মোহাম্মদ আসাদ : উম্মাহর এক আলোর মিনার

নূরুল ইসলাম খলিফা | Jul 18, 2020 09:12 am
মোহাম্মদ আসাদ

মোহাম্মদ আসাদ - ছবি : সংগৃহীত

 

১৯২৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ২৬ বছরের এক টগবগে যুবক তার সঙ্গিনী এলসাকে নিয়ে সফর করছিলেন বার্লিনের ভূগর্ভস্থ রেলপথে। একটি প্রথম শ্রেণীর পরিপাটি কামরায় উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি পড়ল ঠিক বিপরীত দিকে বসা সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের ওপর। বাহ্যিক অবয়ব এবং পোশাক সজ্জায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, লোকটি একজন ধনী ব্যবসায়ী, হাঁটুর ওপর সযতেœ রাখা চমৎকার ব্রিফকেস। ডান হাতে শোভা পাচ্ছে একটা বড় আকারের হীরার আংটি। অলস বসে থাকতে থাকতে তরুণটি ভাবছে এ স্থূলকায় লোকটির চেহারা, তখনকার দিনে মধ্য ইউরোপের সর্বত্র সমৃদ্ধির যে চিত্র দেখা যেত সেই চিত্রের মধ্যে কী চমৎকারই না মানিয়েছে! এ সমৃদ্ধি এ কারণে আরো বেশি স্পষ্ট যে, তা এসেছিল বিগত কয়েক বছর স্থায়ী মুদ্রাস্ফীতিতে যখন গোটা অর্থনৈতিক জীবনই লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছিল এবং কদর্য চেহারা হয়ে পড়েছিল ব্যতিক্রমহীন। তার পরিসমাপ্তি ঘটায় এখন প্রায় সব লোকই ভালো পোশাক পরে, খেতে পায় প্রচুর।

সুতরাং ট্রেনের কামরার বিপরীত দিকের লোকটিকে কোনো ব্যতিক্রম মনে হলো না তরুণের কছে। কিন্তু যখন তার মুখের দিকে তাকাল তখন মনে হলো না, একটি সুখী মুখের দিকে তাকাচ্ছি। মনে হলো, লোকটি যেন উদ্বিগ্ন; বরং তীব্র অসুখী; তার চোখ দু’টি উদাস দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে আর মুখের কোণ যেন কী এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় কুঁচকানো।

ঠিক তার পরই যে নাজনীন, সুন্দরী ভদ্রমহিলা বসে আছেন তার মুখেও দেখা গেল এক অদ্ভুত অসুখী অভিব্যক্তি, এমন কিছু তিনি ভাবছেন অথবা এমন কিছুর অভিজ্ঞতা তার হচ্ছে যা তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক। অবশ্য আপাত দৃষ্টিতে একটা শান্ত, স্থির হাসির ছটা সে মুখের ওপর মেলে ধরে আছে। কৌতূহলী তরুণ এরপর মাথা ঘুরিয়ে কম্পার্টমেন্টের অন্য সব যাত্রীর মুখের ওপর তাকাতে থাকে-ব্যতিক্রমহীনভাবে, সবই সেই সব লোকের মুখ; যাদের পরনে রয়েছে মূল্যবান পোশাক, যারা খায় প্রচুর আর ওদের প্রায় সবার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে গোপন দুঃখের এক অভিব্যক্তি, এত গোপন যে, সেই মুখের মালিক সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন বলেই মনে হলো।

প্রায় শতাব্দীকাল আগের এমন চিত্র এখনো অপ্রাসঙ্গিক নয়। পোল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত ইহুদি পরিবারের সন্তান লিওপোল্ড লুইসের জন্য এ ছিল এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা তার জীবনের গতিপথকে বদলে দিয়েছিল।

