুলো বিদ্যমান তারাই প্রকৃত অর্থে খুঁজে পায় আনন্দ, তৃপ্তি, নিরাপত্তা, প্রশান্তি আর বেঁচে থাকার স্বাদ। অপর দিকে যে সম্পর্কে পারস্পরিক সহনশীলতা, সহানুভূতি, সহিষ্ণুতা, উদারতা, সহমর্মিতা তথা আত্মিক সম্পর্কের অভাব, সে সম্পর্ককে দুনিয়ার জাহান্নাম বলে অভিহিত করা যায়। সংসার নামক বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে এ গুণগুলো তথা আত্মিক সম্পর্কের ভিত্তি ততটাই মজবুত হওয়া চাই যাতে করে সব দুর্যোগেও মহীরুহ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে দাম্পত্য নামক এ আত্মার সম্পর্ক।

রাসূলুল্লাহ সা: সবচেয়ে ন্যায়সঙ্গতভাবে মানবিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে তোলার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি শিখিয়েছেন পারস্পরিক প্রেম স্নেহ ও দয়ার দৃঢ় আত্মিক বন্ধনে কিভাবে সম্পর্কগুলো জুড়ে রাখতে হয়। এভাবে তিনি উভয়পক্ষকেই শোষণ ও নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করেছেন। প্রকৃত আত্মিক সম্পর্ক তো এমন যে, আপনার স্পাউসের অবর্তমানে তার স্মৃতিগুলো তার উপস্থিতির মতোই সজীব থাকবে। যেমন রাসূলুল্লাহ সা: খাদিজা রা:-এর জীবদ্দশায় ও তার মৃত্যুর পর অনেক প্রশংসা করতেন। তিনি অনেক আগ্রহ নিয়ে তাঁর গুণের কথা বলতেন, হৃদয়ে তার স্থানের কথা জানাতেন। মৃত্যুর পর ও তাঁর (সা:) অন্তর সিংহাসনে ছিলেন খাদিজা রা:। আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সা:-এর অন্য স্ত্রীদের ব্যাপারে আমার মনে কখনো ঈর্ষা জাগেনি, কেবল খাদিজা রা: ছাড়া যেখানে কি না আমি তাকে কখনো দেখিনি। যখনই রাসূল সা: কোনো ভেড়া জবাই করতেন তখন বলতেন, ‘এটি খাদিজার বান্ধবীদের কাছে পাঠাও। একদিন আমি তাকে বললাম, আপনার মনে খাদিজার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এ কথা শুনে তিনি প্রশংসা করে বললেন, সে তো এমন ধরনেরই ছিল এবং সে তো আমার সন্তানদের মা।’ (বুখারি ৩৮১৮, মুসলিম ২৪৩৫)

খাদিজা রা: নেই কিন্তু তার অবর্তমানে তিনি যাকে ভালোবাসতেন, এমনকি যারা তাকে ভালোবাসত তাদের প্রতি তিনি সর্বোচ্চ আন্তরিক ব্যবহার করতেন। সেটা তাদের খোঁজ নিয়ে হোক বা উপহার পাঠিয়ে হোক। আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত, ‘একবার খাদিজার বোন হালা বিনতে খুওয়াইলিদ আল্লাহর রাসূল সা:-এর ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। তার স্বর খাদিজার কণ্ঠের অনুরূপ ছিল। এতে রাসূলুল্লাহ সা:-এর খাদিজার কথা মনে পড়ল। তিনি খুশিতে বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহ এটা যেন হালা (খাদিজার বোন) হয়!’ (আহমাদ, ২৪৩৪৩, আত তাবারানি- ১৪/২৩)

স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করা এমনি এক কাজ যার মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক মমতাপূর্ণ ও শক্তিশালী হয়। রাসূলুল্লাহ সা: স্ত্রীদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে কখনোই কুণ্ঠাবোধ করতেন না। হজরত আমর ইবনুল আস রা: রাসূলুল্লাহ সা:কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল সা: আপনি কাকে বেশি ভালোবাসেন? রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, আয়েশা।’ (বুখারি-৩৬৬২, মুসলিম-২৩৮৪)। অধিকাংশ পুরুষই স্ত্রীকে ভালোবাসার কথা এভাবে বলে না।
দুর্ভাগ্যবশত কিছু নারী শুধু মিষ্টি কথার কারণেই অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। যা তারা কখনোই তাদের স্বামীদের কাছে পায় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তাদের সাথে দয়ার্দ্র জীবনযাপন করো।’ (৪:১৯)

