ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের মুসলিম হওয়ার কাহিনী

উম্মেহানী বিনতে আবদুর রহমান | Aug 10, 2020 04:03 pm
ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের মুসলিম হওয়ার কাহিনী

ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের মুসলিম হওয়ার কাহিনী - ছবি : সংগৃহীত

 

দুনিয়ার মোহ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আল্লাহকে পাওয়ার বাসনার কাছে জীবনের সব বাধা ক্ষীণ। সৃষ্টিকর্তার সান্যিধ্যের খোঁজে কিছু হৃদয় গলতে চায়, জ্বলতে চায়, কারণ এ অস্থিরতা ও ব্যাকুলতায় আছে তৃপ্তি-পরিতৃপ্তি।

প্রত্যেক জাহেলিয়া কর্মে রয়েছে ঘনঘটা আঁধার, যাদের চোখে পর্দা পড়ে গেছে তারা সে আঁধার দেখতে পায় না, আঁধারকে যে আলো ভেবে গোটা জীবন কাটিয়ে দেয় তার মতো হতভাগ্য আর কে আছে? কিছু পবিত্র হৃদয় অন্ধকারে থেকেও আলোক রশ্মি হাতড়ে বেড়ায়, তারা তাদের জীবনের তৃপ্তি খোঁজে-ফিরে পিপাসার্ত পথিকের মতোন, ঠিক তখনই অন্ধকার থেকে বের হওয়ার লড়াই চলে সেসব হৃদয়ে, এরপর সে হৃদয় নূরের পথের অপেক্ষায় থাকে, যখন রবের ডাক আসে তখন সে হৃদয় ছুটে চলে, ছুটে চলে পরম শান্তি ও প্রশান্তির খোঁজে।

সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে যে শিশুর শুরু, জন্ম থেকেই যে মানুষটি শিরক, কুফরে লালিত হয়েছে, যার শৈশব-কৈশোর এবং যৌবন কেটেছে নানা পূজা-অর্চনায়, যার মনমস্তিষ্কজুড়ে শুধু হিন্দুত্বের সংস্কৃতি, অতঃপর পাণ্ডিত্য ডিগ্রি অর্জন, কী করে সে ব্যক্তিটি দ্বীনে ফিরল সে আলোচনাই এ লেখার মুখ্য বিষয়।
হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ বংশের মর্যাদা শীর্ষে। ব্রাহ্মণরা চাইলে যে কাউকে একঘরে করে দিতে পারেন, তাদের সামনে অন্য তিন জাতের (ক্ষত্রিয়, বৈস্য, শূদ্র) লোকেরা মাথা নিচু করে রাখতে বাধ্য, হিন্দু সমাজের সব সুযোগ-সুবিধা এই ব্রাহ্মণদেরই যেন প্রাপ্য। সামাজিক বৈষম্য রক্ষায় ব্রাহ্মণ সমাজ দৃঢ়প্রত্যয়। যা কিছুই হোক না কেন নিজেদের মান মর্যাদার কাছে সব কিছু তুচ্ছ, কঠোরতায় পরিপূর্ণ এ ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান পণ্ডিত থেকে মুসলিম হওয়া যে কত কঠিন তা চিন্তা করলে যে কারোরই বোধগম্য হবে।

ব্রাহ্মণ পরিবারের মানুষজন সব কিছুতেই একরোখা ও অতি ধর্মপ্রাণ। তারা যা করতে চাইবে তা পূরণে হৃদয় মন যত কষ্টই পাক না কেন এটা তাদের ধর্তব্য না, এমনি এক কঠিন মানুষ ব্যারিস্টার নগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। ব্যারিস্টার নগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ও কুসুম কুমারী দেবীর ছয় সন্তান। এ ছয় সন্তানের মধ্যে স্বপন কুমার তৃতীয় সন্তান। বাবা-মায়ের ইচ্ছে স্বপন কুমার পণ্ডিত হবে এবং ব্রাহ্মণ বংশের মর্যাদা রক্ষায় ভূমিকা রাখবে। এ বিবেচনায় সাত বছরের ছোট্ট স্বপন কুমারকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কলিকাতায় আত্মীয়ের বাড়ি। জন্মভূমি ছেড়ে বিশাল এক স্বপ্নই স্বপন কুমারের এখানে আসার কারণ। মায়ের জন্য মানসিক অস্থিরতা তার স্বপ্ন পূরণে পরিশ্রমের পেছনে জাদুর মতো কাজ করল যেন। পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী হলো আরও বেশি।