সস্ত্রীক ইসলাম গ্রহণ করে তিনি হয়ে গেলেন মোহাম্মদ আসাদ। জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯০০ সালে পোল্যান্ডের লেমবার্গ শহরে এক ইহুদি পরিবারে। তার নাম ছিল লিওপোল্ড লুইস। পিতামহ ছিলেন কয়েক পুরুষ বিস্তৃত এক ইহুদি পুরোহিত পরিবারের শেষ রাব্বি। অসাধারণ মেধাবী লুইস স্কুলে পড়াশোনার সময়ই হিব্র“ ধর্মগ্রন্থের সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৩ বছর বয়সেই অনর্গল হিব্র“ বলতে ও পড়তে শেখেন। ওই বয়সেই তিনি ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তালমুদের মূল পাঠ ও ভাষ্যের সাথে সম্যক পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি তার সাড়া জাগানো ‘Road to Mecca’ বইয়ে বলেছেন, ‘আমার মনে হলো, ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং তালমুদের আল্লাহ যেন তাঁর পূজারীরা কিভাবে তাঁর পূজা করবে তার অনুষ্ঠানগুলো নিয়েই ব্যস্ত। আরো মনে হতো, আল্লøাহ যেন বিশেষ একটি জাতির ভাগ্য নিয়ে বিস্ময়কর রূপে ব্যস্ত আছেন আগে থেকেই। ইবরাহিম আ:-এর বংশধরের ইতিহাসরূপে ওল্ড টেস্টামেন্টের কাঠামোই এমন যে, মনে হয় আল্লাহ যেন গোটা মানবজাতির স্রষ্টা ও পালনকর্তা নন, বরং তিনি যেন এক উপজাতীয় দেবতা, যে দেবতা একটি মনোনীত জাতির প্রয়োজনের সাথে গোটা সৃষ্টির সঙ্গতি বিধান করে চলেছেন।’

এভাবে ইহুদি মতবাদ নিয়ে নিরাশ হলেও লুইস অন্য কোনো পন্থায় আধ্যাত্মিকতার অনুসন্ধান করলেন না। শিল্প-দর্শনের ইতিহাস এবং অন্যান্য বিষয় অধ্যয়ন করে একপর্যায়ে তিনি সব আনুষ্ঠানিক ধর্মকেই সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েও ব্যর্থ হন। কারণ তখনো তার বয়স ১৮ হয়নি। বছর চারেক পর সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে সমর্থ হলেও কয়েক সপ্তাহ পরই বিপ্লবের মাধ্যমে অস্ট্র্রীয় সাম্রাজ্য ভেঙে গেল এবং যুদ্ধও শেষ হয়ে গেল। এভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সত্যানুসন্ধান করার চেষ্টা করেও নিজের মনের খোরাক খুঁজে পেলেন না। কিছুদিন ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ানোর পরে একপর্যায়ে ‘ফ্রাঙ্কফুর্টার শাইটুং’ নামের এক জগত-বিখ্যাত কাগজের সংবাদদাতা হয়ে আসেন জেরুসালেম। এখানে এসেই কয়েক বছর সফর করেন মিসর, ফিলিস্তিন, ট্রান্স জর্দান, ইরাক, পারস্য ও আফগানিস্তান। এ সময় তিনি ইসলামের সংস্পর্শে আসেন এবং তার মনের যে আধ্যাত্মিক পিপাসা ছিল ইসলামের মধ্যেই তিনি এর জবাব খুঁজে পান।

নিজের ইসলাম গ্রহণের বিবরণ দিতে গিয়ে আসাদ তার সেই বার্লিন ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করেছেন। ‘সত্যিই ভারী অদ্ভুত ব্যাপার! আমি চারপাশে এর আগে আর কখনো এতগুলো অসুখী মুখ দেখিনি, কিংবা ওদের মধ্য থেকে এই মুহূর্তে যা এত প্রবলভাবে উচ্চারিত হচ্ছে হয়তো এর আগে আমিই কখনো তার খোঁজ করিনি। ধারণাটা এত তীব্র হলো যে, এলসাকে সে সম্পর্কে বলি এবং সেও তার চারদিকে তাকাতে লাগল মানুষের চেহারা পড়তে অভ্যস্ত চিত্রকরের সজাগ চোখ মেলে। তারপর সে বিস্মিত হয়ে মুখ ফেরাল আমার দিকে আর বলল : ‘তুমি ঠিকই বলেছ, ওরা সবাই এভাবে তাকাচ্ছে যেন জাহান্নামের কষ্ট ভোগ করছে- আমি ভেবে বিস্মিত হই; ওরা নিজেরা কী জানে, ওদের ভেতর কী ঘটছে?

