ইমাম আবু হানিফা ও এক মুচির ঘটনা

আজিজুল হক মুরাদ | Aug 07, 2020 06:46 pm
ইমাম আবু হানিফা সমাধি ও মসজিদ

ইমাম আবু হানিফা সমাধি ও মসজিদ - ছবি : সংগৃহীত

 

ইমাম আবু হানিফা রহ: মুসলিম উম্মাহর একজন মহান ইমাম হিসেবে যেমন জ্ঞানের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন, তেমনি রুহানি জগতে তার বিচরণ ছিল অত্যন্ত উচ্চমার্গের। একদিন তিনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।

পথিমধ্যে শুনতে পেলেন, লোকেরা বলাবলি করছে, এই যে আমাদের ইমাম যাচ্ছেন, যিনি সারা রাত জেগে আল্লাহর ইবাদত করেন। তখনো তিনি সারা রাত জেগে ইবাদত করতেন না। কিন্তু লোকদের সুধারণা যেন ভুল প্রমাণিত না হয়, সেই থেকে তিনি প্রায়ই সারা রাত জেগে ইবাদত বন্দেগি করতেন। আর দিনের বেলায় জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি নিজের ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনা বা দেখাশোনা করতেন। নিজ বাড়ির ছাদে একাকী দীর্ঘ নামাজ আদায় করতেন, কেঁদে কেটে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বাড়াতেন। তার বাড়ির পাশে প্রতিবেশী ছিল এক দরিদ্র মুচি। জুতা মেরামত ও সেলাই করা ছিল তার কাজ। নেশায় অভ্যস্ত ছিল লোকটি। সেই যুগেও গোপনে গোপনে কোথাও না কোথাও মদপানের চর্চা ছিল। সে কারণে সেও নেশা করত। সারা দিন যা উপার্জন করত, তা দিয়ে মদ কিনে সারা রাত মদ্যপ অবস্থায় নাচগান ও হই-হুল্লোড় করত।

ইমাম আবু হানিফা তার এ আচরণ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলেন। কিছুই বলতেন না। হঠাৎ এক রাতে বাড়িটি থেকে কোনোরূপ হই-হুল্লোড় না আসায় ইমাম সাহেব অবাক হলেন। সকালে লোকটির খোঁজে বাড়িটিতে প্রবেশ করলেন। মনে করেছিলেন লোকটা বুঝি অসুস্থ। ইমাম সাহেবকে দেখে বাড়ির লোকেরা কিছুটা আশ্চর্য হলো। তারা জানাল, লোকটির দৈনন্দিন অনাচারের কারণে সবাই ত্যক্তবিরক্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে শহরের প্রশাসকের কাছে নালিশ করেছে। এতে সৈন্যরা এসে লোকটিকে আটক করে নিয়ে গেছে। ইমাম সাহেব এ কথা শুনে সরাসরি প্রশাসকের কাছে চলে গেলেন। ইমাম সাহেবের আগমনে প্রশাসক বিব্রত হয়ে নিবেদন করলেন, হুজুর! আপনি কেন কষ্ট করে এসেছেন? আপনি হুকুম করলেই তো আমি আপনার দরবারে চলে আসতাম।

ইমাম সাহেব বললেন, আমি আমার দায়িত্ব পালন করতে এসেছি। প্রশাসক বললেন, আমার জন্য কী হুকুম, হুজুর? বললেন, আমার প্রতিবেশী মুচিকে আপনার সৈন্যরা আটক করেছে। প্রশাসক জানালেন, জ্বি, হুজুর। ওই লোকটির পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে আমি তাকে গ্রেফতারের আদেশ দিয়েছি এবং জেলে বন্দী করে রেখেছি। ইমাম সাহেব বললেন, আপনি তাকে ছেড়ে দিন। প্রশাসক বললেন, ঠিক আছে, হুজুর। আপনি বাড়ি চলে যান। তাকে ছেড়ে দেবো, সেও বাড়ি চলে যাবে।