পর্যায়ক্রমে মাধ্যমিক এরপর উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে সংস্কৃত ভাষার ওপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর সেই লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য প্রস্তুতিস্বরূপ ধর্মবিষয়ক প্রতিষ্ঠান চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্গত খরদহে অবস্থিত সাংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে (টাল) ভর্তি হতে হয়, এখানে বেদ-এর পাণ্ডিত্য অর্জনে কেটে যায় কয়েকটি বছর। স্বপন কুমারের শিক্ষক ছিলেন তৎকালীন ভারতের ৫০ লাখ হিন্দুদের দেবতা এবং খরদহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ভগবান শিবশক্তি। বলা বাহুল্য, ভগবান শিবশক্তি মহান রবের ইচ্ছায় সপরিবারে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। পরে যার নাম হয় ডক্টর ইসলামুল হক্ব।

সদ্য পণ্ডিত স্বপন কুমার। বেদের গবেষণায় তার মন-মস্তিষ্ক একাকার যেন। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ চারি বেদের অন্যতম অথর্ব বেদের একবিংশ নম্বর শলোকটি (যাহা গুরুমন্ত্র হিসেবে প্রযোজ্য) তার হৃদয়ে সৃষ্টি করেছে সবুজ ঘাসে শিশির ছোঁয়ার এক আবরণী রূপরেখা। যথাক্রমে শলোক “লা ইলাহাং হরতিঃ পাপং, ইল্লোঃ ইলাহাং পরম্ পদং, জন্ম বৈকুণ্ঠ পরঃ, তপঃ ইনু, তাতং, আদ্য অক্ষরং ‘ম’ অন্তঃ অক্ষরং ‘দ’ নরত্তোমম নরাশংস জপি নামো মুহাম্মাদাং, মরুর স্থলং বাসিনিং”

যে অর্থ সর্ব পণ্ডিতজন বিদিত বিধায় এখানে উল্লেখ্য করলাম না।

পণ্ডিত স্বপন কুমারের বিচলিত মন, স্রষ্টার খোঁজে মন উচাটন; হৃদয়ের এ অস্থিরতা যেন হক্বের যাত্রা পথের শুরু। মাল্য অভিষেকেসদ্য পণ্ডিত স্বপন কুমারকে বরণ করে নিলো সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারটি, স্বপ্ন পূরণ করে স্বপন কুমার এখন পণ্ডিত তাই পূজার মাধ্যমে স্বপন কুমারকে পরিবার এবং গ্রামের সাধারণ হিন্দুও স্বাগতম জানাতে কৃপণতা করেনি, সাক ঢাকের মাধ্যমে জমজমাট পূজার আয়োজন করা হলো- ব্রাহ্মণ পরিবারের প্রথানুযায়ী প্রথমে ভগবান এরপর অন্যরা এ আয়োজনের মিষ্টান্নসহ অন্যান্য খাবারের স্বাদ গ্রহণ করবে।

এতবড় আয়োজন যার জন্য তাকে পূজার জন্য তৈরি করারও একটি নিয়ম বা কুসংস্কার যাই বলি না কেন, তাও আছে এ পরিবারটিতে। তাই স্বপন কুমারকে গঙ্গার পানি ও পঞ্চগব্য দ্বারা ধৌত করা বাড়ির মন্দিরে কিছু সময় নির্জনতার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত রাখা হলো। কয়েক ঘণ্টা অতিক্রান্ত হওয়ার পর পূজার জন্য স্বপন কুমার তৈরি।

তখন দরজা খুলে স্বপন কুমারকে নিতে এলো পরিবারের সদস্যরা, কিন্তু একি- খাবারের ভরপুর থালাগুলো খালি কী করে, মমতাময়ী মা হতবাক, মুহূর্তের মধ্যেই খবর পৌঁছে গেছে পরিবারের প্রধান ব্যক্তি স্বপন কুমারের পিতা ব্যারিস্টার নগেন্দ্রনাথের কাছে, পিতার মনে তখন প্রশ্ন- এতবড় অন্যায় সদ্য পণ্ডিত ছেলেটা কী করে করতে পারল? এ যে কুলক্ষণ, এ যে অধর্মের কাজ। নাহ পিতার বোধগম্য হয় না স্বপন এ কাজ করেছে। ছুটে এলেন নগেন্দ্রনাথ। মন্দিরে এসেই গুরুগম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ভগবানের সাথে এ বেয়াদবি কী করে করলে তুমি?