আমি জানি, ওরা তা জানে না। যদি জানতই, তাহলে যেভাবে ওরা জীবনের অপচয় করে চলেছে তা করতে পারত না। বাধ্যতামূলক সত্যে বিশ্বাস না করে, নিজেদের জীবনমান উন্নত করার কামনার বাইরে জীবনের কোনো লক্ষ্য না রেখে, অধিকতর বৈষয়িক আরাম-আয়েশের উপকরণ, অধিকতর সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি এবং সম্ভবত অধিকতর ক্ষমতা অর্জনের আশা ছাড়া অন্য কোনো আশাই না রেখে এভাবে জীবনকে বরবাদ করা সম্ভব হতো না ওদের পক্ষে।
আমরা যখন বাড়ি ফিরে এলাম হঠাৎ আমার চোখ পড়ল ডেস্কের ওপর, যার ওপর মেলা রয়েছে একখণ্ড কুরআন যা আমি আগে পড়েছিলাম। যান্ত্রিকভাবে আমি কুরআনটি হাতে তুলে নিই তুলে রাখার জন্য। কিন্তু যখন ওটি বন্ধ করতে যাচ্ছি, চোখ পড়ল আমার সামনে মেলে ধরা পৃষ্ঠাটির ওপর এবং আমি পড়তে শুরু করি-

‘তোমরা, আরো চাই, আরো বেশি চাই, এই লোভে আচ্ছন্ন হয়ে থাক, যতক্ষণ না তোমরা পৌঁছাও তোমাদের কবরে। না, এটা ঠিক নয়, তোমরা জানতে পারবেÑ না, ওটা ঠিক নয়, অবশ্যই জানতে পারবে তোমরা; যদি তোমরা জানতে সুনিশ্চিত জ্ঞানের সাহায্যে, তবে নিশ্চয়ই তোমরা দেখতে পেতে তোমরা রয়েছ জাহান্নামের মধ্যে। একসময় অবশ্য তা দেখতে পাবে নিশ্চিত দৃষ্টিতে এবং সেদিন তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে, তোমরা কী করেছিলে যে অনুগ্রহ তোমাদের দান করা হয়েছিল তা দিয়ে?’

মুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে যাই, আমার মুখে কোনো কথা সরে না। মনে হলো, বইটি আমার হাতে কাঁপছে। তারপর আমি তা তুলে দিলাম এলসার হাতেÑ ‘এটি পড়ো। আমরা পাতাল রেলপথে যা দেখেছিলাম একি তারই জবাব নয়?’

Ñহ্যাঁ, এটি তারই জবাব; এমন এক চূড়ান্ত জবাব যে, অকস্মাৎ সব সন্দেহ চুরমার হয়ে গেল। এখন আমি উপলব্ধি করলাম, সন্দেহাতীতভাবে আমার হাতে যে কিতাবটি ধরে আছি তা একটি ইলাহি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব; কারণ যদিও তা মানুষের সামনে পেশ করা হয়েছিল ১৩০০ বছরেরও বেশি আগে, তবু এতে এমন কিছু আগাম ধারণা করা হয়েছে যা কেবল আমাদের এই জটিল যান্ত্রিক, অবাস্তব কল্পনা-কবলিত জামানায়ই সত্য হতে পারে।

তবে বিশ্বাসের এই রূপান্তরের ভিত রচিত হয়েছিল তার আরো আগেই। আরবদের মধ্যে মেলামেশার সুযোগে আসাদ আবিষ্কার করলেন, ট্রাডিশনাল মুসলিম সমাজের মধ্যে রয়েছে মন ও ইন্দ্রিয়ের এক সহজাত সঙ্গতি, যা ইউরোপ হারিয়ে বসেছে। তিনি ইসলামকে পেলেন স্বভাবজাত ধর্ম হিসেবে, যেখানে আছে হৃদয়ের নিশ্চয়তা এবং অবিশ্বাস থেকে মুক্তি যে মুক্তি ইউরোপীয়দের স্বপ্নেরও অগোচরে।