দয়া একটি ব্যাপকার্থক শব্দ। এর মাঝে সব কথা ও মহান আচরণ অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আমার স্ত্রীদের সাথে আচরণে সর্বোত্তম। (তিরমিজি : ৩৮৯৫)

আল্লাহ তায়ালা দম্পতিদের একজনকে অন্যজনের পরিপূরক হিসেবে বানিয়েছেন। অর্থাৎ একজন অন্যজনকে পূর্ণ করবে। কিন্তু আমরা পরিপূর্ণতা খুঁজি। যা কখনোই মানুষের পক্ষে হওয়া সম্ভব না। ব্যক্তিত্ববান হোন, আকর্ষণীয় চরিত্রের অধিকারী হোন। ফিতনার এ যুগে শুধু নিজেকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনই যথেষ্ট নয়। দিন শেষে সৌন্দর্য মলিন হয়ে যায়, কিন্তু ব্যক্তিত্বের প্রভাব অমলিন থাকে। হজরত খাদিজার প্রতি রাসূল সা:-এর ভালোবাসা ছিল তেমনি।
বিনয়ী হোন। আপনার পার্টনারের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারে যতœবান হোন। তার পছন্দের জিনিস উপহার দিন, সারপ্রাইজ দিন। এই ছোটখাটো কেয়ারগুলো আপনাকে তার অন্তরের কত গভীরে পৌঁছে দেবে কল্পনাও করতে পারবেন না। স্ত্রীকে ছুটির দিনগুলোতে কাজে সাহায্য করতে পারেন। ইবনে ইয়াজিদ থেকে বর্ণিত, আয়েশা রা:কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘রাসূলুল্লাহ সা: বাড়ির ভিতর কী কী করতেন? তিনি জবাব দিলেন, নবীজী সা: স্ত্রীদের কাজে সাহায্য করতেন এবং সালাতের সময় হলে উঠে চলে যেতেন।’ (বুখারি : ৬৭৬)

আপনার স্ত্রীর প্রতি সহানুভূতিশীল হোন, তার ছোটখাটো অপরাধগুলো ক্ষমা করে দিন। ইসলাম স্বামীদের সুপিরিওরিটি দিয়েছে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব কর্তব্যের দরুন। কিন্তু এই শ্রেষ্ঠত্ব মানেই কর্তৃত্ব নয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা খুব জরুরি। তেমনি তার কাজের স্বীকৃতি। ঘর সন্তান সামলানোর মতো কষ্টসাধ্য কাজের পর আপনার সহানুভূতিশীল কথা আপনার প্রতি তার অনুভূতি আরো তীব্র হবে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘... তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম হলো তারাই, যারা স্ত্রীদের সাথে আচরণে সর্বোত্তম।’ (তিরমিজি : ১০৮২)

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আদেশগুলো যেন হয় সামাজিক, নায্য, যৌক্তিক এবং সুন্দর। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘নারীদের পাঁজরের বাঁকা হাড় থেকে বানানো হয়েছে, তোমরা একে সোজা করতে গেলে ভেঙে ফেলবে। তাই তার ব্যবহার সহ্য করে চলো, তার সাথে সুখে বসবাস করতে পারবে।’ (আহমাদ : ১৯৫৮৯)।
অপর দিকে বোনদেরও জানা দরকার আনুগত্য করলেই কেউ ছোট হয়ে যায় না। বরং বিনয় আনুগত্য ব্যক্তিত্বকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। পুরুষকে যে ভালোবাসা, আকর্ষণ, সহযোগিতা ও আনুগত্য দেয়া হবে, সেও তাই দেবে। হাদিসে আছে, ‘কোনো নারী যখন পাঁচ প্রহর সালাত পড়ে, সিয়াম পালন করে, লজ্জাস্থান সুরক্ষিত রাখে, স্বামীর আদেশ মেনে চলে, মৃত্যুর পর তাকে বলা হবে, জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছে প্রবেশ করো।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৬৬৪)

বর্তমানে বৈবাহিক সমস্যার কারণে ডিভোর্সের হার অনেক বেড়ে গেছে। তার অন্যতম প্রধান কারণ সম্পর্কগুলোতে সম্মানবোধ, সহনশীলতা ও সর্বোপরি আত্মিক বোঝাপড়ার অভাব। আমরা আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কের উন্নয়নে রাসূল সা:-এর এবং উম্মুল মুমিনিনদের আদর্শ অনুসরণ করব। রাসূল সা:-এর আদর্শে প্রতিটি ঘর আলোকিত হলে, সমাজও একসময় আলোকিত হবে ইনশাআল্লাহ।

লেখিকা : ইসলামী গবেষক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us