কিছুক্ষণ নীরব থেকে, অত্যন্ত শান্তকণ্ঠে স্বপন কুমার বলল, শ্রদ্ধেয় পিতা আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম এবং দরজা খোলামাত্রই জেগেছি, তবে ভগবান তো জেগেছিলেন পূর্বেও আর এখনো, সুতরাং এ সম্পর্কে তো ভগবানই উত্তর দিতে পারবে, হয়তো ভগবান ভক্ষণ করেছে নয়তো যে করেছে তাকে ভগবান দেখেছে, আপনারা যদি তার কাছে জানতে চাইতেন আমি আশা করি তিনি সঠিকটা জানাবেন। এতক্ষণে লোকজনে ভরপুর মন্দির এবং বাড়ি।

চুপসে থাকা পিতা এখন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, স্বপন, তুমি কি মজা করছ? তুমি কী করে বলছ মাটির একটি মূর্তি খাবার খাবে আর আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবে? তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না স্বপন!

সদ্য পণ্ডিত স্বপন কুমার বললেন, আপনার কথা অনুযায়ী যদি ভগবান উত্তর দিতে অক্ষম হয় তবে কী মাটির তৈরি এ স্রষ্টাপূজা বৃথা নয় হে পিতা? স্বপন কুমারের কথা শেষ হতে না হতেই হইচই পড়ে গেছে সবার মধ্যে, পণ্ডিত হয়ে এ কি অধর্মের কথা মুখে উচ্চারণ করছে স্বপন কুমার। এ কথা, সে কথা, কত কথা সবার! স্বপন কুমার আরো কিছু কথা যোগ করল এ সুযোগে- ‘আমি বেদের পণ্ডিত, তাই বেদ সম্পর্কে আমার চেয়ে ভালো আপনারা জানেন না, বেদের মধ্যে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ রয়েছে, সৃষ্টিকর্তা একজন, আর আমরা যেভাবে সৃষ্টিকর্তার আকার তৈরি করি, পূজা করি সেভাবে তিনি প্রকাশিত নয়।’ স্বপণ কুমারের এ কথাগুলো তার অস্থির অতৃপ্ত হৃদয়ের কিছু গুপ্ত উক্তিরই প্রকাশ ছিল মাত্র।

সবার সামনে পণ্ডিত ছেলের এমন অধর্মের উক্তিতে অগ্নিশর্মা পিতার ধৈর্যের বাঁধ যেন ছিন্নভিন্ন। এইবার রাগে টেনেহিঁচড়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে উত্তম মধ্যম দিলেন তার পিঠে। পিতা যখন ঘর্মাক্ত দেহ তখন শিথিল হলো বেতের চলমান আঘাত। মমতাময়ী মায়ের দৌড়ঝাঁপ ছেলের অচল দেহ সচল করার সেবায়। সুউচ্চ ব্রাহ্মণ পরিবারের বউয়ের চোখে আজ বাঁধহীন অশ্রু। এ যেন কৃষকের আবাদি ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরিতাপ, হয়তো এর চেয়েও বেশি কিছু। মা যে, সন্তানের দুঃখের জন্য মায়ের মনের অবস্থার নিরূপণ কি কোনো শব্দেগুচ্ছে সম্ভব?

অতঃপর, কেটে গেল কয়েক দিন। গ্রামের উচ্চবিত্ত নিম্নবিত্ত এবার সবার এক দাবি- নব্য পণ্ডিতের মুখে ধর্মগ্রন্থের বাণী শুনবে তারা। পণ্ডিত ও যেন এ সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। বাড়ির মন্দিরের সামনে স্বপন কুমার দণ্ডায়মান। বলতে আরম্ভ করলেন তিনি- একটি গ্রামের চেয়ারম্যান যেমন দু’জন হতে পারেন না, একটি দেশের প্রধান যেমন দু’জন হতে পারেন না, ঠিক তেমনি করে সার্বিক আধিপত্য বিস্তারকারী নিয়ন্ত্রক দু’জন হতে পারেন না। তিনি একক, তাঁর আকার নেই, অদৃশ্যে ব্যাপ্তি তাঁর, আমরা তাঁকে যেভাবে আকার প্রদান করি তিনি সেভাবে প্রকাশিত নন। স্রষ্টা অবশ্যই হবেন তিনি যিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।
এদিকে সবার প্রশ্ন- এ কি বলছে এ পণ্ডিত? পণ্ডিতরা তো অধর্মের কথা বলে না, বলে তো ধর্মের কথা, এ পণ্ডিতের ভাষায় এ কি ধরনের নিচ কথা বের হচ্ছে। এ তো শোনাও পাপ। অভিযোগ সাথে সাথে বাতাসের মতোন চলে গেল নগেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির কাছে। ছেলের কথা আর আচরণে বিগত কয়েক দিন যাবৎ এমনিতেই তিনি ছিলেন বিরক্ত। আর সেদিন এত আঘাতের পরও আজ তার মুখে এসব কথা আবার।