ইসলাম গ্রহণের আগে একবার হেরাত থেকে কাবুল যাওয়ার প্রাক্কালে পথে একটি জেলার হাকিম বা প্রশাসকের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন আসাদ। সংশ্লিষ্ট প্রশাসকের সাথে কথা প্রসঙ্গে তিনি হাকিমকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এটা কেমন করে হলো যে, আপনারা মুসলমানরা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেললেন, যার ফলে একদিন আপনাদের পূর্ব-পুরুষরা ১০০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে আপনাদের ধর্মকে বিস্তৃত করেছিলেন আরব দেশ থেকে পশ্চিমে সুদূর আটলান্টিক পর্যন্ত এবং পূর্বদিকে মহাচীনের অভ্যন্তরে, আর এখন নিজেদের এত সহজে এত দুর্বলের মতো সমর্পণ করছেন পাশ্চাত্যের চিন্তাধারা ও রীতিনীতির কাছে। কেন আপনারা, যাদের পূর্বপুরুষরা একদিন এমন একসময়ে পৃথিবীকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার আলোকে উদ্ভাসিত করেছিলেন যখন ইউরোপ নিমজ্জিত ছিল চরম বর্বরতা ও অজ্ঞতার মধ্যে; এখন সাহস সঞ্চয় করতে পারছেন না আপনাদের আপন প্রগতিশীল উজ্জ্বল ধর্মাদর্শের দিকে ফিরে যাওয়ার? এ কী করে সম্ভব হলো যে, আতাতুর্ক, সেই নগণ্য মুখোশধারী ব্যক্তিটি, যে ইসলামের কোনো মূল্য আছে বলেই স্বীকার করে না, মুসলমানদের কাছে সে হয়ে উঠেছে ‘মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রতীক?’

‘আমাকে বলুনÑ এ কেমন করে হলো, আপনাদের নবীর আনীত ধর্মাদর্শ এবং এর সব সরলতা ও স্বচ্ছতা আপনাদের আলেমদের বন্ধ্যা ধ্যান-ধারণা ও কূটতর্কের জঞ্জালের নিচে চাপা পড়ে গেল? এ কেমন করে হলো, আপনাদের রাজা-বাদশাহ এবং বড় বড় জমিদাররা ধন-ঐশ্বর্য ও বিলাসিতার মধ্যে ফুর্তিতে মাতলামি করছে, যখন তাদের বিপুলসংখ্যক মুসলিম ভাই কোনো রকমে জীবন ধারণ করছে অনির্বচনীয় দারিদ্র্য ও নোংরা পরিবেশেÑ যদিও আপনাদের নবী সা: শিখিয়েছিলেন ‘কোনো মানুষই দাবি করতে পারে না সে মুমিন, যদি সে নিজে পেটপুরে খায় যখন তার প্রতিবেশী থাকে ক্ষুধার্ত?’ আপনি কি আমাকে বোঝাতে পারেন, আপনারা কেন স্ত্রীলোকদের ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন জীবনের পশ্চাদভূমিতে, যদিও নবী ও তাঁর সহচরদের চার পাশে যেসব মহিলা ছিলেন, তারা তাদের পুরুষদের জীবনে অংশগ্রহণ করেছিলেন ব্যাপকভাবে? এ কেমন করে হলো, আপনারা-মুসলমানদের মধ্যে এত বেশি লোক অজ্ঞ এবং অতি সামান্য সংখ্যক মানুষই কেবল লিখতে ও পড়তে পারেÑ যদিও আপনাদের নবী ঘোষণা করেছিলেন, ‘জ্ঞান অনুসন্ধান করা প্রত্যেক মুসলিম নর ও নারীর জন্য বাধ্যতামূলক পবিত্রতম কর্তব্য,’ যদিও তিনি বলেছিলেন, কেবলই যে ব্যক্তি ধার্মিক তার ওপর জ্ঞানী মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অন্য সব তারার ওপর পূর্ণিমার চাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের মতো?’ (‘মক্কার পথ’ পৃষ্ঠা-৩১২)
উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে মুসলমানদের করুণ চিত্রটি আসাদ কিভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। অনুভব করা যায়, তিনি ইসলামের শিক্ষা ও প্রাণসত্তাকে কত গভীর থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। মুসলিম উম্মাহর দুর্দশার কারণটা তিনি এত গভীর অথচ সহজভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তা ভাবলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। অথচ এই মূল কারণটা বুঝতে সক্ষম হননি জন্মসূত্রে মুসলিম নামধারী বহু তথাকথিত পণ্ডিত ও বিজ্ঞজনরা। এটাকেই বোধহয় বলা যায় ঈমানের নূর, আল্লাহ যা কাউকে দান করলে সত্য তার সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে; মিলিয়ে যায় মিথ্যা ও সংশয়ের কুহেলিকা। মোহাম্মদ আসাদের ভেতর ঈমানের সেই প্রদীপ্ত নূর দিয়েছিলেন আল্লাহ তায়ালা। ফলে তিনি পশ্চিমা সভ্যতার অসারত্ব যেমন সহজেই বুঝেছিলেনÑ যেহেতু তিনি ওই সভ্যতায়ই বেড়ে উঠেছিলেন, তেমনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণাঙ্গতার বিষয়টিও বুঝেছিলেন হৃদয়ের গহিনে। দ্বিধাহীন চিত্তে তাই তিনি বলতে পেরেছেনÑ ইসলামই একমাত্র প্রগতিশীল ধর্ম।