ইমাম সাহেব বললেন, না। আমি তাকে সাথে নিয়ে যাবো। প্রশাসক লোকটিকে জেলখানা থেকে বের করে আনার আদেশ দিলেন। লোকটি এসে ইমাম সাহেবকে দেখে ভয়ে তটস্থ হয়ে চিন্তা করতে লাগল, আবার ইমাম সাহেব আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ নিয়ে এসেছেন আল্লাহ মালুম। প্রশাসক লোকটিকে বললেন, যাও। ইমাম সাহেবের হুকুমে তোমাকে মুক্তি দেয়া হলো। ইমাম সাহেব লোকটিকে সাথে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন এবং পথিমধ্যে তাকে কিছুই বললেন না। কোনো প্রকার নসিহতও করলেন না। বাড়ি এসে শুধু বললেন, যাও। তুমি তোমার ঘরে যাও।

পরদিন রাতে বাড়িটি ছিল একেবারে নীরব সুনসান। কোনো রকম হই-হুল্লোড় পাওয়া গেল না। রাত অতিবাহিত হওয়ার পর ইমাম সাহেব আগের মতো লোকটির বাড়ি গেলেন এবং দরজায় কড়া নাড়লেন। বাড়ির লোকেরা দরজা খুলে দিলো। ইমাম সাহেব দেখলেন, ওই মুচি লোকটি জায়নামাজে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কান্নাকাটি করে নামাজ আদায় করছে। নামাজ শেষে লোকটি ইমাম সাহেবকে দেখতে পেল। ইমাম সাহেব অপেক্ষা করছিলেন, আর লোকটি দৌড়ে এলেন। ইমাম সাহেব বললেন, তোমার কী অবস্থা জানতে এসেছি। আজ কোনো শব্দ পেলাম না সে জন্য। আশঙ্কা করলাম, তোমার পরিবার তোমার সাথে আবার দুর্ব্যবহার করল না তো!

লোকটি বলল, ইমাম সাহেব, আল্লাহু আকবর! সমগ্র উম্মতের ইমামের ভালোবাসার নেশা পান করার পর আমি অধমের অন্য সব নেশা কেটে গেছে। আপনি ভালোবাসার যে নেশা পান করিয়েছেন, যে সম্মান দিয়েছেন। আমি ছিলাম এই শহরের সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানুষ। সবাই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত আমাকে।

সেই বেদনায় দুশ্চিন্তা ভুলতে মদপান করতাম। এখন পুরো দুনিয়ার ইমাম আমাকে সম্মান দিচ্ছেন। আমার মতো সম্মানীয় আর কেউ নেই মনে হচ্ছে। তাই এখন আমার অন্য কোনো নেশার দরকার নেই।
প্রিয় ভাইয়েরা, এ ঘটনা থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা হচ্ছে, আজকের দিনে দুনিয়াদার লোকেরা দ্বীনের জন্য কোনো বড় সমস্যা নয়। প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে, ওইসব লোক, যাদেরকে আমরা দ্বীনদার মনে করি, দ্বীনদারির লেবাস পরে আছে যারা, তারাই। এখন মুসলমানদের আসল মুসিবত হলো, মিথ্যা ও বানোয়াট দ্বীনদারি।

যতক্ষণ আমরা নিজের আমিত্বকে মিটিয়ে না দেবো, যতক্ষণ অহমিকা পরিত্যাগ না করব ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে প্রকৃত ও পরিপূর্ণ দ্বীনদারি আসতে পারে না। খারাপ বা মন্দ অভ্যাসে অভ্যস্ত লোকদের ভালোবাসার চাদরে আবৃত্ত করতে পারলে তারাও ভালো পথে ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ। আর এ দায়িত্ব পালন করতে হবে সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের। আল্লাহ আমাদের ইমামে আজম তথা মহান ইমামকে অনুসরণ করার তৌফিক দিন! আমীন!

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us