এ তো বাড়াবাড়িতে পরিণত হয়েছে। নাহ আর সহ্য করা যায় না। প্রয়োজনীয় কাজে বাড়ির বাইরে থাকা মানুষটি দ্রুত বাড়ি ফিরলেন। স্বপন কুমারের বড় দুই ভাই পিতার রাগান্বিত অবস্থায় আরো পেট্রল ঢালল যেন। এরপর সবাই মিলে পণ্ডিতকে বন্দী করল ঘরের ভেতর। এরপর রক্তের মানুষজন অবর্ণনীয় মারপিট নির্যাতন চালাল স্বপন কুমারের ওপর। পিতা-ভাইদের অত্যাচারের পরও স্বপন কুমারের হৃদয় আকাশে নূর জ্বলতে শুরু করল। অন্য দিকে ব্রাহ্মণ বংশের কঠোরতা এমন হলো তারা স্বপন কুমারকে নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত হলো- স্বপন কুমারের মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটাতে হবে। ওই চিন্তা থেকে স্বপন কুমারের মাথায় কাচের আঘাত করা হলো দফায় দফায়।

স্বপন কুমারকে দণ্ড দিতে দিতে যখন তার দেহ নিথর তখন তাকে মেঝেতে ফেলে সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে গৃহ ত্যাগ করল। মমতাময়ী মা তাৎক্ষণিক সবার অলক্ষ্যে স্বপন কুমারকে মুক্ত করতে ঘরে ঢোকেন এবং নিজ হাতে দড়ি খুলে দেন। ঘণ্টাখানেক পর মমতাময়ী মা দরদ মাখা কণ্ঠে বললেন, স্বপন কলিজার টুকরা আমার, তোমার চিন্তায় যিনি স্রষ্টা, আমি প্রার্থনা করি তিনি তোমায় রক্ষা করুন এবং সঠিক পথের নির্দেশনা দিন। অতঃপর আধমরা শরীরের স্বপন কুমারকে মা একটি থলে দিলেন এবং বললেন চলে যাও বাবা, দূরে চলে যাও। এ স্থান, এ রক্তের আত্মীয় তোমার জন্য নিরাপদ নয়। তোমার মতে স্রষ্টা যিনি তিনি তোমায় রক্ষা করুন, আমি তোমাকে সে পথেই দিয়ে দিলাম।

ভারাক্রান্ত জীর্ণশীর্ণ স্বপন যখন বাড়ির পথ পেরিয়ে নদী অতিক্রমরত, ঠিক তখন আপন বড় ভাইয়ের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয় অসহায় স্বপন কুমার। স্বপন কুমার অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে আছেন। তাকে বস্তায় বন্দী করে ফেলে দেয়া হয় ধলেশ্বর নদীতে। স্বপন কুমার জানে না নদীতে তার অবস্থানের সময়কাল কতটুকু বা কী করে গভীর নদী থেকে প্রান্তে পৌঁছাল। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন স্বপন কুমারের চর্মচক্ষুতে নূরানী চেহারার একজন মানব মূর্তি, দাড়িগুলো সাদা-কালো এবং সাদাসিধা একটি পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটি ক্ষীণ হাসি দিয়ে বললেন, কেমন লাগছে এখন? আমি বাধ্যগত একজন ছাত্রের মতো উত্তর দিলাম বেশ ভালো লাগছে, কিন্তু এখানে আমি?