 

‘ইসলাম গ্রহণের পর থেকেই আসাদ আধুনিক বিশ্বে ইসলামের অবস্থান নিয়ে পুনঃমূল্যায়নের প্রচেষ্টা চালান এবং মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনের কারণ অনুসন্ধানে ব্রতী হন। ইসলামের গৌরবময় অতীত এবং চরম বেদনাদায়ক বর্তমান নিয়ে ‘বুদ্ধিবৃত্তিক নিরীক্ষা’ চালিয়ে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ইসলাম যেরূপ ছিল এখনো সেরূপ আছে, মুসলমান জাতিই নিজেদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে হতভাগ্য জাতিতে পরিণত হয়েছে। তিনি দেখেন, ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রথম থেকেই কয়েকটি ধর্মীয় মূলনীতির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। সেই মূল নীতিগুলো থেকে দূরে সরে পড়ার কারণেই মুসলমানদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরাজয় শুরু হয়। ইসলামের চেয়ে উন্নত নৈতিক ব্যবস্থা এবং মানবীয় ভ্রাতৃত্বের ধারণা অন্য কোনো সভ্যতা বা আদর্শ দিতে পারেনি। অথচ পাশ্চাত্য এই ধর্মকেই অনাধুনিক ও অপ্রয়োজনীয় বলে প্রচার করে থাকে।
মুহাম্মদ আসাদ তার গভীর পর্যবেক্ষণের পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, ধর্মাদর্শের ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ গড়ে উঠলেও মানুষের চাহিদা অনুযায়ী এমন বাস্তবানুগ জীবন পদ্ধতি দ্বিতীয়টি নেই। একমাত্র ইসলামই মানুষের অশেষ সম্ভাবনার কথা বলেছে, তেমনি মানবীয় দুর্বলতাগুলোর দিকেও ইঙ্গিত করেছে বহুকাল আগেই। সুতরাং ইসলামই প্রকৃতপক্ষে, একমাত্র প্রগতির ধর্ম।
তিনি দেখেছেন, বর্তমানকালে শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রাচুর্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের অবস্থান দেখে অনেক মুসলমান পর্যন্ত এ ধারণা করে ফেলেছে যে, ইসলামের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বর্তমান যুগে একবারেই অচল হয়ে পড়েছে। ইসলামের শিক্ষাই এ অধঃপতনের জন্য দায়ী (!)। ব্যাপার হলোÑ এসব ব্যক্তি এ ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে কোনোরূপ ধারণা রাখে না এবং ধারণা নেয়ার চেষ্টাও করেনি কখনো। আসাদ ইসলামী শরিয়াহর বিশ্লেষণ করে এ বিষয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছেন, মানব প্রগতির কোনো ক্ষেত্রেই ইসলাম কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি।

তিনি প্রমাণ করেছেন, পাশ্চাত্য সভ্যতা হচ্ছে অধর্মমূলক। এ সভ্যতা মানবজীবনকে পুরোপুরি বস্তুবাদী ও ইহজগতমুখী করে ফেলে। খ্রিষ্টধর্মের অসারতা এবং যাজকতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতা আর ভণ্ডামির কারণেই পাশ্চাত্যের এ ধর্মবিরোধী অবস্থান। আসাদ বলেন, পাশ্চাত্য সভ্যতার অনুকরণের মধ্যে রয়েছে একধরনের হীনম্মন্যতাবোধ। এ হীনম্মন্যতাবোধ তখনই প্রবল হয় যখন নিজের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা থাকে না। এ অবস্থাটাই মুসলিমদের ইসলামবিমুখ করে তুলেছে। মুসলিম তরুণদের শিক্ষাপ্রণালী হতে হবে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে ইসলামের ধারণা যদি শিক্ষার সাথে সমন্বয় না করা যায় তবে মুসলিম তরুণরা ধর্মহীনতার দিকেই ছুটে যাবে।’ (মুহাম্মদ আসাদ : আধুনিক যুগে ইসলামী পুনর্জাগরণের বহুমুখী কারিগর : প্রফেসর ড. ইফতিখারুল আলম মাসউদ, প্রফেসর আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয় )