নূরানী চেহারার লোকটি বলল, সব আল্লাহর ইচ্ছা। তিনিই মিলিয়ে দিয়েছেন। তা বাবা, বস্তাবন্দী কেন করা হয়েছিল আপনাকে। শ্বাস-প্রশ্বাস অবশ্য চালু ছিল তখনো, তাই ভাবলাম এই সুযোগে আখিরাতের সঞ্চয় করি, আচ্ছা আপনার শরীরের এমন অবস্থা কেন? স্বপন কুমারের মনে হলো লোকটি যেন আপন কারো ব্যথায় সর্বোচ্চভাবে ব্যথিত, অথচ স্বপন কুমার জীবনে প্রথম তাকে দেখলেন। স্বপন কুমার ভাবলেন- আপন যখন ঘর ছাড়া করল, সর্বোচ্চ নির্যাতনের পর বস্তাবন্দী করে নদীতে ফেলে দিলো তখন শক্তিমান পরম করুণাময় এ প্রশ্বাস চালু রেখেছেন এবং আমাকে ফিরিয়ে এনেছেন এই লোকটিকে মাধ্যম করে, আহ! কি সুন্দর তার পরিকল্পনা, কী রহস্যময় তার কর্ম, তিনি তো আমাকে সর্বক্ষণ দেখছেন, তবে তো আমার হৃদয়ের ঘোর আঁধারের কথা এবং ঘোলা এ অস্বস্তি সম্পর্কেও তিনি জ্ঞাত। অতঃপর যখন নূরানী চেহারার লোকটি স্বপন কুমারের আসল অবস্থার কথা জানতে পারলেন তখন আওলাদে রাসূল সা: মোস্তফা আল মাদানী রহ:-এর কাছে নিয়ে গেলেন।

ঊষর মরুর তপ্ত বালুকায় পিপাসার্ত পথিক যখন কঠিন পিপাসায় ঢুকরে কেঁদে ওঠে তখন অপর্যাপ্ত পানিও সে পিপাসার্ত পথিককে যেমন শান্তি ও তৃপ্তির শীতল স্পর্শ অনুভূতি এনে দেয়, ঠিক তেমনি ব্রাহ্মণ স্বপন কুমার প্রথম সাক্ষাতেই ঈমানের আলোক রশ্মির নতুন পরশে আন্তরিক শীতলতার অনুভূতিতে নিজেকে আবদ্ধ করেন। ১৯৬৮ সালে মুস্তফা আল মাদানির হাতে হাত রেখে ব্রাহ্মণ বংশের পণ্ডিত স্বপন কুমার উচ্চারণ করেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির সনদ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদূর রাসূলুল্লাহ’।

স্বপণ কুমারের নতুন নাম হয় ‘আবদুুর রহমান’। এরপর তাকে সহ্য করতে হয়েছে শারীরিক আঘাত ও প্রচণ্ড মানসিক চাপ, পারিবারিক প্রচেষ্টায় জেলের আঁধার গৃহে তাকে বন্দী থাকতে হয়েছে। আর দুটি গুলি আজও তার হাঁটুর নিচে ঈমানের অগ্নীপরীক্ষা বহন করছে। মহান আল্লাহর জন্য ছাড়তে হয়েছে আপন মা-বাবা, ভাইবোনকে, সহ্য করতে হয়েছে নিজ বংশের নির্মম নির্যাতন এবং নিজ পিতা কর্তৃক হয়েছেন ত্যাজ্যপূত্র। আহ! পৃথিবীর যোগ-বিয়োগের কত চমৎকার সূত্র, শিক্ষা-দীক্ষায় যিনি ছিলেন হিন্দু সমাজের বরপুত্র, ঈমান গ্রহণের কারণে তিনি হলেন ত্যাজ্যপূত্র।

নব মুসলিম আবদুর রহমান শৈশব-কৈশোর-যৌবন, কোনো কালেই ইসলাম ও মুসলমানদের সহ্য করতে পারতেন না, দূরত্ব বজায় রেখে চলার পরও আল্লাহর মেহেরবানিতে আঁধার সরে গিয়ে আলোক উজ্জ্বলতার পথে তিনি আসতে পেরেছেন, এটি তার জন্য দ্বিমুখী অর্জন। মৃত্যুর আগের এবং পরের।

অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর মুস্তফা আল মাদানি হুজুরের প্রচেষ্টায় আবদুর রহমানকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ভারতের উত্তর প্রদেশের শাহরানপুর মাদরাসায়। মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর মাদরাসায় প্রথম সারিতে পড়তে আসা নানা ধরনের পারিপার্শ্বিক সমস্যার একটি। কিন্তু না, আবদুুর রহমান যতটা কঠিন ভেবেছিলেন মাদরাসার সুহৃদ শিক্ষকরা ও ছাত্র ভাইদের ব্যবহার বাস্তবে তা বহুগুণে সহজ করে দিলো। আবদুর রহমানের মনে হতে লাগল নিজ সহোদর ভাই যেন মুচকি হাসি দিয়ে তাকে পরম শান্তির দিকে স্বাগতম জানাচ্ছেন। মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে নব মুসলিম আবদুর রহমান আল্লাহর কামেল বান্দাহদের অনেকের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, কস্তুরির ঘ্রাণে কাদা যেমন সুগন্ধীময় হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি তাকওয়ার পরিশুদ্ধতায় ঈমানি নূরের পরশে আবদুুর রহমানের মন, মস্তিষ্ক হয়ে ওঠল ঈমানদীপ্ত।

প্রশান্ত হৃদয়ে প্রতিটা ক্ষণ কাটতে লাগল, আল্লাহকে পাওয়ার আশা- চেষ্টায় একাকার আবদুর রহমান। নতুন এ সালাত আদায়কারীর প্রতিটি মুনাজাতে থাকে বাবা-মায়ের জন্য বিশেষ দোয়া, দ্বীনে ফেরার দোয়া। এ দোয়ার পর আবদুুর রহমান যে প্রশান্তি অনুভব করেন তা বর্ণনাতীত। আবদুর রহমানের দৃঢ় বিশ্বাস আল্লাহ তার দোয়া কবুল করবেন কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছিল ভিন্ন। এক বছর যেতে না যেতেই বাবা-মায়ের মৃত্যুর সংবাদ তার কাছে পৌঁছে। আবার হৃদয় বিষণ্নতায় ছেয়ে যায়, আঁধারে ডুবে যায় তার কিছু সুপ্ত স্বপ্ন, বন্ধ হয়ে যায় প্রার্থনার সেই প্রশান্তিময় অনুভব। নিশ্চুপ আবদুর রহমান মায়ের শূন্যতার কাছে থমকে গেলেন ক্ষণিক সময়ের জন্য। অতঃপর আল্লাহ তার হৃদয়ে ফের প্রশান্তি দিলেন, আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার করুণার শিশিরে সিক্ত হলো আবদুর রহমানের হৃদয়। শিক্ষকমণ্ডলীর গভীর মমতা আর সহপাঠীদের ভালোবাসার সাহায্যে ভগ্ন হৃদয় আবার তাজা হতে লাগল।

নব্য দ্বীনে ফেরা অন্তরে আল্লøাহর প্রেমে সিক্ত হওয়ার দৃঢ় ভালোবাসা স্থায়ীভাবে স্থান করে নিলো; অতঃপর দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের পথ ক্রমান্বয়ে শেষ হলো।

আল্লাহ যাকে হেদায়াতের পথে আনতে চান শত প্রতিবন্ধকার পরও সে পথ থেকে তাকে কেউ বিচ্যুত করতে পারে না; একজন ব্রাহ্মণ যে সৃষ্টিকর্তাকে চিনতই না, রব্বে জুলজালাল অন্ধকার থেকে টেনে বের করে তাকে তার সৃষ্টিকর্তাকে চিনিয়েছেন, দ্বীন ইসলামে অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং বর্তমানে ইসলামের ওপর অটল রেখেছেন, এ এক বড় পাওয়া আমার বাবার জন্য। তিনি শত নির্যাতনের পরও পরিবার ছেড়ে মুসলিম হয়েছিলেন বলেই তার সন্তানরা মুসলিম বাবা-মা পেয়েছে। বাবা আমাদের ভাইবোনদের প্রথম শিক্ষক, ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে যার রয়েছে অসম্ভব রকমের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

রব্বে কারিম প্রতিটি বালুকণার হিসাব রাখেন, অবশ্যই জুলুমের বিচার তিনি কঠিন থেকে কঠিনতর করবেন এবং মাজলুমকে দেবেন চিরস্থায়ী জান্নাত। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সূরা বাকারার ১৫৫ নম্বর আয়াতে ধৈর্যশীলদের জন্য সুসংবাদ দিয়েছেন, আমাদেরকে যেন মহান রব সুসংবাদপ্রাপ্ত বান্দাহদের কাতারে শামিল করেন!

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us