১৯৯২ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি তিনি এ নশ্বর জগৎ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যান তার মহান প্রভুর কাছে। তার মৃত্যু নিয়ে ‘মক্কার পথ’ বইটির অনুবাদক ও প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক শাহেদ আলীর মন্তব্য নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘মুসলিম বিশ্বের আকাশ থেকে প্রজ্ঞা ও মনীষার উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটি খসে পড়ে ১৯৯৪ সালে। পশ্চিমা জগতের দৃষ্টিতে এ নক্ষত্রটির আলো ছিল প্রখর, চোখধাঁধানো; তাই তারা প্রায় শতাব্দীকাল একে চোখের সামনে দেখেও না দেখার ভান করেছে। এই মনীষী জন্মগ্রহণ করেছিলেন পশ্চিম ইউরোপীয় পরিবেশে। অথচ তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর বর্তমান পাশ্চাত্য সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন- এর বাহ্য জাঁকজমকের অন্তরালে লুক্কায়িত অতলগর্ভ শূন্যতাকে দুনিয়ার সামনে উদঘাটিত করে দিয়েছিলেন। এ জন্য পাশ্চাত্য জগৎ তাকে বরাবর বিরক্তির সাথে উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছে।’

আসাদের মৃত্যুর খবর কোনো প্রচার পায়নি পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমে। যেহেতু তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাই পশ্চিমা বিশ্বের প্রচারমাধ্যমগুলো তাকে বলা যায় কিছুটা ‘গায়েব’ করেই ফেলেছে। আর মুসলমানদের নিজস্ব প্রচারমাধ্যম তো নেই বললেই চলে। ফলে এমন একজন গুণী-পণ্ডিত-দার্শনিক ও চিন্তাবিদকে মুসলমানরা খুব কমই চিনেÑ হাতেগোনা কিছু লোক ছাড়া। রাতকানা মানুষ যেমন চাঁদ-নক্ষত্র কিছুই দেখে না, অন্ধ যেমন সূর্য দেখে না, তেমনি মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টিতে এ নক্ষত্রের কিরণের জ্যোতি কখনো পুরোপুরি প্রতিবিম্বিত হয়নি। তাই আকাশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটি খসে পড়লেও তার কোনো শূন্যতা মুসলিম বিশ্ব অনুভব করেনিÑ সূর্য বা নক্ষত্রের উদয়-অস্তে অন্ধের কিছুই আসে-যায় না। তাদের নিজস্ব কোনো প্রচারমাধ্যম নেই। যা কিছু আছে, তাতেও এই মৃত্যু তেমন কোনো গুরুত্বই পায়নি। তার নাকি অছিয়ত ছিলÑ তাঁর কবর যেন হয় মক্কায়, যেখানে তিনি দীর্ঘ দিন বসবাস করে ইসলামকে আবিষ্কার করেছিলেন, ইসলামের সেরা ব্যাখ্যাতা এবং প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন, ইসলাম কবুল করে সারা বিশ্বের মোকাবেলায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরেছিলেন, লিখেছিলেন Road to Mecca -‘মক্কার পথের’ মতো বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই। কিন্তু তার সে সাধ পূরণ হয়নি। তিনি স্পেনে ইন্তেকাল করেন এবং গ্রানাডার ঐতিহাসিক মসজিদের পাশেই তাকে দাফন করা হয়।

মুহাম্মদ আসাদের জীবনবোধ ও বিশ্বাসের কেন্দ্রে যে বিষয়টি উল্লেখ করার মতো, তা হচ্ছে ‘মানুষের অতৃপ্তি’। তিনি তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘লোভ মানুষের সবসময়ই ছিল। কিন্তু এর আগে লোভ কখনো জিনিসপত্র সংগ্রহের কেবল একটা আগ্রহকে ছাপিয়ে উঠতে পারেনি এবং এমন নেশা হয়ে উঠতে পারেনি, যা অন্য সব কিছুর প্রতি দৃষ্টিকে করে দেয় ঝাপসা; একটি অদম্য বাসনাÑ অধিক পাওয়ার, অধিক করার, অধিক ফন্দি আঁটার, গতকালের চেয়ে আজকে বেশি এবং আজকের চেয়ে আগামীকাল বেশি। একটি দানব সওয়ার হয়েছে মানুষের কাঁধের ওপরে এবং তাদের হৃদয়ে চাবুক কষে হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এমন সব লক্ষ্যের দিকে যা ঝলমল করছে দূরে, বিদ্রƒপাত্মকভাবে এবং যখনি তার কাছে যাওয়া হচ্ছে, তা মিলিয়ে যাচ্ছে তুচ্ছ শূন্যতায়। সবসময়ই প্রতিশ্র“তি দিচ্ছে, সামনে রয়েছে নতুন নতুন লক্ষ্যÑ আরো অধিক উজ্জ্বল, আরো অধিক প্রলোভন জাগানো লক্ষ্য, যতক্ষণ না সেগুলো দিগন্ত সীমানায় রয়েছে এবং কব্জায় আসার সাথে সাথে অনিবার্যভাবে আবার হারিয়ে যাচ্ছে নতুন শূন্যতায় এবং সেই ক্ষুধা, সেই অতৃপ্ত ক্ষুধা, নিত্যনতুন লক্ষ্যের জন্য যা চিবিয়ে খাচ্ছে মানুষের আত্মাকে। না, যদি তোমরা জানতে তোমরা দেখতে পেতে সেই জাহান্নাম, যার মধ্যে তোমরা রয়েছ।

আমি দেখতে পেলাম, দূর আরবের সুদূর অতীতের কোনো মানুষের মানবিক প্রজ্ঞামাত্র এ নয়। তিনি যত প্রজ্ঞাবানই হন, এ রকম একজন মানুষের পক্ষে কিছুতেই আপন শক্তিতে এই বিশ শতকের নিজস্ব যন্ত্রণা আগাম দেখা সম্ভব ছিল না। কুরআন থেকে উচ্চারিত হলো একটা কণ্ঠস্বর, যা বৃহত্তর মহত্তর মুহাম্মদের কণ্ঠস্বর থেকে...।’ (মক্কার পথে, পৃষ্ঠা ৩২৩-৩২৫)

এ মহাগ্রন্থ কুরআন যে মানব রচিত নয়, এ ব্যাপারে তার আস্থা আরো বেড়ে গেল। আজকের লন্ডন, দুবাই, প্যারিস বা সিঙ্গাপুরের মার্কেটগুলো মুহাম্মদ আসাদের সেই অনুভূতিকে আরো প্রকটভাবে দৃশ্যমান করে তুলছে, তবে আসাদের মতো দৃষ্টিসম্পন্ন দর্শক কোথায়? মার্কেটগুলোর দিকে চোখ ফেললে ভোগ আর বাসনা পূরণ ছাড়া মানবজীবনে আর কোনো কাজ আছে এমনটি মনে হয় না। শুধুই মনে হয়, ‘খাও দাও ফুর্তি করো, দুনিয়াটা মস্ত বড়, আগামীকাল বাঁচবে কি না বলতে পারো’- এই দর্শনেরই বাস্তব রূপ যেন সর্বত্র।

উম্মাহকে তাই ঘুরে দাঁড়াতে হলে আসাদের মতো নিখাদ বিশ্বাসের অধিকারী হতে হবে ইসলামের মৌলিক বিষয়ে, এর অসাধারণ শ্রেষ্ঠত্ব ও পূর্ণতার প্রতি! এটি কেবল দোয়া-তাবিজ বা আনুষ্ঠানিক কয়েকটি আচার উপাসনার ধর্ম এই বিকৃত বিশ্বাস মুছে ফেলতে হবে হৃদয় থেকে। আজকের অশান্ত, ভোগবাদী, স্বৈরতান্ত্রিক ও বস্তু পূজারী বিশ্বকে তখনই কেবল শাশ্বত শান্তি ও সুখের পথ দেখানোতে তারা নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে- যা তাদের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব। ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানব জাতির কল্যাণের জন্য, তোমরা মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের নির্দেশনা দেবে এবং অন্যায় ও অসত্য থেকে বিরত রাখবে।’ (আল কুরআন )

জুলাই মাস ক্ষণজন্মা এই মহামনীষীর জন্মবার্ষিকী। ভুলে যাওয়া এই নকিবকে মনে করিয়ে দেয়ার একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা এই প্রবন্ধটি। (শেষ)


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us